হিল ভয়েস, ১০ নভেম্বর ২০২২, রাঙ্গামাটি: মহান বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে মরতে শিখিয়েছেন। তাই তারা বাঁচতেও শিখেছে। সকল ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ পার্বত্য অঞ্চল থেকে যে মহান নেতা এম এন লারমার আবির্ভাব ঘটেছে, সেই পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ কখনো অন্যায়ের কাছে, নিপীড়কের কাছে মাথা নত করবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সাংসদ এম এন লারমার ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত স্মরণ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গৌতম কুমার চাকমা এই দৃঢ় মত তুলে ধরেন।
‘১০ই নভেম্বর’ ৮৩ অমর হোক’, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করুন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ুন- এই আহ্বানকে রেখে আজ বৃহস্তপতিবার (১০ নভেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার উদ্যোগে রাঙ্গামাটি শিল্পকলা একাডেমিতে এই স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে রাঙ্গামাটি শিল্পকলা একাডেমী থেকে র্যালী শুরু হয়ে বনরূপা পেট্রোল পাম্প ঘুরে এসে আবার শিল্পকলা একাডেমিতে এসে শেষ হয়। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এম এন লারমার অস্থায়ী বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি ডা: গঙ্গা মানিক চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত স্মরণ সভায় বিশেষ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের চট্টগ্রাম অঞ্চল শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা, সি.এইচ.টি হেডম্যান নেটওয়ার্কের সহ-সভাপতি এড. ভবতোষ দেওয়ান, পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক আশিকা চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি সুমন মারমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর ত্রিপুরা নান্টু, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যা।
স্মরণ সভায় শোক প্রস্তাব পাঠ করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নগেন্দ্র চাকমা এবং সভা পরিচালনা করেন জুয়েল চাকমা।
প্রধান অতিথি বক্তব্যে গৌতম কুমার চাকমা বলেন, মহান নেতা এম এন লারমা যখন নির্বাচন করছিলেন, তখন আমার দায়িত্ব পড়ে দিঘীনালা থানায়। উনি কয়েকজনকে চিঠি লিখে দিয়েছিলেন, আমি তাদের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি সেসময় যাদের অনুরোধ করেছিলেন, তারা কোনোদিন কেউ না করেননি। সবাই এগিয়ে এসেছিলেন। সুতরাং, তাঁর যে গ্রহনযোগ্যতা, তাঁর প্রতি মানুষের যে শ্রদ্ধা, সম্মান সেটা ছিল অভাবনীয়। সে নির্বাচনে তিনি জিতে গেলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে মহান নেতা এম এন লারমা এবং তাঁর অনুজ বর্তমান জনসংহতি সমিতির বর্তমান সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার সাথে আমরা একসাথে কাজ করেছিলাম। আমি দেখেছি, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছিলেন একজন পরিপক্ক পরিকল্পনাকারী। তাঁর জ্ঞানের ভান্ডার ছিল অসীম। অভিজ্ঞতা ছিল অনেক আর দূরদর্শিতাও ছিল প্রচুর। লক্ষ্য সম্পর্কে তার ধারণা ছিল সঠিক। কাজেই তিনি একজন সঠিক পরিকল্পনাকারী ছিলেন। আর বর্তমান নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ছিলেন একজন দক্ষ পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী। সুতরাং, তারা দুই ভাইয়ে ছিলেন অবিচ্ছেদ্য এবং পরিপূর্ণ।
তিনি আরো বলেন, সাম্প্রতিক কয়েক বছর আগে কুকি চিন ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশান নামে বমদের যে একটি সংগঠন তৈরী হয়েছিল, সে সংগঠন তৈরীর পেছনে একজন সরকারি কর্মকর্তা ও বেসরকারি কয়েকটি সংস্থার হাত রয়েছে বলে জানা যায়। এবং বমদের সেই সংগঠনের নেতারা রাতারাতি সশস্ত্র সংগঠন তৈরী করে তারা স্বাধীনতার জন্য কাজ করছে! এটা খুব আশ্চর্যের বিষয়। তাদের পেছনে কারা আছে? যারা এতদিন ছিল অক্ষম এবং ভিতু, আর তারা এত তারাতাড়ি সাহসী হয়ে উঠল। এটা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য বড় আশংকার।