শ্রী অমরজিৎ
ভূমিকাঃ
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), যা একসময় সাধারণ জনগণের কাছে ‘শান্তিবাহিনী’ নামে সমধিক পরিচিত ছিল- জুম্ম জনগণের এই প্রাণপ্রিয় সংগঠন ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রতিষ্ঠা পায়। জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে এই সংগঠন জন্ম লাভ করে। এই সংগঠনের নেতৃত্বে ১৯৭২ সাল থেকে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন পরিচালিত হয়ে আসছে এবং এই আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্য হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণের স্বশাসন স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়।
জনসংহতি সমিতি- পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতির সমর্থন ও অংশগ্রহণে গঠিত জুম্ম জনগণের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন। জন্মলগ্ন থেকে এই সংগঠনের প্রথমে গণতান্ত্রিক, তারপর সশস্ত্র সংগ্রাম এবং ১৯৯৭ সালে চুক্তির গণতান্ত্রিক সংগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতির সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠার পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠেছিলো বটে তবে সেসব সংগঠন মূলত ছিল- জাতিভিত্তিক। এম এন লারমা-ই প্রথম নেতা, যিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতিকে নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা ভেবেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। এর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন নেতা পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতিকে নিয়ে কোন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা কিংবা উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।
শান্তিবাহিনী হয়ে উঠার গল্প
সাধারণ জুম্ম জনগণের কাছে জনসংহতি সমিতি ‘শান্তি বাহিনী’ নামেই সমধিক পরিচিত। জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় সংগঠন জনসংহতি সমিতির ‘শান্তি বাহিনী’ নাম ধারণের পেছনেও একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর হতে বেশ কয়েক বছর পার্বত্য চট্টগ্রামে চোর-ডাকাতি কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানী সেনার ফেলে যাওয়া অস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের অ-জমাকৃত অস্ত্র দিয়ে শুরু হয় ডাকাতি কার্যক্রম। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ে। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের প্রতিটি রাত ছিল- ভয়ের রাত। ডাকাতরা কখন কোন গ্রামে হামলা করে সর্বদা সে ভয়ে রাত্রিযাপন করতো পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ। জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রামের এই চোরডাকাতদের দমন করে অত্রাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। তখন থেকে জুম্ম জনগণ এই সংগঠনকে ‘শান্তিবাহিনী’ নামে ডাকতে শুরু করে। এরপর শান্তিবাহিনী নামটি জনগণের মুখে মুখে হয়ে যায়। এভাবে জনসংহতি সমিতি ‘শান্তিবাহিনী’ নামে প্রতিষ্ঠা পায়।
শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলন ও জনসংহতি সমিতি
জনসংহতি সমিতির আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার আন্দোলনে শুরু থেকেই শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলন যুক্ত ছিল। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সমাজে শিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজন- এই উপলদ্ধি জেএসএস নেতৃত্বের প্রথম থেকেই ছিল। সেকারণে দেখা যায় যে, এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত এম এন লারমা, বর্তমান নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমাসহ অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় সদস্যবৃন্দ শিক্ষকতা পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। সেকারণে কেউ কেউ জনসংহতি সমিতির আন্দোলনকে ‘Teachers Movement’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। জনসংহতি সমিতি ঘুনেধরা জুম্ম সামন্ত সমাজকে পরিবর্তনের জন্যও শুরু থেকে কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন। জনসংহতি সমিতির শিক্ষা আন্দোলনও ছিল- এই ঘুনেধরা সামন্ত সমাজকে পরিবর্তনের একটি অন্যতম উদ্যোগ। সমাজের সামন্তব্যবস্থা ও সামন্ত চিন্তাচেতনা- জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এই উপলদ্ধি থেকে জনসংহতি সমিতি জুম্মদের সামন্তব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন সংগঠনের জন্মলগ্ন থেকে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও স্বাধিকার আন্দোলন
