ধীর কুমার চাকমা
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাচীন শহর রাঙ্গামটি। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সদর তথা রাঙ্গামাটি মহকুমা সদরও বটে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র এই রাঙ্গামাটিতে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়েছিল। এই কমিটির সদস্য ছিলেন যথাক্রমে (১) মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, আহ্বায়ক, (২) জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, সদস্য, (৩) অমিয় সেন চাকমা, সদস্য, (৪) কালী মাধব চাকমা, সদস্য ও (৫) পঙ্কজ দেওয়ান, সদস্য। পরবর্তীতে বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজকে সভাপতি ও এম এন লারমাকে সাধারণ সম্পাদক করে সদ্য গঠিত জনসংহতি সমিতির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জুম্ম জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক দল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আত্মপ্রকাশ ছিল অভূতপূর্ব একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী আদিবাসী জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংকটের মুহূর্তে আদিবাসী জুম্মদের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির অভ্যূদয় ছিল অবিস্মরণীয় ঘটনা।
১৯৭০ সালের তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের উত্তাল গণআন্দোলনের জোয়ার অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামকেও আন্দোলিত করেছিল। তখন মাইনীর দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা), অপরদিকে ছাত্রদের পথ প্রদর্শকও বটে। তখন স্কুলের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পূর্ব-পাকিস্তানের গোয়েন্দা বাহিনীর লোকজন, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র সমিতির মিটিং শুনতো। এভাবে ছাত্র সমিতির কার্যক্রম তথা জ্যেতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু) গতিবিধির উপর তীক্ষ্ন নজরদারী করতো পূর্ব পাকিস্তানের গোয়েন্দারা। এমনকি পূর্বানুমোদন ছাড়া ছাত্র সমিতির সভা-সমাবেশও করতে দিতে চাইতো না।
একদা কালবৈশাখীর দিনে (পাকিস্তানের) জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পরপরই হঠাৎ করে দূরন্ত কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়ায় পতাকা-বাঁশটির পতাকা বাঁধা অংশটা (আনুমানিক দু/তিন হাত) ভেঙ্গে পড়ে। সেদিন সবেমাত্র জাতীয় সঙ্গীত ও প্রার্থনা পর্ব শেষে সবাই ক্লাশ রুমে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তখনো পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের কয়েকজন পতাকার স্ট্যান্ডের ধারেকাছে ছিলাম। ফলে পতাকা মাটিতে পড়তে না পড়তেই হাত ধরাধরি করে পুনরায় পতাকা উত্তোলন করেছিলাম। তারপরও এই অনাকাঙ্খিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে, শ্রদ্ধেয় সন্তু লারমার নামে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে রাজদ্রোহী মামলা রজ্জু হয় স্থানীয় দীঘিনালা থানায়। তারপর এই রাজদ্রোহী মামলা মাথায় করে, দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে ইস্তফা দিলেন শ্রদ্ধেয় সন্তু লারমা। পরবর্তীতে তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে চলে গেলেন গেরিলা জীবনে। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র সমিতির অনেক নেতাকর্মী, যারা সশস্ত্র আন্দোলনের শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসীন হয়েছিলেন। আজকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির একাদশ কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদকালে উদযাপিত হচ্ছে সমিতির ৫১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী।
’৭১ সালে ২৫ মার্চের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র সমিতির দীঘিনালা শাখার নেতৃত্বে দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা জঙ্গী মিছিল সহযোগে দীঘিনালা থানা ঘেরাও করেছিল। তখন আমরা পাহাড়ী ছাত্র সমিতির ছাত্ররা মনে করতাম, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরাও ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণমুক্ত হবে। তারই সাথে অবসান হবে সকল প্রকার বিজাতীয় শাসন-শোষণ, নিপীড়ন-নির্যাতনের। তাই জুম্ম ছাত্র-জনতা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে ট্রেনিং নিতে যায়। এখবর পাকিস্তানী গোয়েন্দার কানে চলে গেলে ছাত্র সমিতির নেতা-কর্মীরা আত্মগোপন করে। কিন্তু শেষে মুক্তিবাহিনীতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ থেকে তারা বাদ পড়ে যায়, কতিপয় স্থানীয় আঃলীঃ নেতার অসহযোগিতার কারণে।
