উদয়ন তঞ্চঙ্গ্যা
গত ২৬ মে ২০২২ রাঙ্গামাটিতে এপিবিএন আঞ্চলিক কার্যালয় উদ্বোধনকালে বিশেষ অতিথি হিসেবে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মে. জে. সাইফুল আবেদীনের দেয়া বক্তব্যে তার চরম জাত্যভিমানী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক মুখোস খসে পড়েছে। তিনি তার বক্তব্যে আগা-গোড়ায় সেটেলার বাঙালিদের (তার ভাষায় অউপজাতীয়দের) পক্ষে কথা বলেছেন এবং জুম্ম জনগণের (তার ভাষায় উপজাতীয়দের) বিরুদ্ধে নানাভাবে বিষোদগার করেছেন।
এতদিন তার সেই জাত্যভিমানী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক খোলস অনেকটা লুকিয়েছিল বলা চলে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছ্কু রাঙ্গামাটির একজন হেডম্যান জানান যে, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার ও ২৪ পদাতিক ডিভিশনের দায়িত্ব গ্রহণের পর বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সফরকালে পার্বত্যাঞ্চলের নেতৃবৃন্দের কাছে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন যে, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন চান। জিওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে ভূমিকা রাখবেন। এজন্য তিনি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়া তথা চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ পরিচিহ্নিত করার আগ্রহও দেখান বলে উক্ত হেডম্যান জানান।
কিন্তু তার সেই উগ্র জাত্যভিমান ও বর্ণবাদী চরিত্র শেষ পর্যন্ত লুকিয়ে রাখতে পারলেন না। রক্তের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যদি উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক রক্ত বইতে থাকে তাহলে সেটা হয়তো সাময়িক লুকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে লুকিয়ে রাখা যায় না। তা কোন না কোনভাবে প্রকাশ হবেই হবে। জিওসি’র অবস্থাও তাই হলো।
তিনি বলেছেন, “কোটা যদি থাকে সে কোটা সবার জন্য হতে হবে। উপজাতি, অউপজাতি যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করেন, তাদের সবার জন্য এই কোটা প্রযোজ্য হতে হবে। আমি এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানাতে চাই, এই পার্বত্য কোটা, এটা উপজাতি, অউপজাতি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিন।”
নাগরিকদের অনগ্রসর অংশের জন্য বিশেষ বিধান বা ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সাংবিধানিক ব্যবস্থা রয়েছে, সেটা বোধ হয় তিনি সম্যকভাবে বুঝেন না। তার বক্তব্য অনুসারে যদি আদিবাসী (তার ভাষায় উপজাতীয়) কোটা বাঙালিদের জন্যও খুলে দেয়া হয়, তাহলে নারীদের জন্য কোটা, প্রতিবন্ধীদের কোটা, জেলা কোটা, মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের কোটা, পোষ্যদের কোটা, জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার পরিষদে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ (কোটা) ইত্যাদি যত সব কোটা বা সংরক্ষিত ব্যবস্থা রয়েছে সবকটি সকল জনগোষ্ঠীর জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হয়। একেকটি বর্গের জনগোষ্ঠীর এক এক বিশেষ বাস্তবতার আলোকে তো কোটা সংরক্ষিত হয়ে থাকে। আর সেই সংরক্ষিত ব্যবস্থা যদি অন্য কোন বর্গের লোকদের জন্য খুলে দেয়া হয়, তাহলে কোটার মর্মার্থ তো থাকার কথা নয়। দেশের একটি বৃহৎ অঞ্চলের সেনা প্রধান হয়েও তিনি যে সেটা বুঝেন না তা সত্যিই লজ্জাজনক বটে!
যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগোষ্ঠী নানা ক্ষেত্রে এখনো অনগ্রসর ও পিছিয়ে রয়েছে, তাই পার্বত্য চুক্তিতে জুম্মদের জন্য কোটা সংরক্ষণের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যারা এই কোটার বিরুদ্ধে কথা বলে তারা নি:সন্দেহে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত চুক্তি (পার্বত্য চুক্তি) বিরোধী এবং অগণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন, নতুন করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা এতদিন ‘উপজাতীয় কোটা’কে ‘পার্বত্য কোটা’ নামে রূপান্তর করে সেটেলার বাঙালিদেরকেও সেই কোটায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উগ্র জাতীয়তাবাদী, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী সেটেলার বাঙালি ও তাদের সংগঠনের মুখে শুনে আসছি। কিন্তু এবারই প্রথম একজন সেনানায়কের মুখে আমরা সেটেলার বাঙালিদের সেই বালখিল্য দাবি তুলে ধরতে শুনলাম। রাষ্ট্রের উচ্চপদে থাকা একজন সেনানায়কের পক্ষে মৌলবাদী সংগঠনের দাবিতে একাত্মতা প্রকাশ করা সত্যিই গোটা বাংলাদেশের জন্য দু:খজনক। এ থেকে বুঝা যায় মে. জে. মো: সাইফুল আবেদীনের মত ব্যক্তিদের কারণে দেশটা কতটা উগ্র সাম্প্রদায়িক, উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী হয়ে উঠছে। তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার ও ২৪ পদাতিক ডিভিশনের দায়িত্ব না দিয়ে বরঞ্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ নামক সেটেলার সংগঠনের সভাপতি পদে আসীন করা দরকার বলে অনেকে অভিমত দিয়েছেন।
সেটেলার বাঙালিদের সপক্ষে কথা বলতে গিয়ে তিনি আরো বলেছেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে এই মুহূর্তে ৫১ শতাংশ উপজাতি নাগরিক এবং ৪৯ শতাংশ অউপজাতি নাগরিক বসবাস করেন। আজকে এখানে যে কোনো প্রক্রিয়া, যে কোনো শান্তি স্থাপনের জন্য অউপজাতি নাগরিক যারা তাদেরকে বাদ দিয়ে কোনো প্রকার শান্তি স্থাপন করা সম্ভব হবে না।”
জিওসি’র এ বক্তব্য থেকে এটা বুঝা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে যে স্থায়ী বাঙালি অধিবাসীদের (স্থায়ী অউপজাতীয় বাসিন্দাদের) অধিকার স্বীকৃত রয়েছে তা তিনি জানেন না। সেই স্থায়ী অউপজাতীয় বাসিন্দা বলতে কারা, চুক্তিতে তার যে সংজ্ঞা দেয়া আছে, তাও তিনি বুঝেন না বলে মনে হচ্ছে। পার্বত্য চুক্তিতে জায়গা-জমি বন্দোবস্তী, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, সরকারি চাকরি, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্থায়ী বাঙালি বাসিন্দাদের অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি স্থাপনসহ যে কোন প্রক্রিয়ায় তাদের বাদ দেয়ার প্রশ্নই উঠে না এবং তাদেরকে বাইরে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কখনোই সম্ভব হতে পারে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা সংজ্ঞা অনুসারে যাদের বৈধ জায়গা-জমি নেই ও স্থায়ী ঠিকানা নেই তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের যে কোন প্রক্রিয়ার সাথে তাদেরকে সম্পৃক্ত করার প্রশ্নই আসে না, যেমনটি প্রশ্ন আসে না পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় ও অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দাদের বরিশাল জেলার যে কোন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে। কাজেই জিওসি’র মতো সেনানায়কের এই বক্তব্য নি:সন্দেহে সম্পূর্ণভাবে পার্বত্য চুক্তির বিধি-বিধানের বিপক্ষে, যা পার্বত্য চুক্তি সম্পর্কে তার চরম অজ্ঞতাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে উন্মোচিত করে।
