লামায় তিন গ্রামের আদিবাসীদের ভূমি রক্ষার দাবিতে চট্টগ্রাম নাগরিক সমাজের স্মারকলিপি

হিল ভয়েস, ২০ অক্টোবর ২০২২, বান্দরবান: বান্দরবান জেলাধীন লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রো পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া ও রেংয়েন ম্রো পাড়ার স্থানীয় আদিবাসীদের ভূমি অধিকার সুরক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) সৈয়দা সারওয়ার জাহানকে স্মারকলিপি দিয়েছেন চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

গতকাল ১৯ অক্টোবর ২০২২ চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর এলাকায় বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের কার্যালয়ে চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করে এই স্মারকলিপি দেয়া হয়। রাবার বোর্ডের চেয়ারম্যান স্মারকলিপিটি গ্রহণ করেন।

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি দলে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক মোস্তফা কামাল যাত্রা, পরিবেশ আন্দোলন এর সংগঠক শরীফ চৌহান, শিল্পী আলোকময় তলাপত্র ও সাংবাদিক সৌমেন ধর প্রমুখ।

এসময় প্রতিনিধি দলের নেতৃবৃন্দ সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রো পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া এবং রেংয়েন ম্রো পাড়ার বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে রাবার বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন।

স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল ‘লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ নামের একটি রাবার কোম্পানি ও স্থানীয় ভূমিদস্যু মহল কর্তৃক বান্দরবান পার্বত্য জেলার লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ডলুছড়ি মৌজার লাংকম ম্রো পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া এবং রেংয়েন ম্রো পাড়ার আদিবাসীদের প্রায় ১০০ একর জুম ভূমি, ফলজ বাগান ও প্রাকৃতিক বন পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রায় নি:স্ব হয়ে পড়েছেন। এ বিষয়ে সকল জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ হয়েছে। তারপরও ভূমিদস্যুদের অপতৎপরতা বন্ধ হয়নি।

স্মারকলিপিতে আরো বলা হয়, গত ৬ সেপ্টেম্বর রেংয়েন ম্রো পাড়ার বাসিন্দাদের একমাত্র পানির উৎসে বিষ প্রয়োগ করে ওই কোম্পানির শ্রমিকরা। এরপর ২৪ সেপ্টেম্বর কোম্পানির শ্রমিকরা রেং ইয়ুং ম্রো’র লাগানো ৩০০ কলা গাছ কেটে দেয়। ফলে স্থানীয় অধিবাসীরা জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত অবস্থায় আছেন।

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা রাবার বোর্ডের চেয়ারম্যানকে জানান, সম্প্রতি সারাদেশের নাগরিক সমাজের উদ্যোগে স্থানীয় আদিবাসীদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য সেখানে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাঁশ-কাঠ-টিনসহ স্থানীয় উপকরণ দিয়ে সেখানকার বাসিন্দারা নিজস্ব শ্রমে স্কুলটির নির্মাণ কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। এ অবস্থায় গত ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের সচিব স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে ‘লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ এর ডলুছড়ি মৌজায় নতুন প্ল্যান্টেশনের কাজ শুরুর ব্যবস্থা এবং জরুরী ভিত্তিতে অবৈধভাবে জোরপূর্বক নির্মাণাধীন স্থাপনাসহ অন্যান্য স্থাপনা বিষয়ে’ একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়।

নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ সাক্ষাতকালে বলেন, এই বিজ্ঞপ্তি অগ্রহণযোগ্য। এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি প্রকারান্তরে ভূমিদস্যু ও রাবার কোম্পানির অপকর্মকে বৈধতা দেয়ার নামান্তর। পাশাপাশি এটি স্থানীয় বাসিন্দাদের ভূমি অধিকার হরণের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে উঠবে। নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের দেয়া একটি ভিত্তিহীন অভিযোগের ভিত্তিতে এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি জারির বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) সৈয়দা সারওয়ার জাহান নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি দলের বক্তব্য শোনেন। তিনি বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বান্দরবানের জেলা প্রশাসক মহোদয়কে বলা হয়েছে। তিনি পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান।

উল্লেখ্য, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর কর্তৃপক্ষ ভাড়াটে ভূমিদস্যুদের দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লামার সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রো কার্বারি পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা কার্বারি পাড়া এবং রেংয়েন ম্রো কার্বারি পাড়ার আদিবাসীদের অবশিষ্ট ৪০০ একর জুমের বাগান এবং ভূমি বেদখল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে দীর্ঘ দিনের অভিযোগ রয়েছে। এই অবস্থায় ম্রো ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত এই তিন আদিবাসী গ্রামের ৩৯টি পরিবারের ২০০ নারী-পুরুষ এখন উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছেন।

গ্রাসবাসীরা জানান, তাদের গ্রামের প্রায় ৪০০ একর ভূমিতে তারা বংশপরম্পরায় জুমচাষ ও বাগান-বাগিচা করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কিন্তু ২০১৯ সালে হঠাৎ লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজ নামের একটি কোম্পানি রাবার প্লটের নামে জুম্মদের ঐসব ভূমি দখলে নেয়ার অপচেষ্টা শুরু করে।

ইতোপূর্বে সরই ইউনিয়নের ডলুছড়ি মৌজার নতুন পাড়া, ঢেঁকিছড়া পাড়া ও নোয়া পাড়ায় লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড ইজারার নামে ১,৬০০ একর জায়গা দখল করে। এর ফলে এলাকার তিনটি গ্রামের শত শত পরিবার ম্রো গ্রামবাসী উচ্ছেদের হুমকির মধ্যে রয়েছে।

More From Author