হিল ভয়েস, ২০ মে ২০২২, রাঙ্গামাটি: পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে অন্যতম স্বাক্ষরকারী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেছেন, সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করবে কী করবে না তার আশায় বসে থেকে লাভ নেই। তিনি বরং পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দের যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব তা কাঁধে নিয়ে আগামী দিনের আন্দোলন কঠোর থেকে কঠোর করার আহ্বান জানান।
আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এর ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাঙ্গামাটিতে আয়োজিত এক ছাত্র-জনসমাবেশে তিনি এইসব কথা বলেন এবং আন্দোলনের আহ্বান জানান।
রাঙ্গামাটি শহরের জিমনেশিয়াম প্রাঙ্গণে এই ছাত্র-জনসমাবেশের আয়োজন করে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ। সমাবেশের শুরুতে জাতীয় সংগীত ও সংগঠনটির দলীয় সংগীত পরিবেশন করে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এর পরই বেলুন উড়িয়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ৩৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও ২৬তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল উদ্ধোধন করেন পাহাড়ের বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মংসানু চৌধুরী। এরপর পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি সুমন মারমা’র সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয় সমাবেশ।
সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিণ, পাহাড়ের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শিশির চাকমা, সাংবাদিক নজরুল কবীর, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক টনিস ম্যাথিউ চিরান, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সহ-সভাপতি রায়হান উদ্দীন প্রমুখ।
প্রধান অতিথি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত যারা এর সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন এবং ত্যাগ স্বীকার করে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় যুক্ত থেকেছেন তাঁদের সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, কাপ্তাই বাঁধের সময়ও পাহাড়ের জুম্ম ছাত্র সমাজ এম এন লারমার নেতৃত্বে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কিন্তু সেসময়ের ঘুণে ধরা সামন্ত নেতৃত্বের কারণে সেই প্রতিবাদ সফল হতে পারেনি। তারই পরে পাহাড়ী ছাত্র সমিতির নেতৃত্বে নতুন করে একটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৯ সালের লংগদু গণহত্যার ঘটনার প্রতিবাদ পাহাড়ের যে ছাত্র-যুব সমাজকে সংঘবদ্ধ করেছিল, তারই ফলে যে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের জন্ম হয়, তার ৩৩ বছরের আন্দোলনের ইতিহাসকে আজকে স্মরণ করতেই হবে।
তিনি বলেন, পাকিস্তান শাসনামলে যে বাস্তবতা, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও একই বাস্তবতা। পাকিস্তান সরকার ব্রিটিশ প্রণীত ১৯০০ সালের শাসনবিধিকে খর্ব করে, কাপ্তাই বাঁধের মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণকে নিশ্চিহ্ন করার কাজকে সম্প্রসারণ করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ শাসনামলে ১৯৭২ সালের সংবিধানে পার্বত্য অঞ্চলের জুম্ম জনগণের স্বতন্ত্র সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে বলা হয় সাংবিধানিকভাবে তারা বাঙালি। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথমে অপারেশন দাবানল এবং ২০০১ সালে অপারেশন উত্তোরণ ঘোষণা করে।
সন্তু লারমা আরো বলেন, আজকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫টি বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। ২৫ বছরেও বাংলাদেশ সরকার এটা অনুভব করে নাই যে, পাহাড়ে ‘অপারেশন উত্তোরণ’ ঘোষণার মাধ্যমে পাহাড়কে যে উপদ্রুত এলাকা করা হয়েছে সেই বিশেষ শাসন প্রত্যাহার করা দরকার। বরং আমরা দেখেছি পাহাড়ে ধীরে ধীরে শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন-বঞ্চনা ও দমন-পীড়ন সেটা সম্প্রসারিত হয়েছে। আমরা এমন একটা অবস্থায় থাকতে বাধ্য হচ্ছি যে, যেখানে হাত-পা থাকলেও, দৃষ্টিশক্তি থাকলেও, বুদ্ধি বিবেচনা থাকলেও, জন্মভূমির প্রতি এবং বসতবাড়ির প্রতি আমাদের মায়া-মমতা থাকলেও আমরা আজকে সেটা কোনোভাবেই প্রকাশ করতে পারছি না।
তিনি বলেন, পার্বত্য চুক্তির বয়স আজ ২৫ বছর হতে চলেছে। তারও আগে থেকে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের লড়াইয়ের সূচনা। তারও আগে ভারত বিভক্তির সময় এবং কাপ্তাই বাঁধের সময়ও পাহাড়ী ছাত্ররা আন্দোলন করেছিল। এখনো পর্যন্ত পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ নিজেদের জন্মভূমি রক্ষা, নিজেদের বসত-ভিটা রক্ষার আন্দোলন করে যাচ্ছে। ৩৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ আরো গভীরভাবে ভাববে এবং এই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তিনি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রমকে সমালোচনা করে বলেন, পার্বত্য চুক্তির সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডকে আঞ্চলিক পরিষদের অধিনস্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করার জন্য বলা হয়েছিল। সরকার সেটা করেনি। বর্তমানে উন্নয়ন বোর্ড পাহাড়ে ইসলামী সম্প্রসারণবাদের জন্য যে কাজ করা দরকার সে কাজ করে যাচ্ছে।
সম্মেলনের উদ্বোধক অধ্যাপক মংসানু চৌধুরী বলেন, ‘পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ শুধুমাত্র একটি সংগঠন নয়, এই সংগঠন অধিকারহারা জুম্ম জনগণের আশা-প্রত্যাশা। জুম্ম জনগণের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে জুম্ম জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। জুম্মদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য ছাত্র সমাজকে অধিকতর সংগ্রামী ও সোচ্চার হতে হবে।’
