হিল ভয়েস, ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদন:আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম অবিস্মরণীয় সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব এবং অতুলনীয় এক স্বজাতিপ্রেমী ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান, যিনি আর এস দেওয়ান নামে সমধিক পরিচিত, তাঁর জন্মদিন। তিনি বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো ৯১ বছর। ১৯৩২ সালের এই দিনে (১৭ জানুয়ারি) পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান খাগড়াছড়ি সদরের খবংপজ্যা এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা রমেশ চন্দ্র দেওয়ান ও মাতা চন্দ্রমুখী দেওয়ান এর চার পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন ৬ষ্ঠ সন্তান। পারিবারিকভাবে তিনি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই কিংবদন্তী বিপ্লবী নেতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা) ও জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)-র আপন মামা। লারমাদের পিতা, তৎকালীন স্বদেশি আন্দোলনের সংগ্রামী, প্রগতিবাদী ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ চিত্ত কিশোর চাকমা ছিলেন আর এস দেওয়ানের একাধারে ভগ্নিপতী, শিক্ষক ও সংগ্রামী জীবনের আদর্শ অনুপ্রেরণা।
লন্ডন প্রবাসী ড. আর এস দেওয়ান ছিলেন আমৃত্যু পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আন্তর্জাতিক মুখপাত্র, আন্তর্জাতিক প্রচার আন্দোলনের অদম্য এক প্রচার যোদ্ধা এবং জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অন্যতম বরণীয়, অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় এক সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব। তাঁর জুম্ম জাতি ও জন্মভূমির প্রতি প্রেম এবং এর জন্য তাঁর সংগ্রাম ও ত্যাগ ছিল অতুলনীয়। তিনি জুম্ম জনগণের শোষণ মুক্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। চিন্তা-চেতনায় তিনি ছিলেন বিপ্লবী, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের সংগ্রামে ছিলেন আপোষহীন। তাঁর উত্তরসুরী সহযোদ্ধারা তাঁকে ‘পশ্চিমের উজ্বলতম তারা’, ‘জুম্ম জনগণের আন্তর্জাতিক দূত’, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের নিঃস্বার্থ মানবতাবাদী’, ‘সকলের অনুপেরণার উৎস’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছেন।
তাঁর বর্ণাঢ্য ছাত্রজীবনের প্রতিটি ধাপে তিনি একজন আদর্শবান মেধাবী ছাত্রের পরিচয় দেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় খাগড়াছড়ির খবংপজ্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়েই তিনি সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। মহাপূরম মিডল ইংলিশ স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে প্রথম হওয়ায় আবারও সরকারি বৃত্তি লাভ করেন তিনি। ১৯৫২ সালে তিনি রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে আইএসসিতেও তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে অনার্সসহ গ্র্যাজুয়েট হন তিনি। ১৯৬২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। এরপর তিনি ১৯৬৮ সালে লন্ডনে গিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন কুইন এলিজাবেথ কলেজে ভর্তি হন এবং চার বছর পর তাঁর এমফিল গবেষণা কর্ম সমাপ্ত করেন। এমফিল শেষ করার পর তিনি লন্ডনের বুশ বোয়াক অ্যালেন কোম্পানিতে ৬ বছর চাকুরিও করেন। পরে ১৯৮০ সালে তিনি রসায়নে লন্ডনের সালফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। এসময় তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল আদা, এলাচ ও পেঁয়াজের সুগন্ধি ও স্বাদবৈশিষ্ট্য। এই গবেষণায় তিনি সফলতা দেখাতে সক্ষম হন এবং তাঁকে পেঁয়াজের স্বাদবৈশিষ্ট্যের উপর একটি প্যাটেন্টও প্রদান করা হয়।
ভালো লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। এজন্য তিনি পাকিস্তান গোয়েন্দা বিভাগের কঠোর নজরদারির শিকার হন। চট্টগ্রামে অধ্যয়নকালে পাহাড়ী ছাত্র সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রাবস্থায়ই পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের জন্য আন্তর্জাতিক প্রচার কাজ করতে গণতন্ত্রের জন্মভূমি হিসেবে পরিচিত লন্ডনে যাওয়ার প্রতীজ্ঞা করেন তিনি। প্রায় একই উদ্দেশ্য নিয়ে যেমন ভিয়েতনামের হোচিমিন গিয়েছিলেন ফরাসী দেশে।
