হিল ভয়েস, ৩০ জুলাই ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: ৫০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের যৌথ বিবৃতিতে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার না করার জন্য গোয়েন্দা সংস্থার প্ররোচনায় তথ্য মন্ত্রণালয়ের ১৯ জুলাই ২০২২-এর সার্কুলার সংবিধান-পরিপন্থী ও উচ্চ আদালত অবমাননাকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অবিলম্বে উক্ত সার্কুলেশন প্রত্যাহারের জন্য উক্ত বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ আহবান জানিয়েছেন। ৫০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের পক্ষে এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হদার স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয় যে-
“আমরা গভীর ক্ষোভ ও বিস্ময়ের সঙ্গে জেনেছি যে, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেশের সকল টেলিভিশন চ্যানেলের প্রধানদের কাছে একটি সার্কুলার পাঠিয়ে বলা হয়েছে ‘৯ আগস্ট ২০২২ তারিখ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত টকশো-তে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধ্যকতা সম্পর্কে প্রচারের জন্য’ বলতে হবে। যে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় এই সার্কুলার প্রচার করেছে, সেই সরকারের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের ২৮(ক) ধারায় একাধিকবার আদিবাসী শব্দটি স্পষ্ট করে ব্যবহার করা হয়েছে।
এই সার্কুলারটি আসলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিপত্রকে ভিত্তি করেই রচিত এবং তার অনুলিপি হিসেবেই প্রচার করা হয়েছে। কোন শব্দটি সংবিধান সম্মত কিংবা অসাংবিধানিক তা নির্ধারণ করার এখতিয়ার একটি গোয়েন্দা অধিদপ্তর কিংবা তথ্য মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার প্রণয়নকারীদের কাছে কখন কিভাবে গেল তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগের সঙ্গে আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এটি চরম অনধিকার চর্চার পর্যায়ে পড়ে, যা মোটেই কাম্য নয়, আইনসম্মতও নয়।
কারণ আমাদের দেশের সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংবিধানের কোন ধারা বা বিষয় নিয়ে কোন বিতর্ক বা মতান্তর দেখা দিলে তার ব্যাখ্যা একমাত্র দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টই দিতে পারবে। অন্য কোন প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি নয়। আর বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টেরই এক রায়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারে কোন আইনগত প্রতিবন্ধকতা নেই।
তদুপরি এ কথাও আজ দিবালোকের মতো সত্য যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারই ১৯৭২ সালে যে আই এলও কনভেনশন ১০৭ অনুস্বাক্ষর করে গেছেন সেখানেও আদিবাসী বা Indigenous শব্দটি শুধু ব্যবহারই নয়, তাদের সকল অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। এ ছাড়া কয়েক মেয়াদে ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে আদিবাসী দিবস উপলক্ষে তার দেয়া বানীতে আদিবাসীদের নিজস্ব পরিচয়ে সকল অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার উপর বলিষ্ঠ ভাষায় গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
সর্বোপরি সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ২(ক) ও ২(খ) ধারায় যে বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেয়া রয়েছে তাতেও এই সার্কুলারে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। একজন কি কি শব্দ চয়ন করলেন তাতে রাষ্ট্রের কারও কিছু বলার নাই, যদি এই শব্দ ব্যবহারে অন্য কারও প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণা না ছাড়ানো হয়। তাই এই সার্কুলার তথা নির্দেশনার প্রতি আমরা তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। একই সাথে এ ধরনের আমলাতান্ত্রিক ঔদ্বত্যপূর্ণ সার্কুলার জারি করে আদিবাসী ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করা কিংবা স্বাধীন মতামত প্রদানকারী নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের হেয় করার প্রচেষ্টা থেকে সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে বিরত থাকার আহ্বান রাখছি। আর অবিলম্বে তথ্য মন্ত্রণালয়ের আলোচ্য এখতিয়ার বহির্ভূত সার্কুলার প্রত্যাহারের জোর দাবি জানাচ্ছি।”
বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেছেন তারা হচ্ছেন:
১. সুলতানা কামাল, মানবাধিকার কর্মী ও চেয়ারপার্সন, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন; ২. খুশী কবির, সমন্বয়কারী, নিজেরা করি ও চেয়ারপার্সন, এএলআরডি; ৩. ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র; ৪. ড. হামিদা হোসেন, মানবাধিকার কর্মী; ৫. ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি; ৬. শিরিন হক, সদস্য, নারীপক্ষ; ৭. প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষক; ৮. ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, নির্বাহী পরিচালক, রিসার্স ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ (রিব); ৯. রাণা দাশগুপ্ত, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ; ১০. সুব্রত চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট; ১১. পারভীন হাসান, ভাইস চ্যন্সেলর, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি; ১২. রানী ইয়েন ইয়েন, চাকমা রানী ও উপদেষ্ট চাকমা সার্কেল চীফ; ১৩. কাজল দেবনাথ, প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ; ১৪. অ্যাড. জেড আই খান পান্না, মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট; ১৫. অ্যাডভোকেট তবারক হোসাইন, সহ-সভাপতি, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট; ১৬. ড. আবুল বারকাত, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও উপদেষ্টা, এইচডিআরসি; ১৭. রেহনুমা আহমেদ, কবি ও লেখক; ১৮. শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এসোসিয়েশ ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি); ১৯. ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অনারারি নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট); ২০. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন; ২১. আহরার আহমেদ, এমিরেটাস অধ্যাপক, ব্লাক হিল স্টেট ইউনিভার্সিটি ও ডিজি, জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন; ২২. শারমিন মুর্শিদ, নির্বাহী পরিচালক, ব্রতি; ২৩. সঞ্জীব দ্রং, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম; ২৪. ড. শহিদুল আলম, আলোকচিত্রী ও সমাজকর্মী; ২৫. জাকির হোসেন, নির্বাহী পরিচালক, নাগরিক উদ্যোগ; ২৬. শাহীন আনাম, নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন; ২৭. সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান নির্বাহী, বেলা; ২৮. রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ২৯. বীনা ডি’ কস্টা, অধ্যাপক, অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; ৩০. ড. সুমাইয়া খায়ের, অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ৩১. তাসনিম সিরাজ মাহবুব, সহযোগি অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ৩২. সামিনা লুৎফা, অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ৩৩. ফেরদৌস আজীম, অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়; ৩৪. গীতি আরা নাসরিন, অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ৩৫. ফেরদৌস আজিম, অধ্যাপক, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়; ৩৬. ড. মোহাম্মদ তানজিম উদ্দিন খান, অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ৩৭. জোবাইদা নাসরীন কণা, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ৩৮. নোভা আহমেদ, গবেষক ও শিক্ষক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়; ৩৯. মাহরুখ মহিউদ্দিন, ম্যানিজিং ডিরেক্টর, বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস কাউন্সিল; ৪০. পল্লব চাকমা, নির্বাহী পরিচালক, কাপেং ফাউন্ডেশন; ৪১. রেজাউল করিম লেনিন, গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী; ৪২. সায়দিয়া গুলরুখ, সাংবাদিক ও গবেষক; ৪৩. মো. নুর খান লিটন, মানবাধিকার কর্মী; ৪৪. শাহনাজ হুদা, অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়; ৪৫. হানা শামস আহমেদ- মানবাধিকার ও আদিবাসী অধিকার কর্মী; ৪৬. রেজাউল করিম চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট; ৪৭. অরূপ রাহী, সঙ্গীতশিল্পী ও লেখক; ৪৮. দীপায়ন খীসা, তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম; ৪৯. নীনা গোস্বামী, আইনজীবী ও সিনিয়র উপ-পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র; ৫০. জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।