হিল ভয়েস, ১২ অক্টোবর ২০২২, ঢাকা: বান্দরবানের লামা উপজেলায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কর্তৃক ৩৯টি ম্রো পরিবারকে তাদের ভূমি থেকে বিতারিত ও উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে তাদের জুমের ফসল পুড়িয়ে দেয়া, পানির একমাত্র উৎস ঝিঁড়ির পানিতে বিষ মিশিয়ে দেয়া, কোম্পানীর পেটোয়া বাহিনীর দ্বারা মারধর করার ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। সর্বশেষ গত ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখে এক ম্রো আদিবাসীর ৩০০ কলাগাছ কেটে ফেলাসহ মানবাধিকার লংঘনের নানা ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে দেশের ৩৬ জন বিশিষ্ট নাগরিক ও অধিকার কর্মী। আজ বুধকার এক বিবৃতিতে এসব ঘটনার ধারাবাহিকতায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের অনেকের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মিথ্যা মামলা করার বে-আইনী ও অমানবিক তৎপরতায় উদ্বেগও প্রকাশ করছে উক্ত নাগরিকরা। আর এসব তৎপরতায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় এনে তাঁদের কঠোর শাস্তির দাবি করেন নাগরিকেরা।
বিবৃতিতে বলা হয় যে, গত ২৭ এপ্রিল, ২০২২-এ বান্দরবানের লামা উপজেলার লাংকম পাড়া, জয় চন্দ্র কারবারী পাড়া ও রেংয়েন কারবারী পাড়ার আদিবাসীদের সৃজিত জুমের বাগান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এই আগুনে প্রায় একশ একর জুমের ধান, বাঁশ, আম, কলা, আনারসসহ বিভিন্ন ফলদ ও বনজ গাছ পুড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত পাড়াগুলোর আদিবাসীদের অভিযোগ, জমি দখলের জন্য লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি কোম্পানীর লোকজন তাদের ফসলে পরিকল্পিতভাবে এই আগুন লাগিয়েছে। এ বিষয়ে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালকে প্রধান করে গঠিত ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। সে কমিটি লীজ বাতিলসহ ৬ দফা সুপারিশ দিলেও তা কার্যকর করা হয়নি। বরং গত ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২-এ আদিবাসীদের পানির একমাত্র উৎস পাহাড়ী ঝিঁড়ির পানিতে বিষ মেশানো হয়। ফলশ্রুতিতে আদিবাসীরা বর্তমানে এ ঝিঁরির পানি পান করতে পারছে না।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও এখন পর্যন্ত প্রশাসন অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি উল্লেখ করে নাগরিকরা বিবৃতিতে আরো বলেন, কোম্পানীর (লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ) লোকেরা ১ সেপ্টেম্বর ২০২২-এ লাংকম ম্রোসহ চার জন ম্রো আদিবাসীর চাষকৃত ক্ষেত থেকে ২৫ মণের অধিক মিষ্টি কুমড়া লুট করে নিয়ে যায় এবং সর্বশেষ ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২-এ রেং ইয়ুং ম্রোর বাগানে রোপণ করা ৩০০ টি কলাগাছ কেটে দেয়। ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীগণ থানায় মামলা পর্যন্ত করতে ভয় পান, কারণ পুলিশ বা প্রশাসন এতোগুলো ঘটনার বিষয়ে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। আদিবাসীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত আদিবাসীদের গ্রেফতার করতে পুলিশ বেশ তৎপরতা দেখালেও লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর বিরুদ্ধে অভিযোগের ক্ষেত্রে তারা কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আদিবাসীদের জমি দখলমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি; বরং পরিবার প্রতি মাত্র পাঁচ একর জায়গা নিয়ে বাকী জায়গা রাবার কোম্পানীকে ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল আদিবাসীরা সঙ্গত কারণেই এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিবৃতিতে নাগরিকরা আরো বলেন, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড দাবি করেছে তাদের নামে ১৬০০ একর সম্পত্তি লীজ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার চেয়েও অনেক বেশী ভূমি তারা দখলে রেখেছে যা সাধারণ পরিদর্শনেই স্পষ্ট বলেও মনে করেন নাগরিকরা।
বিবৃতিদাতারা আরো বলেন, প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেডের মোট অংশিদারের সংখ্যা ৬৪ জন যা কোম্পানী আইন, ১৯৯৪ এবং Office of the Registrar of Joint Stock Companies and Firms (RJSC) এর কোম্পানীর নিবন্ধন সংক্রান্ত নীতিমালার লঙ্ঘন। বান্দরবন জেলা পরিষদের গঠিত কমিটির ২৯ মে, ২০২২ তারিখের রিপোর্টে লীজকৃত জমিতে ২৫ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও কোন প্রকার রাবার রোপণ করা হয়নি উল্লেখ করে লীজ বাতিলের যে সুপারিশ করেছে তা এখনো প্রতিপালিত হয়নি। ৬৪ জন শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পূর্বে বান্দরবন জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনিক উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ছিলেন। ফলে লীজ পাওয়ার ক্ষেত্রে স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়টি স্পষ্ট। শুধু তাই নয়, এদের মধ্যে কয়েকজনের পরিবারের একাধিক সদস্য ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে ২৫ একর করে ভূমি লীজ পেয়েছেন। সরকারী দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কি বিবেচনায় তারা এ সম্পত্তি লীজ পেয়েছেন তা বোধগম্য নয়। বরং এমন বরাদ্দ ক্ষমতার অপব্যবহার, বে-আইনী বলেও মনে করেন বিবৃতিদাতারা।
বিবৃতিদাতাগণ আদিবাসীদের সংবিধান ও আইন স্বীকৃত অধিকারের এবং লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও প্রশাসন কর্তৃক তাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থতার ও হয়রানীর ঘটনার তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানান। বিবৃতিদাতাগণ নিম্নোক্ত ৩টি দাবি তুলে ধরেছেন-
১. ম্রো এবং ত্রিপুরা আদিবাসীদের ভূমিসহ সকল আইনি ও প্রথাগত অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত উদ্দেশ্য প্রনোদিত ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
২. প্রতারণামূলকভাবে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে নেয়া লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের লীজ বাতিল করতে হবে। এ লীজ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
৩. লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কর্তৃক যে সকল অপরাধমূলক কর্মকান্ড করা হয়েছে তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা হলেন, বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল, নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশী কবির, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যোলয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাণা দাশগুপ্ত, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবি এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সভাপতি ও বিশিষ্ট আইনজীবি অ্যাড. জেড আই খান পান্না, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সহ-সভাপতি ও আইনজীবি এডভোকেট তবারক হোসেইন, বিশিষ্ট অর্নীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত, এসোসিয়েশ ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি)’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, রিব এর নির্বাহী পরিচালক ড. মেঘনা গুহ ঠাকুরতা, নির্বাহী পরিচালক, কবি ও লেখক রাহনুমা আহমেদ, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং রিসার্স ফেলো ড. স্বপন আদনান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, আলোকচিত্রী ও সমাজকর্মী ড. শহিদুল আলম, নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন, নির্বাহী পরিচালক, বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাবি’র আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজিম উদ্দিন খান, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিনা লৎফা, কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, মানবাধিকার কর্মী মো. নুর খান লিটন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খাইরুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবি এড. পারভেজ হাসিম, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন কণা, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব, মানবাধিকার কর্মী ও সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ফারহা তানজীন তিতিল, আদিবাসী অধিকার কর্মী লেলুং খুমি, আদিবাসী অধিকার কর্মী হানা শামস্ আহমেদ, আলোকচিত্রী মাহমুদ রহমান প্রমুখ।