হিল ভয়েস, ২৪ আগস্ট ২০২২, বান্দরবান: বান্দরবান জেলাধীন লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে ভূমিদস্যু খ্যাত যে ‘লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ কর্তৃক স্থানীয় আদিবাসী ত্রিপুরা ও ম্রো গ্রামবাসীরা ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদের চেষ্টার শিকার হয়ে আসছে, উল্টো ত্রিপুরা ও ম্রো জনগোষ্ঠী সেই রাবার কোম্পানির ষড়যন্ত্রমূলক মামলার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গতকাল ২৩ আগস্ট ২০২২ ত্রিপুরা ও ম্রো গ্রামবাসীদের পক্ষে লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কর্তৃক স্থানীয় আদিবাসীদের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করার কথা জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে এই মামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
বিবৃতিতে গত ১৪ আগস্ট ২০২২ লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর ডেপুটি ম্যানেজার মো. আব্দুল মালেক বাদী হয়ে বান্দরবানের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই মামলা দায়ের করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরা, কার্বারি রেংয়েন ম্রো, কার্বারি লাংকম ম্রোসহ ১১ জন গ্রামবাসীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরো ১৫/২০ জনকে আসামী করা হয়েছে বলে জানা গেছে। মামলার ধারাগুলো হল- ১০৯/১৪৩/৪৪৭/৩৭৯/৪২৭/৫০৬/৩৪ দ:বি:।
উল্লেখ্য, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর কর্তৃপক্ষ ভাড়াটে ভূমিদস্যুদের দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লামার সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রো কার্বারি পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা কার্বারি পাড়া এবং রেংয়েন ম্রো কার্বারি পাড়ার আদিবাসীদের অবশিষ্ট ৪০০ একর জুমের বাগান এবং ভূমি বেদখল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে দীর্ঘ দিনের অভিযোগ রয়েছে। এই অবস্থায় ম্রো ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত এই তিন আদিবাসী গ্রামের ৩৯টি পরিবারের ২০০ নারী-পুরুষ এখন উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছেন।
গ্রাসবাসীরা জানান, তাদের গ্রামের প্রায় ৪০০ একর ভূমিতে তারা বংশপরম্পরায় জুমচাষ ও বাগান-বাগিচা করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কিন্তু ২০১৯ সালে হঠাৎ লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজ নামের একটি কোম্পানী রাবার প্লটের নামে জুম্মদের ঐসব ভূমি দখলে নেয়ার অপচেষ্টা শুরু করে। এসময় গ্রামবাসীরা বাঁধা দিলে, কোম্পানির লোকেরা আদিবাসীদের মামলা, হামলা, খুন ও পুলিশের ভয় দেখায়। তখন থেকে কোম্পানির লোকেরা একাধিকবার শ্রমিক এনে আদিবাসীদের ঐ ভূমি বেদখলের চেষ্টা করে।
ইতোপূর্বে সরই ইউনিয়নের ডলুছড়ি মৌজার নতুন পাড়া, ঢেঁকিছড়া পাড়া ও নোয়া পাড়ায় লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড ইজারার নামে ১,৬০০ একর জায়গা দখল করে। এর ফলে এলাকার তিনটি গ্রামের শত শত পরিবার ম্রো গ্রামবাসী উচ্ছেদের হুমকির মধ্যে রয়েছে।
উল্লেখ্য, রাবার কোম্পানির ভূমিদস্যুরা গত ৯ এপ্রিল ২০২২ স্থানীয় ম্রো ও ত্রিপুরাদের প্রায় ৪০০ একর জুম ভূমি দখলের উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের বিভিন্ন ফলজ গাছসহ অন্যান্য চারা ও গাছ কেটে দেয় এবং ২৬ এপ্রিল ২০২২ জুম ভূমি ও গ্রামীণ বনে অগ্নিসংযোগ করে। এরপর গত ১৩ জুলাই ২০২২ ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসী নেতা রংধজন ত্রিপুরাকে হামলা করে গুরুতর আহত করা হয়। গত ১০ আগস্ট ২০২২ বিকাল রেংইয়েন কার্বারি পাড়ার নবনির্মিত অশোক বৌদ্ধ বিহারে ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে হামলা, ভাঙচুর ও দুটি বুদ্ধিমূর্তি লুট করা হয়।
গত ১৬ আগস্ট ২০২২ ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীর সাথে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর সৃষ্ট ভূমি বিরোধ নিয়ে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে পার্বত্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং-এর সভাপতিত্বে এবং জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তীবরীজি ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পার্বত্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং ও জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তীবরীজি ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীদের দাবিকৃত তাদের ঐতিহ্যগত ৪০০ একর পাড়া ও জুমভূমির বিপরীতে পরিবার প্রতি মাত্র ৫ একর ভূমি বরাদ্দের প্রস্তাব/রায় দিলে আদিবাসী ম্রো ও ত্রিপুরা প্রতিনিধিবৃন্দ তা প্রত্যাখ্যান করেন। ম্রো ও ত্রিপুরা প্রতিনিধিবৃন্দ পার্বত্যমন্ত্রী ও জেলা প্রশাসকের উক্ত রায়/প্রস্তাবকে একতরফা এবং পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিহিত করেন। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত ও মীমাংসা ব্যতিরেকেই সভাটি সমাপ্ত হয় বলে জানা গেছে।
লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ ষড়যন্ত্রমূলক মামলা সত্ত্বেও দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের ভূমি রক্ষার আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে জানান। কোনো ষড়যন্ত্র করে তারা তাদের ভূমি কেড়ে নিতে দেবেন না বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।