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীসমাজকে অধিকার সচেতন এবং তাঁদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার লক্ষে ১৯৭৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি গঠন করে। এই সংগঠনের নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে সশস্ত্র ও গণতান্ত্রিক- এই উভয় সংগ্রামে যেমনি অবদান রেখেছিলেন, তেমনি জুম্ম নারীদের অধিকার সচেতন ও সঙ্ঘবদ্ধ করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ উপলদ্ধি করেছিলেন সমাজের অর্ধেক অংশ- এই নারী সমাজকে অধিকার সচেতন করা না গেলে ঘুনেধরা সামন্ত সমাজকে যেমনি পরিবর্তন করা যাবে না, তেমনি জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। সেলক্ষে ১৯৭৫ সালে এই পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি গঠন করা হয়। উল্লেখ্য যে, জনসংহতি সমিতি নারীদের পাশাপাশি সমাজের পুরুষ সদ্যসদেরও নারী অধিকার বিষয়ে সচেতন করার কার্যক্রমও সংগঠনের কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করে। চুক্তি সম্পাদনের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি এই চুক্তি বাস্তবায়নের সংগ্রামেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোন কোন সময় মহিলা সমিতি, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাথে যৌথভাবেও চুক্তি বাস্তবায়নের সংগ্রাম পরিচালনা করে।
জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব ও আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার সংগ্রাম
জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব বরাবরই সাহসী ও শক্তিশালী ছিল এবং সমিতি সে ধারা এখনো বজায় রেখেছে। জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব শক্তিশালী ছিল বলেই এই সংগঠনের নেতৃত্ব সর্বদা সঠিক ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান যখন রচনা করা হল তখন এম এন লারমা পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন- আন্দোলন ব্যতীত আওয়ামী লীগ সরকার কখনো জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে না। সংবিধান রচনাকালেই তিনি মনস্থির করে ফেলেন- আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সে আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। তবে তিনি জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠার আগে দেশের জাতীয় পর্যায়ের নেতা ও বুদ্ধিজীবী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক-রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭৫ সালে দেশে যখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হল এবং দেশে সামরিক শাসন জারি হল, ঠিক সেসময়ে জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হলো। এটিও ছিল- জনসংহতি সমিতির সঠিক ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত, বিশেষত তখনকার সময়ের স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে। আবার সারা পৃথিবীতে যখন সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবেশ হ্রাস পেলো, তখন জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র সংগ্রাম পরিত্যাগ করে জুম্ম জনগণের স্বশাসন সম্বলিত অধিকার নিয়ে এক চুক্তির মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে সামিল হতে পিছপা হননি। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারার কারণে জনসংহতি সমিতি জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার আন্দোলন চালিয়ে নিতে এখনো সক্ষম হচ্ছে।
আমরা যখন জনসংহতি সমিতিকে নিয়ে আলোচনা করবো, স্বাভাবিক কারণে তখন এম এন লারমার কথা এসে যায়। কারণ জনসংহতি সমিতি ও এম এন লারমার জীবন ও সংগ্রাম একাকার হয়ে আছে। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির আলোচনা পূর্ণাঙ্গ হয় না, হতে পারে না। এম এন লারমা একটি আলোকিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ও বড় হয়েছিলেন। যে শহর সূর্য সেন-প্রীতিলতাসহ বহু বিপ্লবী মানুষের জন্ম দিয়েছিল সেই শহরে এম এন লারমা তাঁর শেষ শিক্ষাজীবন কাটিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য যে, শ্রী লারমা চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ছিলেন। সেসময়কালে তিনি দু’ভাবে বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত হন। এটি ১৯৬০-১৯৬৫ সালের কথা। এসময়কালে সারা পৃথিবীতে যেমনি বিপ্লবী আন্দোলন চলছিল তেমনি চট্টগ্রামেও সে বিপ্লবী আন্দোলনের জোয়ার আছড়ে পড়েছিল। তিনি এসময় চট্টগ্রামের বহু বিপ্লবী মানুষের সংস্পর্শে আসেন। অপরদিকে চট্টগ্রামে পাওয়া যেতো বিভিন্ন বিপ্লবী গ্রন্থ। তিনি সেসময়কালে বিপ্লবী আদর্শের বিভিন্ন দার্শনিক ও লেখকের গ্রন্থ পড়ে বিপ্লবী আদর্শ বিষয়ে জানতে পেরেছিলেন ও প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই বিপ্লবী আদর্শে আদর্শিত হয়েই তিনি পাকিস্তানী সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে একাই রুখে দাঁড়াবার সাহস অর্জন করেছিলেন। স্বৈরাচারী পাকিস্তানী সরকার যখন জুম্ম জনগণের মরণফাঁদ ‘কাপ্তাই বাঁধ’ নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন, তখন তিনি একাই এই মরণফাঁদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তখনকার সময়ের পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেউ সাহস করে এগিয়ে আসেনি- এই কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রচারের কারণে তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘ প্রায় ২ বছর কারাগারে ছিলেন। কারাগারে অন্তরীন অবস্থায় তিনি বিএ পাশ করেন।
