হিল ভয়েস, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, বান্দরবান: বান্দরবান পার্বত্য জেলাধীন রোয়াংছড়ি উপজেলা সদর এলাকায় স্থানীয় সেনা ও উপজেলা প্রশাসন এবং আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ কর্তৃক স্থানীয় মারমা অধিবাসীদের শ্মশানভূমি জবরদখল করে তাতে ১৭টি নও (নব) মুসলিম ত্রিপুরা পরিবারের জন্য বাড়ি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেনা ও উপজেলা প্রশাসন সরকারের আশ্রায়ন প্রকল্পের আওতায় নও মুসলিম ত্রিপুরা পরিবারগুলোর জন্য এই বাড়ি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায়।
স্থানীয় জনগণ প্রশাসনের এই উদ্যোগের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা প্রশাসন ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের এই উদ্যোগকে ‘ষড়যন্ত্রমূলক এবং আদিবাসী জুম্মদের ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণে একটি উস্কানিমূলক পদক্ষেপ’ বলে অভিহিত করেছেন।
স্থানীয় জনগণ উক্ত উদ্যোগের প্রতিবাদ জানালে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রথাগত নেতৃবৃন্দ সেনাবাহিনীর হয়রানির শিকার হন বলেও জানা যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি রোয়াংছড়ি সেনা ক্যাম্প, রোয়াংছড়ি উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ রোয়াংছড়ি সদর এলাকার স্থানীয় মারমাদের শ্মশানের জায়গায় ১৭টি নও মুসলিম ত্রিপুরা পরিবারের জন্য বাড়ি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। মারমাদের শ্মশানের পাশেই রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের রোয়াংছড়ি কেন্দ্রীয় শ্যামা হরি মন্দির।
বিষয়টি জানার পর গত ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২ সকালে স্থানীয় মারমা অধিবাসীরা কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে তাদের শ্মশান এলাকাটি ঘেরাও করেন বলে জানা যায়। স্থানীয় মারমাদের কর্তৃক শ্মশান এলাকায় বেড়া দেয়ার খবর পাওয়ার পরপরই একই দিন রোয়াংছড়ি সেনা ক্যাম্পের কম্যান্ডার মেজর ফরহাদ রোয়াংছড়ি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আথুইমং মারমা, রোয়াংছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেইহ্লাঅং মারমা, রোয়াংছড়ি মৌজার হেডম্যান ও ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার অংশৈচিং মারমাকে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে যান।
এসময় মেজর ফরহাদ উক্ত নেতৃবৃন্দকে শ্মশানের জায়গায় কার নেতৃত্বে কাঁটা তার দিয়ে ঘেরাও করা হয়েছে সে ব্যাপারে জানতে চান এবং বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদ করেন বলে জানা যায়। এসময় জনপ্রতিনিধিদেরকে ক্যাম্পে আটকে রাখা হয় এবং ক্যাম্প কম্যান্ডার ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার অংশৈচিং মারমাকে শ্মশানের কাঁটা তারের বেড়া খুলে ফেলতে ক্যাম্প থেকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে দেন।
জানা গেছে, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান, রোয়াংছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও রোয়াংছড়ি মৌজার হেডম্যানকে অনেক রাত পর্যন্ত হয়রানিমূলকভাবে ক্যাম্পে আটক রাখা হয়। শ্মশানের কাঁটা তারের বেড়া খুলে ফেলার খবর পাওয়ার পর রাতে উক্ত তিনজনকে ছেড়ে দেয়া হয়।
জানা গেছে, গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখও বান্দরবান সেনা জোন থেকে রোয়াংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও হেডম্যানকে ডেকে পাঠানো হয়।
জানা গেছে, প্রথমে রোয়াংছড়ি সেনা ক্যাম্পের কম্যান্ডার মেজর ফরহাদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মারমাদের শ্মশানভূমি দখলের উদ্দেশ্যে হেডম্যানের কাছ থেকে জোর করে ‘খাস জমি’র অজুহাতে শ্মশানভূমি ছেড়ে দিতে সম্মতি আদায় করেন। এরপর মেজর ফরহাদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অন্যান্যদের নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে সরকারি উদ্যোগের কথা বলে শ্মশানের জায়গা দখলের প্রক্রিয়া শুরু করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় মারমা সম্প্রদায়ের একাধিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ‘খাস জমি’ বলে কিছু নেই। তাছাড়া মারমাদের শ্মশানভূমি কারো ব্যক্তির নামে থাকে না, তা সামাজিক ভূমি হিসেবেই থাকে।
উক্ত ব্যক্তিগণ বলেন, সেনা ও উপজেলা প্রশাসন ষড়যন্ত্রমূলকভাবেই স্থানীয় মারমাদের শ্মশানভূমি বেদখল করে সেখানে নও মুসলিম ত্রিপুরাদের বসতিদান করার পাঁয়তারা করছে। তাছাড়া সেখানে প্রশাসন বা সরকারি উদ্যোগে নও মুসলিমদের বাড়ি নির্মাণের অর্থই হচ্ছে সরকার ও প্রশাসন কর্তৃক আদিবাসী জুম্মদের ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ধর্মান্তরিতকরণকে উৎসাহিত ও মদদদান করা, যা জুম্মদের জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের কার্যক্রম ছাড়া আর কিছু নয়।
উল্লেখ্য যে, বান্দরবানে ইতোমধ্যে ‘উপজাতীয় মুসলিম আদর্শ সংঘ’, ‘উপজাতীয় মুসলিম কল্যাণ সংস্থা’ ও ‘উপজাতীয় আদর্শ সংঘ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি সংগঠনের নামে বেশ কয়েকটি উপজাতীয় নুও মুসলিম বসতি স্থাপন করা হয়েছে। উক্ত সংগঠনসমূহের মাধ্যমে জুম্মদের ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। বর্তমানে বান্দরবান পৌর এলাকার বাস স্টেশনে বসবাসকারী ৩০টি ধর্মান্তরিত ত্রিপুরা ও খেয়াং পরিবার, টাংকি পাড়া এলাকায় ১৫টি নুও মুসলিম ত্রিপুরা পরিবার, লামার লাইনঝিরিতে ১৭টি এর অধিক পরিবার, গোয়ালমারায় ৪৫টি মুসলিম ত্রিপুরা পরিবার, আলীকদম-থানচি সড়ক সংলগ্ন ক্রাউডং (ডিম পাহাড়) এলাকায় ১৬টি ত্রিপুরা মুসলিম পরিবার, আলীকদম-থানচি সড়কের ১১ কিলো এলাকায় ৪৫টির অধিক নও মুসলিম পরিবার বসবাস করছে বলে জানা যায়।
উল্লেখ্য, কিছু মৌলবাদী ও জুম্মবিদ্বেষী ইসলামী গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জুম্মদের নানাভাবে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাড়ি নির্মাণ, গরু ও ছাগল পালন, সুদবিহীন লোন ইত্যাদির প্রলোভন দেখিয়ে বান্দরবান জেলায় অব্যাহতভাবে এই ধর্মান্তরিতকরণ চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব ধর্মান্তরকরণের কার্যক্রমে এইসব মৌলবাদী গোষ্ঠীসমূহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সম্মতি ও সহযোগিতা পেয়ে থাকে বলেও জানা যায়।