হিল ভয়েস, ২৩ ডিসেম্বর ২০২২, রাঙ্গামাটি: পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি কেবল কাগুজে দলিল নয়, এটি জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব সংরক্ষণের রক্ষাকবচ।
আজ ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ রাঙ্গামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমি হলে আয়োজিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) উদ্যোগে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সন্তু লারমা একথা বলেন।
আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক নির্বাহী সদস্য নিরুপা দেওয়ান, কবি ও শিক্ষাবিদ শিশির চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি সুমন মারমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যা। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন পিসিপি’র দপ্তর সম্পাদক জিকো চাকমা এবং সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সহ সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন সহ সাংগঠনিক সম্পাদক সুপ্রীয় তঞ্চঙ্গ্যা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দীর্ঘ ২৫ বছর অতিক্রান্ত সময়ের প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান বাস্তবতায় ছাত্র সমাজের করণীয় কী সেটা বিশেষ করে উল্লেখ করার কোনো বিকল্প নেই। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে ছাত্রসমাজ শাসকগোষ্ঠীর দমনপীড়ন, আগ্রাসনের বিরদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে আসছে। ষাট দশকের সময়ে পাহাড়ী ছাত্র সমিতির পতাকা তলে সামিল হয়ে আন্দোলনের জোয়ার পার্বত্য চট্টগ্রামের জোয়ার দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছিল জুম্ম ছাত্র সমাজ। যে জোয়ারের সর্বশেষ ফলাফল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। এ চুক্তি শুধুমাত্র কাগুজে দলিল নয়। এটি জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব সংরক্ষণের রক্ষাকবচ।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান সময়ের ছাত্র সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। তারা নৈতিক দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছে। তারা শাসকগোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করার রাজনীতি করছে। তাছাড়া যাদের জন্য পার্বত্য চুক্তি তারাই চুক্তি ভুলতে বসেছে। যার ফলাফল সরকার দীর্ঘ ২৫ বছর অবহেলিত করে রেখেছে, পদদলিত করে চলেছে। তিনি অতীতের আন্দোলনের স্মৃতি রোমন্থন করে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে সামিল হওয়ার জন্য ছাত্র সমাজের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শিক্ষাবিদ শিশির চাকমা বলেন, শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদ হিসেবে প্রোপাগাণ্ডা চালাতো। কিন্তু আদতেই সেটি নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ নিজস্ব অস্তিত্বের জন্য, অধিকারের জন্য লড়াই করেছে, করে যাচ্ছে। অধিকার, অস্তিত্ব, আত্মপরিচয়ের জন্য হাজার হাজার মানুষ রক্ত দিয়েছে, আত্মবলিদান দিয়েছে। কিন্তু সরকার চুক্তিকে অবাস্তবায়িত রেখে সেসব শহীদদের ত্যাগকে পদদলিত করেছে। সেইজন্য ছাত্র সমাজকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ থেকে এই অসম্মানের জবাব দিতে হবে।
আরেক বিশেষ অতিথি নিরুপা দেওয়ান বলেন, একজন ছাত্র হিসেবে নিজেকে বিকাশ করার জন্য মনুষ্যত্ববোধে উত্তীর্ণ হতে হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতি করা উচিত। রাষ্ট্রের কাঠামো, সংবিধান, পার্বত্য চুক্তি নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। কেননা কেউই রাজনীতির বাইরে নয়। এভাবেই নিজেকে সমৃদ্ধ করা জরুরী। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে দায়ীত্বশীল জায়গায় থেকে প্রত্যেককে সোচ্চার থাকার আহ্বান জানান।
পিসিপির সভাপতি সুমন মারমা বলেন, বর্তমান ছাত্র সমাজ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন ধরনের নেশায় আসক্ত হয়ে ব্যাহত হচ্ছে তাদের মস্তিষ্কের সুষ্ঠু বিকাশ। যার দরুণ তারা সমাজকে, রাষ্ট্রকে ব্যাখ্যা করতে পারছে না। শাসকগোষ্ঠীর দমনপীড়নকেও বুঝতে পারছে না।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম ছাত্র সমাজকে অবশ্যই শাসকগোষ্ঠীর অব্যাহত শোষণ ও আগ্রাসনের বিরদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। দীর্ঘ যুগ ধরে চলে আসা আপোষহীন সংগ্রামকে নতুন করে চিনতে হবে। কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ব্যক্তি, সমাজের ও জাতির জন্য কোনো সুফল বয়ে আনা সম্ভব নয়।
আলোচনা সভার পরে আমন্ত্রিত অতিথিরা রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। এবারের রচনা প্রতিযোগিতায় বিদ্যালয় ক্যাটাগরিতে প্রথম হন প্রাণময় চাকমা, বরকল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, দ্বিতীয় হন শুভ চাকমা, সারবো তলী উচ্চ বিদ্যালয়, তৃতীয় হন প্রিয়া বিশ্বাস, রাণী দয়াময়ী উচ্চ বিদ্যালয়। কলেজ ক্যাটাগরিতে প্রথম হন হ্লামংচিং মারমা, ঢাকা স্টেট কলেজ, দ্বিতীয় হন মুন্নি চাকমা, রাঙ্গামাটি সরকারি মহিলা কলেজ, তৃতীয় হন নিকো চাকমা, শিজক কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাটাগরিতে প্রথম হন নুথোয়াই মারমা বারাঙ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় হন স্বরূপ চাকমা, রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ, তৃতীয় হন উশৈহ্লা মারমা, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।