“অউপজাতি নাগরিককে বাংলাদেশের অন্য কোন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, তাহলে সেটা হবে একটা আকাশ কুসুম কল্পনা” বলে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটাও তার বর্ণবাদী, উপনিবেশিক ও ফ্যাসীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসেছে। গণতন্ত্রকে যদি আমরা ধারণ করি, অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিশীলতা যদি আমরা আত্মস্থ করি, এবং অন্য যে কোন জাতির অধিকারকে যদি আমরা সম্মান করতে শিখি, তাহলে সেটা কখনোই আকাশ কুসুম কল্পনা হতে পারে না। মিজোরামের রিয়াং শরণার্থীদের যদি ত্রিপুরায় পুনর্বাসন করা যায়, তাহলে সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে নিয়ে যেতে না পারার কোন কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয় না।
জিওসি সাইফুল আবেদীন একদিকে যেমনি সেটেলার বাঙালিদের পক্ষে নানা উদ্ভট যুক্তি তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে তেমনি জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে চরম অবজ্ঞাসূচক বক্তব্য উত্থাপন করেছেন। তিনি সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার অনুসারে প্রবর্তিত ‘উপজাতীয় কোটা’কে তাচ্ছিল্য সুরে ‘সরকারের অনুগ্রহ’ বা করুণা বলতেও দ্বিধা করেননি। এমনকি সরকারের অনুগ্রহে দেওয়া সেই কোটা ব্যবস্থাকে পাহাড়িরা পূর্ণ অপব্যবহার করছেন বলেও অপমানসূচক বক্তব্য প্রদান করেন।
এমনকি চাকমারা কেন এত শিক্ষিত হচ্ছে তা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেন। তিনি বলেছেন, “চাকমাদের শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ। আপনারা কীভাবে এত শিক্ষিত হচ্ছেন? বিভিন্ন বড় বড় জায়গায় আপনাদের অবস্থান। কেন আপনাদের অবস্থান? দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় আপনাদের উপস্থিতি। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিানের কাছে আপনাদের সরব পদচারণা। কেন?” জিওসি’র কী বিভৎস জিজ্ঞাংসা! কী অদ্ভুট প্রতিহিংসা! কিন্তু প্রশ্ন জাগে, চাকমারা যে ৭৩ শতাংশ শিক্ষিত, তিনি তা কোথায় পেলেন? আমরা আদিবাসী বা জুম্মদের পৃথক পরিসংখ্যান এত খুঁজেও বাংলাদেশের কোন পরিসংখ্যান বইয়ে পাইনি। এজন্য অন্তত জিওসিকে ধন্যবাদ জানাই, সরকারের পরিসংখ্যানে না থাকলেও তিনি মনগড়া একটা পরিসংখ্যান দিয়ে সমস্যার সমাধানের পথ দেখালেন!
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে দুই পক্ষের ভূমিকার ক্ষেত্রেও তিনি কেবল একতরফাভাবে জনসংহতি সমিতির ব্যর্থতা দেখলেন এবং নানা মনগড়া যুক্তি ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য তুলে ধরলেন। তিনি বলেছেন, “পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব কি শুধুমাত্র সরকারের? … সেই চুক্তির মধ্যে সরকারের জন্য পালনযোগ্য সবকিছু এবং জনসংহতির জন্য পালনযোগ্য ছিল মাত্র দুটি ধারা। ‘ঘ’ খণ্ডের অনুচ্ছেদ ১৩ এবং অনুচ্ছেদ ১৪ যেখানে বলা আছে জনসংহতি সমিতি তৎকালীন তাদের সকল অস্ত্র সারেন্ডার করবে এবং তাদের সকল আর্ম ক্যাডার আত্মসমর্পণ করবে। …এই দুটি ধারার মধ্যে কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে?” তার ভাষায় সেই দু’টি ধারাও জনসংহতি সমিতি বাস্তবায়ন করেনি।
তাহলে কি জনসংহতি সমিতির ১৯৪৭ জন সদস্য যে চারদফায় শত শত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও গোলাবারূদ প্রধানমন্ত্রীসহ তৎকালীন মন্ত্রী-সাংসদের নিকট জমা দিয়েছিলেন, তা ছিল মিথ্যা ও বানোয়াট? এতদিন কোন সরকার বা কর্তৃপক্ষ জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে সেই অভিযোগ তুলেনি কিংবা অস্ত্র জমাদানে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে পার্বত্য চুক্তির ১৫নং ধারা অনুসারে জনসংহতি সমিতির সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু হঠাৎ করে ২৫ বছর পর উর্বর মস্তিষ্কসম্পন্ন জিওসি সেটা আবিস্কার করলেন! কী সেলুকাস!
