হিল ভয়েস, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ঢাকা: বান্দরবানের রাবার কোম্পানি ‘লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ কর্তৃক লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের আদিবাসী ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীদের ৪০০ একর ভূমি বেদখলের প্রচেষ্টা ও বৌদ্ধ বিহারের জায়গায় জোরপূর্বক ঘর নির্মাণের প্রতিবাদে এবং ভূমিদস্যুদের শাস্তির দাবিতে ঢাকার হাইকোর্টের সামনে এক অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি পালিত হয়েছে। অবস্থান ধর্মঘট থেকে সরকার ও সুধীসমাজকে উদ্দেশ্য করে ভূমিদস্যু রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের হাত থেকে ভুক্তভোগী আদিবাসীদের রক্ষা করার দাবি জানানো হয়েছে।
আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এই অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচির আয়োজন করে লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি।
অবস্থান ধর্মঘট চলাকালে ভুক্তভোগী গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরা, কমিটির সদস্য ও কার্বারি (রেংয়েন ম্রো পাড়ার প্রধান) রেংয়েন ম্রো প্রমুখ। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দও সংহতি বক্তব্য প্রদান করেন।
এসময় রংধজন ত্রিপুরা তার বক্তব্যে বলেন, ভূমিদস্যু রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি এমন ঘটনা ঘটিয়েছে যা মানবাধিকার লঙ্ঘন। এই ভূমিদস্যুরা রাষ্ট্রের সকল আইন অমান্য করে, প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একের পর এক তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
অবস্থান ধর্মঘটকে সামনে রেখে ‘লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’ কর্তৃক এইদিন একটি প্রচারপত্রও প্রকাশ করা হয়।
উক্ত প্রচারপত্রে অভিযোগ করে বলা হয়, ‘লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ দীর্ঘদিন ধরে বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রো পাড়া, রেংয়েন ম্রো পাড়া ও জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়ায় ম্রো-ত্রিপুরাদের ৪০০ একর ভূমি বেদখল করার পাঁয়তারা চালিয়ে আসছে। পাহাড়িদের ভোগ দখলীয় জমি কেড়ে নিতে রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানির দুর্বৃত্তরা একের পর এক হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের, হামলা, নির্যাতনসহ নানা ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। চলতি বছর ১ জানুয়ারি দিবাগত গভীর রাতে রেংয়েন ম্রো পাড়ায় ৬টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। এর আগে গত বছর ৯ ও ২৬ এপ্রিল জুম ভূমি কেটে ও আগুন লাগিয়ে দিয়ে বাগান-বাগিচা, ক্ষেতসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে দেওয়া হয়, ১৩ জুলাই ভূমি রক্ষা আন্দোলনের সংগঠক রংধজন ত্রিপুরার ওপর হামলা করা হয়, ১০ আগস্ট রেংয়েন ম্রো পাড়াবাসীদের নির্মিত অশোক বৌদ্ধ বিহার ভাঙচুর ও বুদ্ধমূর্তি লুট করা হয়, ৬ সেপ্টেম্বর রেঙয়েন ম্রো পাড়া বাসিন্দাদের একমাত্র পানির উৎস ঝিরিতে বিষ ঢেলে গ্রামবাসীদের হত্যার চেষ্টা করা হয়, ২৪ সেপ্টেম্বর পাড়ার এক বাসিন্দার ৩০০ কলাগাছ কেটে দেওয়া হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেখানে পাড়াবাসীদের উদ্যোগে স্কুল নির্মাণে বাধা প্রদান করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের দেলোয়ারের নেতৃত্বে ৩০ জন শ্রমিক গিয়ে রেংয়েন ম্রো পাড়ার অশোক বৌদ্ধ বিহারে জায়গা দখল করে ঘর নির্মাণ করে।’
প্রচারপত্রে আরো বলা হয়, ‘আমরা প্রতিনিয়ত ভয়-আতঙ্ক ও অনিরাপদে জীবন-যাপন করছি। আমাদের ওপর লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানির লেলিয়ে দেওয়া দুর্বৃত্তরা বার বার আক্রমণ করেছে এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন লামায় লাংকম ও রেংয়েন ম্রো পাড়া এবং জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়ায় সফর করেছিলেন। সে সময় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ পাড়াবাসীদের নানা আশ্বাস প্রদান করেছিলেন। ম্রো-ত্রিপুরা পড়াবাসীরা ভেবেছিল এবার হয়তো তারা নিরাপত্তায় থাকতে পারবে, তাদের বেঁচে থাকার শেষ সম্বল ৪০০ একর ভূমি ফিরে পাবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। ম্রো ও ত্রিপুরা পাড়াবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, তাদের ভূমি ফেরৎ না দিয়ে প্রশাসন রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’র সুবিধার্থে সে এলাকায় অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিন পাড়াবাসী সেখানে পুলিশ ক্যাম্প চায় না, তারা তাদের জুম ভূমি বেদখল বন্ধ ও বেদখলকৃত ভূমি ফেরৎসহ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায়।’
প্রচারপত্রে ‘লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’ কর্তৃক নিম্নোক্ত ৭ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়ঃ
১) লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক ভূমি বেদখল বন্ধ করতে হবে এবং ম্রো ও ত্রিপুরাদের ভোগ দখলীয় ৪০০ একর জুম ভূমিসহ কোম্পানি কর্তৃক বেদখলকৃত সকল জমি ফেরত দিতে হবে।
২) উক্ত কোম্পানির কর্মকান্ডের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ম্রো ও ত্রিপুরাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩) জুম ভূমি কেটে ও আগুনে পুড়িয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা, অশোক বৌদ্ধ বিহারে হামলা ভাংচুর ও বুদ্ধ মূর্তি লুট, কলাইয়া ঝিরির পানিতে বিষ প্রয়োগ এবং ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরার উপর হামলার সাথে জড়িত কামাল উদ্দিন, মোয়াজ্জেম হোসেন, জহির উদ্দিনসহ রাবার কোম্পানির দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দিতে হবে।
৪) কোম্পানি কর্তৃক ভূমি রক্ষা কমিটির নেতৃবৃন্দ ও গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
৫) বান্দরবানে রাবার ও অন্যান্য বাগান সৃজন কিংবা পর্যটন উন্নয়নের উদ্দেশ্যে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে দেয়া সকল জমির লিজ বাতিল করতে হবে।
৬) লামা সরই ইউনিয়নের রেংয়েন ম্রো পাড়ায় ৬টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটপাটে ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং অগ্নিসংযোগকারী রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের দুর্বৃত্তদের গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে।
৭) লাংকম ম্রো পাড়া, রেংয়েন ম্রো পাড়া ও জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়াবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং ভূমিদস্যুদের সহায়ক অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।