১৯৭২ সালের মার্চে সরকারের কথায় আর এম এন লারমার আহ্বানে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম, যেখানে আমাকে ১৫/২০ জনের দলনেতা করা হয়েছিল। ভর্তির জন্য রাঙ্গামাটিতে পক্ষকাল ব্যাপী অধীর আগ্রহে অপেক্ষার পর শেষ পর্যন্ত নানা অছিলায় পুলিশে ভর্তি বাতিল হলো। তাই সদলবলে ফিরে এসে একপর্যায়ে পড়াশুনার পাঠ গুটিয়ে জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা সংগঠন শান্তি বাহিনীতে যোগ দিলাম। এভাবে দিনদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির গুরুত্ব অপরিসীম হয়ে উঠে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের জাতীয় জীবন সুখকর নয়। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর মতো জাতিগত নির্মূলীকরণের নিরবচ্ছিন্ন ষড়যন্ত্র আজো এদেশে বিদ্যমান। অন্যদিকে জুম্মদের মধ্যে সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল অংশের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে অতীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমাজ সভ্যতার ইতিহাস হচ্ছে শুধুমাত্র রাজন্যবর্গের বংশ পরম্পরায় শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস। গতানুগতিক সেই প্রথার বিপরীতে চল্লিশ দশকে অগ্রজ কৃষ্ণকিশোর চাকমা ও অনুজ চিত্ত কিশোর চাকমা প্রমুখদের উদ্যোগে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। এমতাবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণের ভাষাহীনের মুখে প্রতিবাদের ভাষা, ঘুমন্ত জাতির চোখে জাগানিয়ার অগ্নিমন্ত্র নিয়ে আবির্ভাব ঘটেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির।
সংগঠনের শুরুতে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের সামন্ত শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছিল। কারণ সামন্ততান্ত্রিক সমাজের নেতৃত্ব ছিল ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের ধারক বাহক। এই নেতৃত্ব বেআইনী অনুপ্রবেশ ঠেকাতে, সমাজ উন্নয়নের অবকাঠামো নির্মাণে অক্ষম। পেছিয়ে পড়া, কৃষি-নির্ভর অর্থনীতির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি হচ্ছে আদিবাসী জুম্মদের একমাত্র কাঁচা মূলধন ও স্থাবর সম্পত্তি। এই ভূমি দখলের উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগত বাঙালি অনুপ্রবেশ ঘটানো শুরু হয় ষাট দশকে পাকিস্তান আমলে। এই কাজ অসমাপ্ত রেখে পাকিস্তান সরকারকে বিদায় নিতে হয়েছিল। এই অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করেছিল বাংলাদেশ সরকার।
এলক্ষ্যে ’৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি সেনানিবাস স্থাপন করা জরুরী হয়ে পড়েছিল। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের অনেক ভূমি হাতছাড়া হয়ে যায়। শুধু আবাদী সমতল ভূমি নয়, জুম্মদের জুমভূমি থেকে শুরু করে শশ্মানভূমি পর্যন্ত আজ বহিরাগত সেটেলার বাঙালিদের বেআইনী দখল থেকে রেহাই পায়নি। জীবদ্দশায় তো নয়ই, মরার পরেও জুম্মদের নিজ দেশে ঠাঁই নেই, এমনতর অবস্থা হয়ে গেছে। বেআইনী অনুপ্রবেশকারীদের কারণে ভূমি বিরোধ এবং সামাজিক অবক্ষয় পার্বত্য চট্টগ্রামে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এসবের মূখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলমান বাঙালি অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিণত করে ইসলামিক সম্প্রসারণবাদ কায়েম করা। এরকম পরিস্থিতি থেকেই আদিবাসী জুম্মরা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে প্রতিরোধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়েছে।
যুগ যুগ ধরে ব্রিটিশ-ভারতে ঔপনিবেশিক শাসক-শোষকের ছত্রছায়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে ভাষাহীন ও মেরুদন্ডহীন করে রেখেছিল। স্মরণাতীত কাল থেকে সাধারণ আদিবাসী জুম্মরা রাজন্যবর্গের অঙ্গুলীহেলনে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকায় তারা নিজেদের নাম পরিচয় পর্যন্ত ভুলে যেতে বসেছে। তারা শাসকগোষ্ঠীর মন যুগিয়ে চলতে চলতে শাসরুদ্ধকর পরিবেশে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছে। তাই তাদের বিকাশ উপযোগী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭৫ সালে চালু করতে হয়েছিল গ্রাম পঞ্চায়েত ও পার্বত্য চট্টগ্রাম যুবসমিতির কার্যক্রম।
শিক্ষা আদিবাসী জুম্মদের নবীন প্রজন্মকে আধুনিক জীবনের দিক নির্দেশ করেছে। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত অভিজাত শ্রেণি সরকার ও শাসকগোষ্ঠীর সাথে আঁতাত করে, তাদের অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। যে শাসকগোষ্ঠী জুম্ম জনগণের অধিকার স্বীকার করে না, সেই শাসকগোষ্ঠীর হাত ধরে জুম্ম সমাজের মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্র জুম্ম জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে আজ চুক্তি বাস্তবায়ন কার্যক্রমকে প্রতি পদে পদে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। তা সত্তে ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি আজঅবধি সকল বাধা ডিঙিয়ে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। সব সময় আদিবাসী জুম্মদের পক্ষ হয়ে সংগ্রামে রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নানা উড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে গৌরবময় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজ ৫১ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। এই ৫১তম প্রতিষ্ঠা বাষিকীর মুহূর্তে বিশেষ উল্লেখযোগ্য স্থান জুড়ে রয়েছে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গ। জুম্ম জনগণের অসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত, আড়াই দশকের রক্ত-পিচ্ছিল সশস্ত্র আন্দোলনের ফসল হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। চুক্তিপূর্ব আন্দোলন থেকে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন আরো বৃহত্তর আন্দোলন হিসেবে বিবেচিত হতে হবে তা শতভাগ অনস্বীকার্য। এ আন্দোলনও পূর্বের ন্যায় জুম্ম জনগণের অকুন্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতায় সম্পন্ন হতে হবে।