আরো আশ্চর্যের বিষয় যে, জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে চুক্তি বাস্তবায়ন না করার অভিযোগ তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করলেও চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে সরকার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ধারা বাস্তবায়ন করেছে এবং চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোসহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে দিয়েছে সে সম্পর্কে একটি শব্দও উল্লেখ করেননি। তিনি পার্বত্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রচারিত চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি বাস্তবায়নের অসত্য ও বিকৃত পরিসংখ্যান গোগ্রাসে গিলে সভায় তুলে ধরেছিলেন। সরকার চুক্তির কোন ধারা কিংবা কোন মৌলিক বিষয়টি বাস্তবায়ন করেনি তার কোন বয়ান তুলে ধরলেন না, কিন্তু জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে চুক্তি বাস্তবায়ন না করার এক একটি ধারা উল্লেখ করে একে একে অসত্য ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য তুলে ধরতে ভুলে যাননি।
বস্তুত পার্বত্যাঞ্চলের উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ; সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কার্যাবলী ন্যস্তকরণ পূর্বক আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন; স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন পূর্বক এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা; ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে জুম্মদের বেহাত জায়গা-জমি ফেরত দেয়া ও বহিরাগতদের নিকট দেয়া সকল ইজারা বাতিল, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদেরকে তাদের জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ পূর্বক পুনর্বাসন করা, ‘অপারেশ উত্তরণ’সহ নিরাপত্তা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরিতে পাহাড়িদের অগ্রাধিকার দিয়ে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ দেয়া, অলিখিত চুক্তি অনুসারে সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন করা ইত্যাদি মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে একটি বিষয়ও টোকেন হিসেবে জিওসি তার বক্তব্যে উত্থাপন করেননি।
পার্বত্য চুক্তির এসব মৌলিক বিষয়গুলি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের অব্যাহত গড়িমসির বিষয়টি উত্থাপন না করার পেছনে জিওসি’র অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সরকারের ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দেয়া এবং পক্ষান্তরে জুম্ম জনগণের উপর ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে তাদেরকে অপরাধী করা (ক্রিমিনালাইজ করা)। যে কোনো জাতিগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের আন্দোলন দমন-পীড়নের ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার ক্ষেত্রে যে কোনো দেশে শাসকগোষ্ঠী যে অন্যতম কৌশল অবলম্বন করে থাকে, তা হলো আন্দোলনকারীদেরকে ক্রিমিনালাইজ করা এবং সে সম্পর্কে অপপ্রচার চালানো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রেও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী একই ধারায় মুক্তিযুদ্ধকে ক্রিমিনালাইজ করার চেষ্টা করেছিল। বস্তুত সেই পাকিস্তানী ধারার প্রতিফলন হচ্ছে জিওসি’র একতরফা ও একদেশদর্শী তথা হুমকিমূলক বক্তব্য।
তিনি জুম্ম জনগণকে দেশে-বিদেশে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, দুর্বৃত্ত হিসেবে ক্রিমিনালাইজ করার জন্য যুদ্ধের আহ্বান করেছেন এবং যুদ্ধে উস্কে দিয়ে ৩০ মিনিটের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করার হুমকি দিয়েছেন। তিনি জাত্যভিমানে ও পেশিশক্তিতে এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে, একটা স্বাধীন দেশের এক অংশের জনগণের সাথে সেনাবাহিনী যে যুদ্ধে রয়েছে সেটা অবলীলায় স্বীকার করে ফেলেছেন। নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আহ্বান করা দেশের ভাবমূর্তির জন্য কতটা যে ক্ষতিকর তা বিবেচনার মধ্যে রাখতেও তিনি বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন বলে মনে হয়েছে। চুক্তির আগে জনসংহতি সমিতির সাথে সরকারের যে যুদ্ধ চলছিল, তা সেসময়কার সরকারগুলো বরাবরই অস্বীকার করতো। আর এক্ষেত্রে জিওসি’র অবস্থান একেবারেই রাখঢাকহীন, যা এক অর্থে সত্যিই প্রশংসনীয়।
এপিবিএন আঞ্চলিক কার্যালয় উদ্বোধনকালে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় যথার্থই বলেছেন, পার্বত্য চুক্তির ভিত্তিতে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা রাখতে এবং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হলে (প্রধানমন্ত্রী ডাক দিলে), সর্বোপরি নাগরিক ও জাতিসত্তাদের মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখলে অত্রাঞ্চলে যথাযথ শান্তি পুন:প্রতিষ্ঠা কিংবা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর অকাম্য কার্যক্রম বন্ধ না হয়ে থাকতে পারে না। চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের এই বক্তব্যের মর্মার্থ জিওসি’র মতো সেনানায়কসহ সরকারের নীতি-নির্ধারকরা যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, তত দ্রুতই পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ীত্বশীল শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।