বস্তুত ১৯৭৪ সালে তৎকালীন সংসদ সদস্য হিসেবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা লন্ডন সফরে গেলে সেখানে মানবেন্দ্র লারমার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এসময় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আহ্বানে তিনি জুম্ম জনগণের আন্দোলনের জন্য আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযানে পুরোপুরি নিজেকে নিয়োজিত করার মনস্থ করেন এবং নিরলসভাবে এই কাজ চালিয়ে যান আমৃত্যু। এন্টি-স্লেভারি সোসাইটি, সার্ভাইভাল ইন্টারন্যাশনাল, অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল ও কোয়াকার পিস সার্ভিস ইত্যাদি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তায় তিনি তাঁর আন্তজার্তিক প্রচারাভিযান শুরু করেন। এব্যাপারে তাঁকে বিশেষভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন প্রথমাবস্থায় এন্টি-স্লেভারি সোসাইটির বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী পিটার ডেভিস এবং পরবর্তীতে তাঁর প্রচারকার্য আরও গুরুত্ব লাভ করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লর্ডসভার সদস্য লর্ড এভেবুরির সাহায্যে।
ড. আর এস দেওয়ানই প্রথম সত্তর ও আশির দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের নিপীড়নের বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরেন। সেই সময় সরকারি বাহিনীর দ্বারা জুম্মদের উপর নিপীড়নের খবর বহির্বিশ্বে পৌঁছানো ছিল কঠিন। এক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার একমাত্র উপায় ছিল আর এস দেওয়ানের প্রতিবেদন।
১৯৮২ সাল থেকেই তিনি জেনেভায় জাতিসংঘের বৈষম্য বিলোপ ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা বিষয়ক সাব-কমিশনের আওতায় ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ইন্ডিজেনাস পপুলেশন-এ অংশগ্রহণ করে আন্তর্জাতিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকারের বিষয়টি তুলে ধরেন। এশিয়া থেকে ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ইন্ডিজেনাস পপুলেশন-এ অংশগ্রহণকারী তিনিই প্রথম আদিবাসী ব্যক্তি।
১৯৮৬ সালে তিনি আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনে ড. আর এস দেওয়ানসহ জুম্ম প্রতিনিধি, জার্মানির ওলফগ্যাং মে, যুক্তরাজ্যের এন্ড্রু গ্রে ও নেদারল্যান্ডের জেনেকি অ্যারেন্স প্রমুখসহ এন্টি-স্লেভারি সোসাইটি, সার্ভাইভাল ইন্টারন্যাশনাল, অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল, পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রচারাভিযান সংক্রান্ত সাংগঠনিক কমিটি ও ইবগিয়া ইত্যাদি সংগঠনের প্রস্তাব অনুসারে একটি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক কমিশন গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক কমিশন পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ড. আর এস দেওয়ান নব্বই দশকের প্রথম দিকে জনসংহতি সমিতির পক্ষে আন্তর্জাতিক সংগঠন ইউএনপিও গঠনেও ভূমি রাখেন। তখন থেকে তিনি ইউএনপিও-তে নিয়মিত পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি বিষয়ে প্রতিবেদন পাঠাতেন। তাঁর আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে তিনি সাধারণ টাইপ-রাইটারে লিখে নিয়মিত ৩০০ জনকে তাঁর প্রতিবেদন পাঠিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করতেন।
২০২১ সালের ২৯ মার্চ যুক্তরাজ্যের ম্যানচেষ্টার শহরে নিজের এপার্টমেন্টে এক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৮৯ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন সততা, আন্তরিকতা, পরিশ্রম, নৈতিকতা, বিনয় ও মিতব্যয়িতার অধিকারী। লন্ডনের মত জায়গা ও সমাজে থেকেও তিনি অত্যন্ত সাধাসিধে জীবনযাপন করতেন। তিনি জুম্ম জনগণের স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার উপর নির্ভর করেই অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবন অতিবাহিত করতে এবং সেই অর্থেই জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের স্বপক্ষে তাঁর প্রচার আন্দোলন আমৃত্যু চালিয়ে যান। অপরের কল্যাণে এবং জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি অসাধারণ ত্যাগ ও সাহসের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
জুম্মদের অব্যাহত বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম এবং ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পশ্চাতে তাঁর ভূমিকা ও ত্যাগতিতিক্ষা অপরিসীম। কিন্তু দীর্ঘ ২৪ বছরেও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, জুম্মদের শোষণ মুক্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার তাঁর যে মহান স্বপ্ন সেই স্বপ্ন এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি। অথচ যুগ যুগ ধরে শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। বস্তুত জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ড. আর এস দেওয়ানের স্বপ্নের বাস্তবায়ন অপরিহার্য ও জরুরি।