অং ম্রান্ট অং
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জাতির সন্তান বম জনগোষ্ঠীর গুটিকয়েক উগ্র জাতীয়তাবাদী, বিভেদকামী ও সুবিধাবাদী ব্যক্তিদের নেতৃত্বে পরিচালিত Kuki-Chin National Front-KNF তার ফেইসবুক পেইজ থেকে স্ববিরোধী ও জগাখিচুড়ি শান্তি তত্ত্ব এবং আজগুবি মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাওয়ার কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা যায়। “কেএনএফ সংগঠনটি শান্তিপূর্ণ সংগঠন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত নিষ্পেষণ ও শোষণ বিরোধীসহ জাতিগত সংঘাত, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, যুদ্ধ বিরোধী কাজ করে যাচ্ছে” বলে সংগঠনটি দাবি করে। ঐ সংগঠনের নেতা ও সভাপতি নাথান বমকে পার্বত্যাঞ্চলসহ সমগ্র বাংলাদেশের শান্তির প্রতীক (symbol of peace) এবং শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বের জন্য তাঁর শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ একটি জ্বলন্ত নজীর বলে পেইজের প্রবন্ধগুলোতে দাবি করা হয়। এসমস্ত অসামান্য অবদানের জন্য দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পদক এবং আন্তর্জাতিক শান্তি পুরষ্কার প্রদানের জন্য এক প্রবন্ধে জোর আবেদন করেছে।
পৃথিবীতে ধর্মপ্রবর্তকগণসহ বিভিন্ন মনিষী, মহান নেতাগণ শান্তির বাণী, মত-পথ বা তত্ত্ব দিয়েছেন। এখনো সেই মত-পথ বা তত্ত্ব ধরে দেশে বা সমাজে অনেকেই শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং বলে যাচ্ছেন, তা আমরা দেখতে পাই। সেভাবে নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ-এর একটি শান্তির মত-পথ বা তত্ত্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখন নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ এর শান্তির মত-পথ বা তত্ত্ব কি প্রকৃত শান্তির মত-পথ বা তত্ত্ব নাকি আগ্রাসী, সাম্প্রদায়িক, উগ্র জাতীয়তাবাদী শাসকগোষ্ঠী ও তার দমন-পীড়নের যন্ত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে বৈধতা এবং সহযোগিতা দেওয়ার জন্য একটা দালালি মত-পথ বা তত্ত্ব সৃষ্টি করেছে, তা বিচার-বিবেচনার জন্য এ লেখার অবতারণা।
শান্তিবাদী ও অসিংস নীতির মন্ত্র হচ্ছে- “কেউ তোমার এক গালে চড় মারলে, তোমার আরেক গাল এগিয়ে দিয়ে চড় মারতে দাও।” এই বাণী ও নীতির আলোকে যদি ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে আগ্রাসী, সাম্প্রদায়িক ও অধিকারহরণকারী শাসকগোষ্ঠীর কোনো লোক পাহাড়ে আদিবাসীদের ভূমি একশো একর দখল করলে আরো একশো একর ভূমি দখলকারীকে এগিয়ে দাও বা কোনো আদিবাসী নারীকে কেউ বাগিয়ে নিয়ে নিলে আরেক আদিবাসী নারীকে এগিয়ে দাও অথবা কোনো আদিবাসী নারীকে কেউ ধর্ষণ করলে আরেক নারীকে ধর্ষণ করতে দিয়ে দাও’ – এই মত ও পন্থা কি প্রকৃত শান্তির? নাকি তার বিরোধী হয়ে ঐ আগ্রাসী, সাম্প্রদায়িক, ভূমি দখলকারী, অধিকার বিলোপকারী, ধর্ষণকারী, দমন-পীড়নকারী ও সম্প্রসারণকারী-সম্প্রসারণবাদীদের বিরত করা, রুখে দেওয়া, প্রতিবাদ করা এবং প্রতিরোধ করাই হচ্ছে শান্তির প্রকৃত মত ও পন্থা – কোনটি? নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ এর বয়ানে কী জানান দিচ্ছে? তার সারবস্তু খুঁজুন। নাথান বম ও তার সংগঠন কেএনএফ শান্তিবাদী নীতি প্রচার করছে, পক্ষান্তরে বল প্রয়োগের রাজনীতিতে (সশস্ত্র আন্দোলনে) অবতীর্ণ হয়েছে, তা নিতান্তই স্ববিরোধিতা, ভাওতাবাজী ও জগাখিচুড়ি ছাড়া অন্য কিছুই নয়। কাজেই নাথান বম ও তার সংগঠনের (কেএনএফের) সশস্ত্র আন্দোলনে অবতীর্ণ হওয়া হচ্ছে রোমান্তিকতা, ষদযন্ত্রমূলক ও কায়েমী স্বার্থপ্রসূত।