শ্রী লারমা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হবার মধ্য দিয়ে শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক জুম্ম জনগণের উপর নিপীড়ন ও নির্যাতনকে তিনি খুব কাছে থেকে দেখার ও জানার সুযোগ লাভ করে। এভাবে বিপ্লবী এম এন লারমার রাজনৈতিক চিন্তাধারা আরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর এই চিন্তাধারার বিকশিত রূপ হল- জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় সংগঠন জনসংহতি সমিতি ও এই সংগঠনের নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার আন্দোলন। কাপ্তাই বাঁধের কারণে জুম্মদের নিজভুমি থেকে উচ্ছেদ, তাদের উদ্বাস্তু জীবন ও আহাজারি তিনি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। পরবর্তীতে শাসকগোষ্ঠীর নানা নিপীড়ন ও বঞ্চণা তাঁর সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিলো। শাসকগোষ্ঠীর নানা নিপীড়ন ও বঞ্চনার জীবন থেকে জুম্ম জনগণকে মুক্তির লক্ষে তিনি রাজনৈতিক বিপ্লবী জীবনকে তাঁর জীবনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন।
এদিকে পাকিস্তান সরকার যখন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে ঘোষণা করল তখন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-জনতা বাংলাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন শুরু করলেন। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থান ও সর্বশেষ একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। গণপরিষদের একজন সদস্য হিসেবে এম এন লারমা সে সংবিধান রচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটি কর্তৃক যখন গণপরিষদে খসড়া সংবিধান উপস্থাপন করা হল তখন দেখা গেল যে, খসড়া সংবিধানে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি প্রদান করা হলেও আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের স্মরণাতীত কালের শাসনতান্ত্রিক অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি এবং সংবিধানে বলা হল- “বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালী বলিয়া বিবেচিত হইবে”। এম এল লারমা তখন গণপরিষদে এর প্রতিবাদ করেন এবং বলেন- বাংলাদেশে চাকমাসহ বহু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে যারা বাঙালি নন। সেকারণে তিনি সংবিধানে ‘বাঙালি’ শব্দের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী’ শব্দ প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব রেখেছিলেন এবং তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতিসমূহের অস্তিত্ব সুরক্ষা ও বিকাশের লক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য সংবিধানে স্বশাসনের বিধান রাখার প্রস্তাব করেছিলেন।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শ ধারণকারী নেতৃত্ব এবং এই উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শের পাশাপাশি স্বাধীন জাতি হয়ে উঠার দম্ভ ও অহংকার এত প্রবল ছিল যে, তখন তাঁরা এম এ লারমার মতো একজন প্রান্তিক মানুষের প্রস্তাবকে গুরুত্ব কিংবা পাত্তা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। অথচ বাংলাদেশের হাজার-লক্ষ আদিবাসী মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলো। বহু আদিবাসী মানুষ মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছিল। তথাপি বাংলাদেশের সংবিধানে সেসব আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি মেলেনি। স্বীকৃতি মিলেনি দেশের ৫০টির অধিক আদিবাসী জাতিসমূহের। সেকারণে ১৯৭২ সালের সংবিধান সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক সংবিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারেনি। উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শের সৈনিক- গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি সদস্যের ভোটে ১৯৭২ সালে সংবিধানের সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক ধারাসমুহকে বজায় রেখে সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধান গণপরিষদে পাশ হয়। তবে এম এন লারমা সংবিধানের সেইসব অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক ধারাসমূহের প্রতি প্রতিবাদ জানিয়ে গণপরিষদ থেকে বেরিয়ে আসেন, তিনি ওয়াকআউট করেন। প্রতিবাদে তিনি সংবিধানে স্বাক্ষরও করেননি।
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের এই উগ্র সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। যদি আমরা ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো আওয়ামী নেতৃবৃন্দের এহেন চিন্তাধারার পেছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। আওয়ামী লীগ যখন ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা পায়, তখন এর নাম ছিল- আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরবর্তীতে রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ করা হলেও আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের মন থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি কখনো মুছে ফেলতে পারেননি। প্রকৃতপক্ষে সেসময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতারা কৌশলগত কারণে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে যখন সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধান রচনা করা হল তখন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাম্প্রদায়িক মুসলিম চিন্তাধারা, সাথে উগ্র বাঙালীত্ব জলের মতো স্বচ্ছ ও স্পষ্ট হয়ে উঠে।