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে শান্ত করবার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ কখনো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে না। সে মধ্যম আয়ের দেশ অথবা উন্নত দেশ হতে পারবে না। সেজন্য বিগত সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনায় বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের যে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা আছে, সেটার সাথে সংগতি রেখে তারা পরিকল্পনা করেছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের কথা তারা লিখেছে। আজ যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত হয়ে ওঠে, এটা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য নয়, সারা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য এবং সরকারের জন্য উদ্বেগের বিষয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রধানমন্ত্রী বার বার অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও এবং চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালের ১লা জানুয়ারি জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার সাথে তিনি বৈঠক করেছিলেন। তার পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে সেনা সদর দপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে একটা চিঠি যায় অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পগুলো তুলে নেওয়ার জন্য। অথচ যে ক্যাম্পগুলো তুলে নেওয়া হয়েছিল, সে স্থলে এখন এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপন করার কাজ চলছে, যেটা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ঘ খন্ডের ১৭ (ক) ধারার পরিপন্থী। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্যে করে তিনি বলেন, আপনি যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন চান, পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি উন্নতি চান, তাহলে বান্দরবান পার্বত্য জেলার সাম্প্রতিককালে যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, যে ঘটনাগুলো ঘটছে, এগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা বলেন, আমরা যদি এম এন লারমার ভাবনাকে শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি, তাহলে তাঁর সেই চেতনাকে অন্তরে ধারণ করতে হবে। আসুন সেটাকে আমরা কাজে লাগাই। তাঁর চিন্তা-চেতনা ও আদর্শকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিই।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের চট্টগ্রাম অঞ্চল শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা বলেন, জুম্ম জনগণ এবং এদেশকে নিয়ে এম এন লারমার সুগভীর ভাবনা ছিল। আজকে তাঁর সংগ্রাম ও স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়ন করতে গেলে আমাদেরকে আরো পরিশ্রমী হতে হবে, আমাদেরকে আরো একাগ্রতা নিয়ে কাজ করতে হবে এবং তাঁর সমৃদ্ধ যে সংগ্রামী চেতনা, তাঁর যে রাজনৈতিক দর্শন, তাঁর যে জীবন সংগ্রাম সেটা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্কের সহ-সভাপতি ভবতোষ দেওয়ান বলেন, আমরা যদি জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে যে যেই অবস্থানে থাকিনা কেন, স্ব স্ব অবস্থান থেকে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে, মহান নেতা এন এম লারমা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গা বলেন, এম এন লারমার সূচিত সংগ্রামের ফসল হিসেবে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। আজ সেই চুক্তির দীর্ঘ ২৫ বছর পূর্ণ হতে চললেও চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত হয়নি। সেই চুক্তি বাস্তবায়নে এম এন লারমার নীতি-আদর্শকে ধারণ করে দুর্বার আন্দোলনে সামিল হতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর ত্রিপুরা নান্টু বলেন, যাঁর চেতনায় আমরা অধিকারের স্বপ্ন দেখি, আমাদের ওপর ঘটে যাওয়া নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস পাই, তিনি হচ্ছেন মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তাঁর আদর্শকে বুকে ধারন করে আজকের ছাত্র-যুব সমাজ তথা জুম্ম জনগণকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি সুমন মারমা বলেন, আজ মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার যে স্বপ্ন, তাঁর যে আদর্শ, তাঁর যে চিন্তা ভাবনা সেগুলো আমরা এখনো সমাজের সকল স্তরে পৌঁছে দিতে পারিনি। জুম্ম ছাত্র-যুবসহ সমাজের সর্বস্তরের জুম্ম জনগণকে এম এন লারমার চিন্তা ও আদর্শ ধারণ করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক আশিকা চাকমা বলেন, মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা শুধুমাত্র পাহাড়ের মানুষগুলোর স্বার্থ চিন্তা করেননি। তিনি বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল মেহনতি মানুষের কথা চিন্তা করেছিলেন। নারী মুক্তির প্রশ্নে তিনি সদা সোচ্চার ছিলেন। আমাদের সবাইকে এম এন লারমার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হবে।