বিশ্বের মানব সমাজে শোষিত-বঞ্চিতরা এক পক্ষে আর শোষক-বঞ্চনাকারী শাসকেরা আরেক পক্ষ হয়ে থাকে। এই নিয়মই ইতিহাসে লক্ষ্য করা যায়। কারো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিগুলো শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত নয়, বাংলাদেশের সমস্ত আদিবাসী ও সংখ্যালঘুরা নিপীড়িত ও বঞ্চিত। এটাই বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা। কিন্তু লক্ষ্য করা যায়, নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ আগ্রাসী, সাম্প্রদায়িক, ভূমি দখলকারী, অধিকার হরণকারী ও বিলোপকারী, ধর্ষণকারী, দমন-পীড়নকারী ও সম্প্রসারণবাদীদের বিরুদ্ধে একটি শব্দও ব্যয় করছে না। অথচ প্রতিদিন পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে কোথাও না কোথাও আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুরা নিপীড়িত হচ্ছে, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, আদিবাসীদের ভূমি আগ্রাসনের মুখে পড়েছে, আদিবাসী নারীরা যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন হচ্ছে, ইসলামিক আগ্রাসন হচ্ছে, আদিবাসীদের কেউ কেউ নিরবে দেশ ছেড়ে চলে গেছে– এসব মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অশান্তির ঘটনাসমূহের ব্যাপারে নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ সংগঠনের কোনো বক্তব্য বা প্রতিবাদ নেই।
বরং নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ এর বিরুদ্ধে রুমার বগালেক এলাকায় নিজেদের দখলে নেওয়া জায়গা সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার প্রমাণিত সত্য ঘটনা আছে। বগালেকের পাড়ে বম জনগোষ্ঠী বসবাস করে। শোনা গেছে, লালরাম বম নামের একজনের কাছ থেকে কুকি-চিন সংগঠন নিজেদের জন্য জায়গা চেয়ে নেয় এবং কয়েক বছর পর সেই জায়গাটি সেনাবাহিনী হাতে তুলে দিয়েছে। তাছাড়া কেএনএফ সংগঠনের বিরুদ্ধে ইসলামিক জঙ্গিদের সাথে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। এরূপ কর্মকাণ্ড শান্তি স্থাপন নাকি দালালি কার্যক্রম এবং আদিবাসীদের অস্তিত্ব ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড; তা পাঠক বিচার-বিবেচনা করুন। সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে জায়গা নিয়ে তা সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া এক চরম বিশ্বাসঘাতকতাও বটে।
শুধু তা নয়, হেব্রন পাড়ার লালরিজাপ বমের মৃত্যু ঘটনা নিয়ে কেএনএফ সংগঠন সেনাবাহিনীর বক্তব্যকেই সমর্থন করে সেরূপ অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাই কেএনএফ নিজের বমের রক্তের সাথেও বেঈমানি করেছে। তাহলে এমন একটা সংগঠন ও ঐ দলের নেতা কেমন করে শান্তির জন্য কাজ করছে বলে ধরে নেওয়া যায়? সকলের জানা আছে, বিড়াল যখন ইঁদুর ধরে তখন বিড়াল ইঁদুরকে সাথে সাথে মেরে ফেলে না; কিছুক্ষণ খেলা করে। সেই সময় বিড়ালের দিক থেকে খেলা করা, আর ইঁদুরের দিক থেকে বাঁচার লড়াই। এই অবস্থায় যদি দ্বিতীয় ইঁদুর বলে বেড়ায় এবং বিশ্বাস করে যে, বিড়ালটি সত্যি সত্যি প্রথম ইঁদুরের সাথে খেলা করছে, তখন সেই দ্বিতীয় ইঁদুরকে কী বলা চলে, শান্তিবাদী নাকি দালাল? কেএনএফ ও নাথান বমরা ঠিক ঐ দ্বিতীয় ইঁদুরটির মতো কাজ করে চলেছে।
নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ নিজেদের কর্মকাণ্ডকে ন্যায্যতা দেখানোর জন্য, গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করানোর জন্য এবং গুটিকয়েক আদিবাসীকে মিথ্যা শিক্ষা দিয়ে এবং ভুল বুঝিয়ে দালালির পক্ষে দাঁড় করানোর উদ্দেশ্যে মিথ্যা, অর্ধসত্য ও প্রতারণামূলক তথ্য সাজিয়ে অপপ্রচারণায় লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন নিয়ে একটি অর্ধসত্য তথ্য Kuki-Chin National Front-KNF পেইজে তুলে ধরতে দেখা গেছে। সকলের জানা আছে যে, আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতি এবং অউপজাতিদের মধ্যে জনসংখ্যা অনুপাতে আসন স্থির করা হয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান ও সদস্যদের আসন বিন্যাস হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের আমলে সৃষ্ট স্থানীয় সরকার পরিষদের আমলের আসন বিন্যাস অনুযায়ী স্থিরীকৃত। তার ওপর ভিত্তি করে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের আসন বিন্যাস করা হয়েছে। জানা গেছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সংশোধিত পাঁচ দফা দাবিনামায় কেবল ৭টি স্বল্প জনসংখ্যা সম্পন্ন জুম্ম জাতিগুলোর (বম, লুসাই, পাংখো, খিয়াং, খুমী, চাক ও ম্রো) জন্য ৭টি আসন সংরক্ষণের প্রস্তাব ছিল। আর আসনগুলো ছিল সকলেই জন্য উন্মুক্ত। জাতিভিত্তিক আসন বিন্যাস ছিল না। কিন্তু সরকার সেই দাবি মেনে নেয়নি। তাই এরশাদ প্রবর্তিত আসন বিন্যাস অনুসারে দুই পক্ষই সমঝোতার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চুক্তিতে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছে বলে সকলকে স্বীকার করতে হবে।
আঞ্চলিক পরিষদের চাকরিজীবীদের নিয়ে আরেকটি অপপ্রচারে নামতে নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফকে দেখা যায়। সকলেই জানেন চুক্তির শর্তানুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ চাকরিতে লোক নিয়োগের ক্ষমতা তৃতীয় ও চতুর্থশ্রেণি। প্রথমশ্রেণি ও দ্বিতীয়শ্রেণি লোক নিয়োগের ক্ষমতা আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য জেলা পরিষদে নেই, এদের নিয়োগ দেবে বা প্রেষণে প্রেরণ করবে সরকার। তবে প্রেষণে নিয়োগের ক্ষেত্রে নি:সন্দেহে আঞ্চলিক পরিষদের একটা ইতিবাচক মতামত থাকতে হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা প্রেষণে নিয়োগের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদ আদিবাসী জুম্ম কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসী কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এখানে নি:সন্দেহে বম জনগোষ্ঠীর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদেরও প্রেষণে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদের কোন দ্বিমত থাকার কথা নয়।
কিন্তু বমজাতি থেকে প্রশাসনে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা আছে বলে আমার জানা নেই। এখনো উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করে বম ছাত্র-ছাত্রীও অত্যন্ত কম। নাথান বম নিজেই তো আন্দোলনের দ্বারা সৃষ্ট কোটা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লেখাপড়া করেছে। যদি খোঁজ নেন তাহলে দেখতে পাবেন অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মবলিদানকারী অনেক পরিবারের সন্তানগণ কোনো চাকরি না পেয়ে অসহায় অবস্থায় জীবনধারণ করে আছে। এসমস্ত বিষয় নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ দৃষ্টি দেবে না। কেননা, তাদের উদ্দেশ্য মিথ্যা, অর্ধসত্য ও প্রতারণামূলক তথ্য তুলে ধরে জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং ভুল বুঝিয়ে তাদের মতো দালাল সৃষ্টি করা ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে দুর্বল করা, ক্ষতিগ্রস্ত করা, আদিবাসীদের ঐক্য-সংহতি ধ্বংস করে দেওয়া। ইতোমধ্যে দেখা গেছে, নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি বাতিল করার দাবি জানিয়েছে। তার মানে নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ চুক্তি বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। এ অবস্থান থেকে পরিষ্কার হওয়া যায় যে, নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুনর্বাসিত বাঙালি সেটেলার এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির স্বার্থে দালালি করছে।
নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ-এর একটি প্রধান দাবি ‘কুকি-চিন রাজ্যের’ প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যাক। কেএনএফ বান্দরবানের পাঁচটি উপজেলা ও রাঙ্গামাটির চারটি উপজেলা নিয়ে একটি ‘কুকি-চিন রাজ্য’ করার দাবি তুলে ধরছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোন নির্দিষ্ট ভূখন্ডের নির্যাতিত-নিপীড়িত অধিকার-হারা জাতিগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া অধিকার আদায় সম্ভব নয়। এমএনএফ-এর নেতৃত্বে মিজো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও সেই একই ধারায় সংগঠিত হয়েছিল। এমএনএফ নেতা লাল ডেঙ্গা লুসাই হিলের লুসাই জাতির পাশাপাশি প্রায় অর্ধশত জাতিগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য মিজো জাতীয়তাবাদের ধ্বজা তুলে ধরেছিলেন। সেই চিন্তাধারার আলোকেই এমএনএফের নেতৃত্বে পরিচালিত সকল জাতিগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফসল হিসেবে ১৯৮৬ সালে মিজো জনগণের অধিকার সনদ মিজোরাম চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। এমএনএফ লুসাই হিলের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে বিভাজন নীতি অবলম্বন করে যদি কেবল লুসাই জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আন্দোলন করতো, তাহলে হয়তো সেই আন্দোলন নি:সন্দেহে দুর্বল হতো, যার ফল হিসেবে হয়তো ব্যর্থতার পর্যবসিত হতো।
আজকের নাথান বম ও তার কেএনএফ এখন সেই বিভাজন তথা ঐক্য বিরোধী নীতি অবলম্বন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে বিভাজন করছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত একক অঞ্চলকে খন্ডিত করে ‘কুকি-চিন রাজ্যের’ দাবি তুলে ধরেছে। এটা আসলে নাথান বম ও তার কেএনএফ সংগঠনের তথাকথিত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর পৃথক রাজ্য স্থাপনের জন্য নয়, এটা হচ্ছে জুম্ম জনগণের স্মরণাতীত কাল থেকে জিইয়ে থাকা ঐক্য-সংহতিকে সুকৌশলে বিনষ্ট করা এবং জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করা। কারণ ১০ লক্ষের মতো জুম্ম জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ২০ হাজার কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর আন্দোলন কখনোই সফল হতে পারে না, তা নতুন করে বিশ্লেষনের দরকার পড়ে না। এটা স্রেফ সেনাবাহিনী তথা বাংলাদেশের নিপীড়ক শাসকগোষ্ঠীর সেই এজেন্ডাকে সফল করবে, যে এজেন্ডা জুম্ম জনগণকে ‘ভাগ করো শাসন করো’ উপনিবেশিক নীতির ভিত্তিতে বিভাজন করে ধীরে ধীরে সকল জুম্ম জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করা। কারণ উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠী যেমন কেবল স্বজাতি ছাড়া অন্য কোন জাতিগোষ্ঠীকে সহ্য করতে পারে না, তেমনি স্বজাতির মধ্যেও নিজের শ্রেণি ছাড়া অধস্তন, খেটে খাওয়া, স্বল্প আয়ের শ্রেণিভুক্ত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসে না।
তাই নাথান বম ও তার কেএনএফ-এর কুকি-চিন রাজ্যের দাবি বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিরোধী। কাল্পনিক এই রাজ্য যদি বাস্তবও হয়ে ওঠে, সেই রাজ্যে দাবিকৃত কুকি-চিন জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হবে মারমা ও চাকমা। সেক্ষেত্রে কুকি-চিন জনগোষ্ঠী ক্ষমতা উপভোগ করার জন্য চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে বন্দুক ও লাঠি দিয়ে দমন-পীড়ন করে রাখতে হবে। আর এই দমন-পীড়নের জন্য দরকার হবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অথবা