ছাত্র জীবন থেকে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার আলোকে গড়ে উঠা এম এন লারমা- গণপরিষদের একজন সদস্য হিসেবে সদ্য স্বাধীন দেশে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সত্যিকারের জনগণের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছিলেন। এধরনের একটি সংবিধান প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি কতগুলি প্রস্তাব রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন সেই কৃষক, শ্রমিক, মাঝিমাল্লা, কামার-কুমারসহ দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা সংবিধানে সন্নিবেশ করার কথা তিনি বলেছিলেন। কিন্তু বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, সংবিধানে তাদের অধিকার ও স্বার্থ যথাযথভাবে সন্নিবেশিত হয়নি। যার কারণে স্বাধীনতার অর্ধশত বছর অতিবাহিত হলেও বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, মাঝিমাল্লা ও সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি।
সংবিধানে সাধারণ জনগণের অধিকার যথাযথভাবে সন্নিবেশিত না হওয়ায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মজবুত হতে পারেনি। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও এর কাঠামো মজবুত না হওয়ার কারণে ১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার সুযোগ পায়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭২ সালের সংবিধানে অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার বীজ রোপিত হয়েছিল। সেই অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পথ বেয়ে ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত করা সম্ভবপর হয়েছিল। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭২ সালে একটি সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা, সংবিধানে সাধারণ মানুষের অবদান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা এবং ১৯৭৫ সালে তাঁর মৃত্যু- এসবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করলে এটিই দাঁড়ায় যে, শেখ মুজিবুর রহমান প্রকৃতপক্ষে নিজের গর্ত নিজেই কুড়িয়েছিলেন।
অনেকেই বলেন- বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ক্ষতি হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি নাকি বলেছিলেন তিনি তাঁর ভুল শোধরাবেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের দাবি পূরণ করবেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে জুম্ম নেতৃবৃন্দের নিকট দেয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি তিনি রাখতেন কী না সেটি দেখার বিষয় ছিল। কিন্ত ১৯৭৫ সালে তাঁর মৃত্যুর কারণে সেটি দেখার আর সুযোগ হল না। তবে আওয়ামী লীগের আদর্শের যে পরম্পরা তা দেখে মনকে বিশ্বাস করানো খুব কষ্টকর হয়। আওয়ামী লীগের গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক কিংবা সত্তর-একাত্তরের নেতৃত্ব কিংবা বর্তমান নেতৃত্বের আদর্শ ও তাদের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করলে সারাংশে এই দাঁড়ায়- ১৯৪৯, ১৯৭১-৭২ ও ২০২৩ সালের নেতৃত্বের আদর্শের মধ্যে কোন তারতম্য লক্ষ্য করা যায় না। আওয়ামী লীগ মুখে বা কাগজে-পত্রে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার কথা বললেও বাস্তবে তাদের প্রত্যেকটি কার্যকলাপে অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। কেন্দ্রীয় কমিটিসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটি গঠন প্রণালী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পরিচালনা, আইন ও পলিসি প্রণয়ন, দেশের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ সাধারণ মানুষের প্রতি আচরণ- সবকিছু বিশ্লেষণ করলে তাদের অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, উগ্র বাঙ্গালিত্ব ও লুটেরা চরিত্রটাই প্রকটভাবে ফুটে উঠে।
সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর নানা অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক আচরণ এম এন লারমাকে আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। সংগ্রাম ব্যতীত জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে না- এ ধরনের চিন্তাধারা দিন দিন গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। তথাপি এম এন লারমা জাতীয় পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শ গ্রহণ করেন। তাঁদের অনেকেই জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের বিকল্প নেই বলে এম এন লারমাকে পরামর্শ প্রদান করেছিলেন। কেউবা সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলার পরামর্শ প্রদান করেছিলেন এবং বলেছিলেন- সংখ্যালঘু জাতিদের সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতীত অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এম এন লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রবীণ নেতা ও বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক নেতাদের সাথেও এবিষয়ে মতবিনিময় করেন। তিনি তাঁর সতীর্থ ও কর্মীদের সাথেও আলাপ আলোচনা করেন। অতঃপর তিনি জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে সংগ্রাম পরিচালনা করার জন্য ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাজুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এই হল- জনসংহতি সমিতি জন্মলাভের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল অবধি জনসংহতি সমিতি গণতান্ত্রিক সংগ্রাম চালিয়ে যায়। কিন্ত ১৯৭৫ সালে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে এবং দেশে সামরিক শাসন জারি হলে এম এন লারমা সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিতে বাধ্য হন। দীর্ঘ ২৫ বছর জুম্ম জনগণকে সাথে নিয়ে জনসংহতি সমিতি সার্থকভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার মধ্য দিয়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সাথে এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে উপনীত হতে সম্ভবপর হয়। এই চুক্তি জুম্ম জনগণের মাঝে এবং দেশে বিদেশে প্রশংসিত হয়। এই চুক্তিতে জুম্ম জনগণের স্বশাসন স্বীকৃতি লাভ করে। তবে চুক্তির পর শেখ হাসিনা সরকারের মাঝেও ‘মুসলিম’ নামক প্রেতাত্মা জেগে উঠে। আওয়ামী লীগ আবারো আওয়ামী মুসলিম লীগ চরিত্র ধারণ করে। মুসলিম শব্দ প্রত্যাহার করাকে আওয়ামী লীগ যেমনি একটি কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছিলো, তেমনি জনসংহতি সমিতির সাথে চুক্তি করাকেও তাঁরা একটি কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে। চুক্তির পর শেখ হাসিনা সরকারের বাস্তব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হল- প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনা সরকার জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তিতে আবদ্ধ হয়নি। জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনীর অস্ত্র কৌশলে কেড়ে নেয়া এবং জনসংহতি সমিতির আন্দোলনকে ভেস্তে দেওয়াই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।
চুক্তি করার পর চুক্তি বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হল- চুক্তির বিধানসমূহ আইনে পরিণত করা। চুক্তির ক ও খ খণ্ড অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের আইন প্রণয়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই আইন প্রণয়ন করতে যেয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা প্রথমেই চুক্তি লঙ্ঘন করে বসে। এটি ১৯৯৮ সালের কথা। চুক্তি অনুসারে যেভাবে আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের আইন প্রণয়ন করার কথা ছিল সেভাবে করা হয়নি। আজকে অনেক সময় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ কর্তৃক জনসংহতি সমিতি চুক্তি লঙ্ঘন করছে- এধরনের মিথ্যা অভিযোগ শোনা যায়। কোন কোন সময় সামরিক কর্মকর্তারাও প্রকাশ্যে (এমন কী মিডিয়াতেও) জনসংহতি সমিতি কর্তৃক চুক্তি লঙ্ঘনের কথা বলে থাকেন। কিন্তু চুক্তির কোন ধারা জনসংহতি সমিতি কর্তৃক লঙ্ঘন করা হয়েছে তা তাঁরা স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে পারেননি বর্তমান অবধি। কিন্ত দেশের সচেতন নাগরিক যারা, তাঁরা জানেন যে চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে যখন ১৯৯৮ সালে আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিলো তখন আওয়ামীলীগ সরকার তথা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা চুক্তি লঙ্ঘন করে আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন করেছিলো। পরবর্তীতে জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ কর্তৃক বহু ধরণা, লবি ও সংগ্রামের পর চুক্তি মোতাবেক আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন করা সম্ভবপর হয়।
তেমনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন- ২০০১ প্রণয়নকালে [যা চুক্তির অংশ] আওয়ামী লীগের আইন প্রণেতারা আইন লঙ্ঘন করে আইন প্রণয়ন করেছিলো। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই আইনটিও সংশোধন করা সম্ভবপর হয়েছিল। চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিটি পদক্ষেপে আওয়ামী লীগ সরকার চুক্তি লঙ্ঘন করে আইন প্রণয়নসহ এর বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে ও নিচ্ছে। চুক্তির মৌলিক বিষয়- যেমন, স্বশাসন প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, সাধারণ প্রশাসন ও উন্নয়ন সংক্রান্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব সরকার আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট অদ্যাবধি হস্তান্তর করেনি। যেসব বিষয় হস্তান্তর করেছে তারও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চুক্তি লঙ্ঘন করে হস্তান্তর