হিল ভয়েস, ৭ অক্টোবর ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: রেংক্ষ্যং ভ্যালীকে কেন্দ্র করে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি এবং বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলায় এখনো বিলাইছড়ি, রোয়াংছড়ি, রুমা ও বান্দরবান জোনের শত শত সেনা সদস্য কর্তৃক ব্যাপক কম্বিং অপারেশন অব্যাহতভাবে চলছে। গত ৩ অক্টোবর থেকে এই কম্বিং অপারেশন শুরু হয়েছে এবং এই কম্বিং অপারেশনে চারটি সেনা জোন থেকে যথাক্রমে বিলাইছড়ি জোন কমান্ডার লেঃ কর্ণেল মোঃ আহসান হাবীব রাজব, পিপিএম, পিএসসি; রুমা জোনের জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসান শাহরিয়ার ইকবাল এবং বান্দরবান সদর জোন কমান্ডার লে: কর্ণেল মো: মাহমুদুল হাসান, পিএসসি, প্রমুখ জোন কম্যান্ডারের নেতৃত্বে আনুমানিক ৮০০ থেকে ১০০০-এর মতো সেনা সদস্য অংশগ্রহণ করেছে।
কেবল বিলাইছড়ি জোন থেকে কমপক্ষে ২০০ জন সেনা সদস্য এই অপারেশনে নেমেছে। আজ থেকে জুরাছড়ি জোন থেকেও সেনা সদস্যরা এই কম্বিং অপারেশনে যোগ দেবে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। জুরাছড়ি উপজেলাধীন বনযোগীছড়া জোনের অধীনে লুলাংছড়িতে স্থাপিত নতুন ক্যাম্প থেকে এই অপারেশন শুরু হওয়ার কথা শোনা গিয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে।
সেনাবাহিনীর এই কম্বিং অপারেশনের একটি নাম দেয়া হয়েছে বলে বিশ্বস্থ সূত্রে জানা গেছে। তবে এখনো নামটি জানা যায়নি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, এই কম্বিং অপারেশন বিলাইছড়ি, রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলা- এই তিনটা উপজেলায় পরিচালিত হলেও, অপারেশনের প্রধান টার্গেট হচ্ছে বিলাইছড়ি উপজেলার বড়তলী ইউনিয়ন। অপরদিকে রুমা এবং রোয়াংছড়ির যেসমস্ত এলাকাগুলোতে অপারেশন হচ্ছে, সেগুলোও মূলত বিলাইছড়ির বড়তলী ইউনিয়নের সাথে লাগোয়া সীমান্তবর্তী এলাকা।
বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের গ্রামগুলোর বাইরে রুমা উপজেলার বগালেক, সুনসং পাড়া, আর্থাপাড়া, কামতাম পাড়া, মন্নুয়াম পাড়া এবং রোয়াংছড়ি উপজেলার রনিনপাড়া, শুক্রমণি পাড়া, শঙ্খমণি পাড়া সংলগ্ন এলাকায় অপারেশন চলছে।
যে সমস্ত এলাকায় বা জুম্ম গ্রামে কম্বিং অপারেশনটি পরিচালিত হচ্ছে তা মূলত রামেত্তং মোন’কে (বড় পাহাড়) কেন্দ্র করে। রামেত্তং মোনটির পশ্চিম এবং উত্তর পশ্চিমে রোয়াংছড়ি, পূর্ব ও উত্তর-পূর্বে এবং দক্ষিণ-পূর্বে বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে রুমা উপজেলা অবস্থিত।
মূলত মন্দিরছড়া থেকে ট্রাই-জংশন (ভারত-বাংলাদেশ-বার্মার ত্রিসীমানা) পর্যন্ত রেইংখ্যং উপত্যকা ঘিরেই কম্বিং অপারেশনটি পরিচালিত হচ্ছে। অপারেশনের লক্ষ্য হচ্ছে বমপার্টি খ্যাত কুকি-চিন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্য উক্ত এলাকাটি মুক্তাঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া। এজন্য কম্বিং অপারেশনে সেনাবাহিনীর সাথে বমপার্টির সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা অংশগ্রহণ করেছে।
সেনাবাহিনী ও বমপার্টি কর্তৃক যৌথভাবে এই অপারেশন চালানোর জন্য ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ রুমা সেনা জোনে বমপার্টি ও রুমা জোন কম্যান্ডার লে: কর্ণেল হাসান শাহরিয়ার ইকবারের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর মধ্যে এক গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বমপার্টির প্রতিনিধি হিসেবে উক্ত বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন সাম্পা বম। ৬ অক্টোবর ২০২২-এর মধ্যে জনসংহতি সমিতির সদস্যদের লাশ দেখতে চায় বলে সেই বৈঠকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বমপার্টিকে নির্দেশ দেয়া হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, সেনাবাহিনীর বিলাইছড়ির জোনের অধীন ৩২ বীর-এর ১২০ জনের একটি সেনাদল গতকাল ৬ সেপ্টেম্বর বড়থলি ইউনিয়নের রায়মংছড়া থেকে বৈরাক্যেছড়া পর্যন্ত এলাকায় অপারেশন চালিয়েছে। সেই গ্রুপটি আজ মিটিঙ্গ্যাছড়ির দিকে অপারেশন পরিচালনা করতে পারে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