১৯৮৩ সালে আন্দোলনের ইতিহাসে সবচেয়ে জটিলতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। যে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মহান নেতা এম এন লারমা আত্মাহুতি দিয়েছেন। তাই তাঁকে আজ এই দিনে রক্তিম অভিবাদন জানাই। তাঁকে হারানোর শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে পরবর্তী আন্দোলনের সকল বাধাবিপত্তি পদদলিত করে যাবার অঙ্গীকার নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৫১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জুম্ম জনগণের মহাসমাবেশ ঘটবে এবং বৃহত্তর আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কীভাবে আজ পাঁজ দশক ধরে অব্যাহতভাবে আপোষহীন আন্দোলনে লিপ্ত রয়েছে, আজ তা আবার নুতনভাবে বলার অবকাশ নেই। জুম্মদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ও নিপীড়ন নির্যাতন থেকে মুক্তির অদম্য স্পৃহার মধ্যে তার মর্মার্থ নিহিত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জুম্মদের স্বার্থরক্ষাকারী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ একটি রাজনৈতিক সংগঠন। একমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ছাড়া দেশের অন্য কোন রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে, জুম্মদের অস্তিত্ব সংরক্ষণের কথা উল্লেখ নেই। এমনকি আজ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে সরকার নিবন্ধন পর্যন্ত করতে দেয়নি। জুম্মরা কেবলমাত্র ভোট ব্যাংক হিসেবে এ পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আজকে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, শাসকগোষ্ঠী সবসময়ই দেশের বাঙালি জনগণকে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে উস্কে দেবার অপপ্রয়াস চালিয়ে এসেছে। ভিত্তিহীন অপবাদ দিয়ে থাকে যে, জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণ রাষ্ট্রবিরোধী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, সন্ত্রাসবাদী ইত্যাদি। বাংলাদেশ সরকার যদি পাকিস্তানের পদাঙ্ক অনুসরণ না করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতো, তাহলে এধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতো না। জুম্মদের রক্ষাকবচ হিসেবে ব্রিটিশরা ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিতে যে ন্যূনতম শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার শুরু থেকে নানা অজুহাতে খর্ব করে দিতে থাকে। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর মতো তার খেয়াল-খুশী মতো সংশোধন করে জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব বিলুপ্তির নীল নকশা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান সকল সমস্যার আশু সমাধান অনায়াসে সম্ভব হতো। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বার্তা দিতে অব্যাহতভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। অধিকন্তু সরকারের স্বার্থান্বেষী মহলের ইঙ্গিতে চুক্তি বিরোধী ভূইফোঁড় বিভিন্ন সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে নিত্য নূতন কৌশলে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। সদিচ্ছা থাকলে সরকার এসব বাধা অচিরেই দূর করে চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে পারতো।
ষাট দশকের পাহাড়ী ছাত্র সমিতির কর্মীরা ৫১ বছর আগে জীবনের অনেক রঙিন স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে সামিল করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্নভাষী জুম্ম জাতিসমূহের জনগণকে।
সরকার আজো জুম্ম জনগণকে পুনরায় দূরে ঠেলে দিয়ে মরণপণ সংগ্রামের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছেন। নব্বইয়ে গণআন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সামরিক শাসনের অবসান হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসনের অবসান হয়নি। যতদিন পর্যন্ত না শাসকগোষ্ঠী ঔপনিবেশিক চরিত্র পরিহার করবে, ততদিন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সুদূর পরাহত হয়ে থাকবে। তাই জুম্মদের অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিকামী জুম্ম জনগণের আন্দোলন সংগ্রাম করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। হয়তো সেদিন আর বেশী দূরে নয়, যেদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিজয়ের পতাকা মুক্তাকাশে উড়বে। সেই দিনের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র-জনতাকে আপোষহীন সংগ্রাম করে যেতে হবে। তখনই সার্থক হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সুবর্ণ জয়ন্তীর উদযাপন।