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমি আজকে যে এক নারী তার পেছনে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নানা অবদান জড়িয়ে আছে। আমার জীবন, জীবনের ঔদার্য, জীবনের মাহাত্ম্য আমি পাহাড়ের মানুষের কাছ থেকে শিখেছি।’
তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যারা বলে বেড়ায়, এদেশে আদিবাসী নেই তাদের এই অঞ্চলে জায়গা দিতে নেই। আপনাদেরও নেতা চিনতে হবে। যারা আপনাদের নিপীড়নের প্রতিবাদ করবে না তাদের সঙ্গে থাকবেন না। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এই অঞ্চলের মানুষকে বুঝিয়েছেন যে, মুক্তি ছাড়া পথ নেই।’
ঢাবি’র এই অধ্যাপক আরো বলেন, ‘রাষ্ট্র শুধু দালানকোঠা, রাস্তাঘাট দিয়ে উন্নয়ন মাপে। আজকে রাস্তা হলে আপনি আসবেন, কাল আরো দশজন আসবে, পরশু আর্মি-সেনাবাহিনীতে ভরবে। সাজেকে লুসাইদের পোশাকে ছবি না তুলে প্রশ্ন করতে হবে সেই লুসাইরা উচ্ছেদ হয়ে কোথায় গেলো! এছাড়া আদিবাসী দিবসের আগে আমাদের ডিপার্টমেন্টে চিঠি আসে যেন ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করার জন্য।’ যে শিক্ষা ব্যবস্থায় আদিবাসী ছেলেমেয়েরা পড়ছে সে ব্যবস্থায় বন-প্রকৃতি-ভাষা-সংস্কৃতির উপস্থিতি কতটুকু বলেও প্রশ্ন করেন তিনি।
বিশিষ্ট সাংবাদিক নজরুল কবীর বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির এক রজত হতে চললো। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন। তিনি চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের কথা দিয়েছিলেন কিন্তু কথা রাখেননি। ছাত্র সমাজকে অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে হবে। সরকার একদিকে মানবিকতা দেখাচ্ছে, অপরদিকে উন্নয়নের নামে ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণ করে ম্রোদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করছে। সরকার যদি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে তার রাজনৈতিক সদিচ্ছা কাজে লাগাতে চায় তাহলে এখনো সময় আছে।’
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শিশির চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যা সমাধানে সরকার এখনো পদক্ষেপ নেয়নি। লামায় জুম্মদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস জুমকে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ করার কারণে জুম্ম জনগণের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শত শত ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে কিন্তু গণমাধ্যমে আসছে না। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ে লড়াকু ছাত্র সংগঠন। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজকে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে।’
আদিবাসী যুব ফোরামের সাংগঠনকি সম্পাদক টনি ম্যাথিউ চিরান বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনো ফ্যাসিবাদী কায়দায় দমন-পীড়ন অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত নির্মূলীকরণের কাজটি খুব সূচারুরূপে করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। তারই বিরুদ্ধে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ রাজপথে সদা সোচ্চার ছিল এবং আছে। পিসিপি’র এই লড়াইয়ের সাথে সমতলের আদিবাসী ছাত্র-যুবরা সবসময় পাশে ছিল এবং আগামী দিনের লড়াইয়েও পাশে থাকবে।’ তিনি বাংলাদেশের আপামর গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক ভাবনার মানুষদেরকে পাহাড়ের জুম্ম জনগণের আন্দোলনে সামিল হওয়ার উদাত্ত আহন জানান।
সমাবেশে ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার বেহাল দশা। বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এখনো অসাম্প্রদায়িক হতে পারেনি। অন্যদিকে পাহাড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সবকিছু গিলে খাওয়া হয়েছে। তার উপর পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ করে জুম্মদেরকে উচ্ছেদের য়ড়যন্ত্র চলমান।’ এই পাঁচতারকা হোটেল নির্মাণ না করে পাঁচ তারকা হাসপাতাল নির্মাণের আহ্বান জানান তিনি।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সহ-সভাপতি রায়হান উদ্দীন বলেন, ‘শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের লড়াই। এই লড়াইয়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাথে সর্বদা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট পাশে থাকবে।’
সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক জগদীশ চাকমা। তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবে পাহাড়ের জুম্ম জনগণের উপর যে ধরনের দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে তার প্রতিবাদেই মূলত পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের জন্ম। শাসক গোষ্ঠীর দমন-পীড়ন এবং নির্যাতন এখনো অব্যাহত রয়েছে। সেই অব্যাহত নিপীড়নের বিরুদ্ধে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ আজকের সমাবেশের মধ্য দিয়ে আগামী দিনের আন্দোলন জোরদার করার শপথ নিতে চাই।’ জুম্ম জনগণের মুক্তির সনদ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে যাবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এই ছাত্র নেতা।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি সুমন মারমা’র সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সমাবেশটি শেষ হয়। সমাবেশ শেষে একটি মিছিল জিমনেশিয়াম থেকে শুরু হয়ে বনরূপা পেট্রোল পাম্প ঘুরে এসে পুনরায় জিমনেশিয়াম প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয়।