বিদেশ থেকে সৈন্যবাহিনী আনতে হবে। অন্যথায় তথাকথিত কুকি-চিনের পক্ষে শাসন করা সম্ভব হবে না। কিন্তু বিদেশ থেকে তো সৈন্যবাহিনী আনা যাবে না। একটি রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে বিদেশ থেকে কীভাবে সৈন্যবাহিনী বা সশস্ত্রদল আনা যাবে? এরফল হিসেবেও দ্বন্দ্ব-সংঘাত বেড়েই যাবে, কিন্তু শান্তি অধরা থেকে যাবে। তার মানে নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ এর প্রচারিত শান্তি তত্ত্ব মিথ্যা। এ থেকে বুঝতে পারা যায়, কেএনএফ পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসনকে বৈধতা ও যৌক্তিকতা দেখানোর উদ্দেশ্যে কুকি-চিন রাজ্যের কথা তুলে ধরছে।
নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ-এর আরেকটি উদ্দেশ্য হলো কুকি-চিন রাজ্যের কথা বলে তাদের দাবিকৃত ছয় জাতিসত্তার লোকজনকে রাজ্যের স্বপ্নে বিভোর করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্ত আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন-সংগ্রামকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, ছয় জাতিসত্তার লোকজনকে জুম্ম জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন-সংগ্রামের বিরোধী করে তোলা। তার মানে আন্দোলনকে দমন ও নস্যাত্ করার জন্য ‘ভাগ কর শাসন কর’ সরকারি নীতির বাস্তবায়ন করা। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকগোষ্ঠীর কর্তৃক ভূমি দখল, সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন, আদিবাসীদের অধিকার হরণ এবং দুর্বলকরণ, দমন-নিপীড়নের কোনো বিরোধিতা বা প্রতিবাদ করবে না কেএনএফ। সেটির অর্থও হয় দালালি।
অথচ অতি সম্প্রতি লামায় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ নামে বহিরাগত ভূমি দস্যুরা জবরদখলের উদ্দেশ্যে ত্রিপুরাসহ ম্রো জনগোষ্ঠীর জুম ভূমি ও গ্রাম্য বন প্রকাশ্য দিবালোকে পুড়িয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে-বিদেশে প্রতিবাদ হলেও কেএনএফের ফেসবুক পেইজ আশ্চর্যজনকভাবে যারপরনাই নীরব ও নির্লিপ্ত। যে জনগোষ্ঠীর জন্য সংগ্রাম করছে বলে সংগঠনের ফেসবুক পেইজ প্রতিনিয়ত সরব প্রচারনার ব্যস্ত, সেই জনগোষ্ঠীর দুর্যোগের দিনে সেই জনগোষ্ঠীর জন্য কেএনএফ ফেসবুক পেইজে কোন টু শব্দও নেই। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবতীর্ণ একটা সংগঠনের অবস্থা কতটা মর্মান্তিক, স্ববিরোধী ও ধান্ধাবাজী হলে এমন হয় তা সহজেই বুঝা যায়। এ থেকে সেই জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে নাথান বম ও তার সংগঠন কেএনএফ কতটা সাচ্চা ও আপোষহীন, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
উপরোক্ত প্রেক্ষাপটগুলোর আলোকে বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না যে, নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ-এর কার্যক্রম এবং মিথ্যা, অর্ধসত্য ও প্রতারণামূলক প্রচার শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থে আদিবাসীদের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাত করে আদিবাসীদের আন্দোলন-সংগ্রামকে ক্ষতি করা, চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে ভন্ডুল করা, সর্বোপরি জুম্ম জনগণের মধ্যে জাতিগত সংঘাতকে চাপিয়ে দেয়া। তার মানে নাথান বম ও তাঁর নেতৃত্বাধীন কেএনএফ এর কার্যক্রম এবং কর্মকাণ্ড থেকে কারোই উপকার ও কল্যাণ হচ্ছে না। সেই হিসেবে নাথান বম কোনো শান্তির উদ্যোক্তা নয়, কেএনএফ কোনো অধিকার বা শান্তির জন্য কাজ করছে না। এ বিষয়ে সকলকে সচেতন হতে হবে এবং সকলকে সচেতন থাকতে হবে। তার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম আদিবাসীদের স্বার্থহানিকর সমস্ত কার্যকলাপ থেকে সকলকে বিরত রাখতে হবে।