উল্লেখ্য যে, গত ৩ অক্টোবর এই সেনাদলটি তাংকৈতাঙ থেকে রায়মংছড়াতে এসে অবস্থান নেয়। এসময় সেনারা রায়মংছড়ার নিবাসী দুইজন গ্রামবাসীকে মারধর করেছে বলে জানা গেছে। তবে তাদের নাম ও পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে রুমা সেনাজোনের ২৮ বীর-এর অধীনে ১৫০ জনের একটি সেনাদল গতকাল ৬ সেপ্টেম্বর বড়থলি ইউনিয়নের গঙ্গাছড়ায় অপারেশন করেছে। সেখান থেকে ৪০ জনের একটি দল হেইঙ্গ্যোছড়ায় গেছে। সেনাবাহিনী জিনিসপত্র ও সাজ-সরঞ্জাম বহনের জন্য গঙ্গাছড়া থেকে ৪০ জন সাধারণ তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসীকে তাদের সাথে নিয়েছে।
আরো জানা গেছে যে, বান্দরবান সেনাজোন থেকে আসা ২০০ জনের সেনাদলটির একটি অংশ বর্তমানে রোয়াংছড়ি উপজেলার রনিনপাড়াতে অবস্থান করছে। সেখানে জোন কমান্ডার স্বয়ং রয়েছেন। অপর একটি অংশ বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়া ও এর আশেপাশের এলাকায় অপারেশন চালাচ্ছে।
রুমা উপজেলার বগালেক, ধূপ্পানিছড়া ও সংলগ্ন এলাকায়ও অপারেশন চলছে। তবে এসব এলাকায় অপারেশনের বিস্তারিত আপডেট এখনও পাওয়া যায়নি।
অপারেশনে বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অংশগ্রহণ:
৩ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া কম্বিং অপারেশনে সেনাবাহিনীর প্রত্যেকটি গ্রুপের সাথে বমপার্টির ৭ জন করে সশস্ত্র সন্ত্রাসী অংশগ্রহণ করেছে বলে বিশ্বস্থ সূত্রে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, ৩ অক্টোবর বমপার্টি খ্যাত কুকি-চিন দলের সভাপতি নাথান বম চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন এবং তার পরিবারের সাথে মিলিত হয়েছেন। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ফিরে আসার সময় ৩০ লক্ষ টাকা নিয়ে ফিরে আসেন বলে জানা গেছে। টাকাগুলো চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে গ্রহণ করা হয়। তিনি বান্দরবানে পৌঁছার পর গেৎসমানি পাড়ার সাংপুই বম মোটর সাইকেলে করে রোয়াংছড়ি-রুমার রাস্তা হয়ে দেবতা পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসেন।
অপরদিকে সেনাবাহিনীর কম্বিং অপারেশন উপলক্ষে গত ৫ অক্টোবর রোয়াংছড়ির রোনিন পাড়ায় বমপার্টি সদস্য এবং স্থানীয় সেনা সদস্যদের নিয়ে গরু কেটে ভোজের আয়োজন করে কুকি-চিন দলটি। গরুটি বাকিতে রোয়াংছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও দুর্নিবার পাড়াবাসী আসেন বম (মেম্বার)-এর কাছ থেকে নেয়া হয়।
গরুটার দাম ৪০ হাজার টাকা। গরুটির বকেয়া দাম পরিশোধ করার জন্য প্রতিটি বম পাড়া থেকে বমপার্টির লোকেরা চাঁদা সংগ্রহ শুরু হয়েছে। বান্দরবান-রোয়াংছড়ি ডিভিশনকে ১৫ হাজার টাকা, রুমা ডিভিশনকে ১৫ হাজার টাকা এবং রেমাক্রী ডিভিশনকে (থানচিসহ) ১৫ হাজার টাকা চাঁদা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সংগৃহিত ৪৫ হাজার টাকা থেকে ৪০ হাজার টাকা পরিশোধের পর অবশিষ্ট ৫ হাজার টাকা চা-পানীয় খরচের জন্য রাখা হবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়। এ নিয়ে সাধারণ বম গ্রামবাসীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমান বমপার্টি খ্যাত কেএনএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা রোয়াংছড়ি উপজেলার রণিন পাড়া সেনা ক্যাম্পের পাশে অনেকটা সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা আওতায় অবস্থান করছে। এর আগে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের অন্তর্গত কুকি মৌন নামে খ্যাত রাংতালাং পাহাড়ে বম পার্টি তাদের ক্যাম্প ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছিল।
কিন্তু গত ৭ জুন ২০২২ প্রতিপক্ষ গ্রুপের অতর্কিত হামলায় বম পার্টি ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়। এতে বম পার্টির ১৫/১৬ জন সশস্ত্র সদস্য ঘটনাস্থলে নিহত হয় এবং আরো কয়েকজন গুরুতর আহত হয় বলে জানা যায়।
সেই আক্রমণে বম পার্টি সদস্যরা এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে যে, আস্তানায় মজুদকৃত তাদের অস্থায়ী ব্যারাকের ঝুপড়ি, খাদ্যশস্য, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী, কাপড়-চোপড় ইত্যাদি এলোপাতাড়ি ফেলে রেখে রুমার দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।