করা হয়েছে। তেমনিভাবে দেশের অপরাপর অঞ্চলের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এ অঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসনকে কার্যকর করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো সকলক্ষেত্রে সামরিক কর্তৃত্ব রয়েছে। সামরিক প্রশাসনের অনুমতি ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি পাতাও নড়ে না, নড়তে পারে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেনাবাহিনীর কাছে লিজ দিয়ে রেখেছে। সেনাবাহিনীর সম্মতি ব্যতীত সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে না। সেকারণে চুক্তি অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। চুক্তি অনুসারে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। কারণ আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন করতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। এধরনের ভোটার তালিকা প্রণয়ন করতে গেলে বিশেষত বাঙালি অস্থায়ী বাসিন্দা তথা সেটেলার বাঙালিরা ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাবে, যা সেনাবাহিনী তথা সরকার চায় না। কারণ, তাঁরা মনে করে সেটেলার বাঙালিরা যদি ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায় তাহলে সেটি হবে তাদের জন্য এক ধরনের পরাজয়। সেনাবাহিনীর এধরনের সংকীর্ণ চিন্তাধারা ক্রিয়াশীল থাকার কারণে [এক ধরনের অহেতুক ইগু কাজ করার কারণে] তারা ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন আটকে রেখেছে। যার কারণে সরকার ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদ নির্বাচন দিতে পারছে না।
তেমনিভাবে অপারেশন উত্তরণ [যার ভিত্তি করে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে] প্রত্যাহারসহ ৫০০ এর অধিক অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করার কথা থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকার তিন দফায় মাত্র ১০১টি অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করে। সেনাবাহিনীর বাধার কারণে শেখ হাসিনা সরকার পরবর্তীতে আর কোন সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করতে পারেনি; বরঞ্চ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে নূতন নূতন সেনাক্যাম্প গড়ে তুলেছে। পাশাপাশি ইদানীং সেনা নিপীড়নও অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছে। সেনাবাহিনীর এই সংকীর্ণ চিন্তা, ইগু ও তাদের স্বার্থের সাথে যুক্ত হয়েছে আওয়ামী লীগের উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িক অংশের নেতা, ব্যবসায়ী ও আমলা। এরা সবাই মিলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে যেমনি বাধা দিচ্ছে, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করে তাদের হাতে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতাসহ সকল ক্ষমতা হস্তান্তরে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে- জুম্ম জনগোষ্ঠীর মীরজাফর ও ক্ষমতা লোভী বিভেদপন্থীর দল।
উপসংহার:
শাসকগোষ্ঠী- সেনাবাহিনী, সেটেলার বাহিনী, পার্বত্য নাগরিক পরিষদ, কুকি-চিন বাহিনী, মগ বাহিনী, প্রসিত বাহিনী, সংস্কার বাহিনী, দালাল মীরজাফর বাহিনী দিয়ে জনসংহতি সমিতিকে ধ্বংস করার জন্য বহু চেষ্টা করার পরও শাসকগোষ্ঠী জনসংহতি সমিতির কার্যক্ষমতাকে ধ্বংস করতে পারেনি, তেমনি জনগণ থেকেও এই লড়াকু সংগঠনকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। যার কারণে জনসংহতি সমিতি আজও জনগণের বলে বলীয়ান। এতকিছুর পরও জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব ও কর্মীবাহিনী সাহসের সহিত জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন যথাযথভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
শাসকগোষ্ঠীকে মনে রাখতে হবে জনসংহতি সমিতি গণতান্ত্রিক ও সশস্ত্র- এই উভয় সংগ্রাম পরিচালনায় যারপরনায় পারদর্শী। সেনাবাহিনীর প্রধান কিংবা চট্টগ্রামের জিওসিকেও একথা মনে রাখতে হবে। ২৫ বছর যুদ্ধ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তিবাহিনীর কোন কিছুই করতে পারেনি, শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর প্রধানকে বলতে হয়েছিল- আমরা রনক্লান্ত, সুতরাং আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধান হওয়া বাঞ্চনীয়। অতঃপর আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হয়।
শাসকগোষ্ঠী কিংবা এর সেনাবাহিনীর প্রধান কিংবা চট্টগ্রামের জিওসি যদি মনে করে ও ভাবে যে- নিমিষেই জনসংহতি সমিতিকে শেষ করে দিবে, তাহলে তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এখনো সময় রয়েছে- পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে জুম্ম জনগণের স্বশাসন প্রতিষ্ঠা করুন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বেসামরিক প্রশাসন, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুন। নইলে জনসংহতি সমিতি আবারো গর্জে উঠবে। তখন আবারো নির্লজ্জভাবে বলতে হবে- আমরা রনক্লান্ত। অতএব অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন।
পরিশেষে বলবো- জুম্ম জনগণের সংগ্রাম দীর্ঘজীবী হোক।