হিল ভয়েস, ২৬ এপ্রিল ২০২২, মধুপুর: মধুপুরে সরকারের বনবিভাগ কর্তৃক আদিবাসীদের চাষের জমি বেদখল করে কৃত্রিম হ্রদ খননের কাজ প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন আদিবাসীদের বিভিন্ন সংগঠন ও জনগণ।
গতকাল ২৫ এপ্রিল ২০২২ সকাল ১১:০০ টায় আদিবাসীদের ভূমি বেদখল করে হ্রদ খনন করার পরিকল্পনার প্রতিবাদে ‘সম্মিলিত আদিবাসী জনতা’র ব্যানারে মধুপুরের দৌখলা চৌরাস্তায় অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে এই প্রতিহতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
জয়েনসাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সাবেক সভাপতি অজয় এ মৃ’র সভাপতিত্বে ও গারো স্টুডেন্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক লিয়াং রিছিলের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন প্রস্তাবিত লেক (হ্রদ) খনন প্রকল্প এলাকার জমির মালিক মুকুল দারু, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠনের (বাগাছাস) কেন্দ্রীয় সভাপতি জন জেত্রা, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ, আদিবাসী যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক টনি ম্যাথিউ চিরান। সমাবেশে বিভিন্ন গ্রাম প্রায় ৫ শতাধিক লোকজন অংশগ্রহণ করেন।
প্রতিবাদ সমাবেশে বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠনের (বাগাছাস) সভাপতি জন জেত্রা বলেন, ‘কৃষি জমি নষ্ট করে বিনোদনের নামে লেক খনন এ কেমন উন্নয়ন? আমরা আমাদের চোখের জলের ওপর কাউকে প্রমোদ তরী চালাতে দেব না। জীবন থাকতে আমরা আমাদের কৃষিজমির এক ইঞ্চি মাটিও ছাড়বো না।’
বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলীক মৃ বলেন, ‘বন বিভাগ সৃষ্টির আগে থেকেই আদিবাসীরা এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। নিজেদের জীবন-জীবিকার জন্য এই জমিতে চাষবাস করে আসছে। বন বিভাগ কোন অধিকারে আদিবাসীদের কৃষি জমিতে সাইনবোর্ড টানিয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে। ভূমি রক্ষার আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য আদিবাসী নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা করে আমাদের ন্যায্য আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখতে পারবেন না। বরং আদিবাসীদের ওপর যত মামলা-হামলা করবেন ততই আমাদের আন্দোলন দাবানলে পরিণত হবে।’
বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক টনি ম্যাথিউ চিরান বলেন, ‘উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের কৃষি জমিতে যদি লেক খনন করতে যান তাহলে সেটি হবে আগুনের ওপর ঘি ঢালার মত। আদিবাসীরা উন্নয়নের বিরোধী না। কিন্তু অমানবিক উন্নয়নের বিরোধী। আমাদের জীবিকার ওপর লেক খনন করার চেষ্টা করলে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। অবিলম্বে দুর্নীতিবাজ বন কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করতে হবে। লেক খনন পরিকল্পনা বাতিল করতে হবে।’
জমির মালিক এবং জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি পরেশ চন্দ্র মৃ’র মেয়ে মুকুল দারু তার বক্তব্যে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু এই দোখলা আর চুনিয়ায় এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে গিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন মধুপুর বনের আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হবে না। অথচ আজকে বন বিভাগ আমাদের কৃষি জমিতে বিনোদনকেন্দ্র করার নামে লেক করার ষড়যন্ত্র করছে। আমাদের জমিতে সাইনবোর্ড টানিয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল বলছে। কবে এই জমি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ছিল। আমরা তো বহু বছর ধরে বংশপরম্পরায় এখানে চাষবাস করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছি। আমরা জমির মালিকরা আমাদের জমিতে কৃত্রিম লেক খনন করতে দেব না। এতে রক্ত দিতে হলে দেব।’
সমাবেশের একপর্যায়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছরোয়ার আলম খান সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন। তিনি লেক খনন ইস্যুকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের যাতে ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য সবাইকে আহ্বান জানান। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সভাপতির বক্তব্যে গারো নেতা অজয় এ মৃ বলেন, ‘শত শত বছরের বংশপরম্পরায় আমরা আমাদের ভূমিতে চাষবাস করে জীবিকা নির্বাহ করছি। কিন্তু বন বিভাগ প্রায় সময় উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের ভূমি দখল ও উচ্ছেদের চেষ্টা করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের কৃষি জমিতে কোনোভাবেই লেক খনন করতে দেব না।’
সমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই দোখলা চৌরাস্তা এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশও সেখানে অবস্থান নেয়। সমাবেশ চলাকালে মধুপুর থেকে উপজেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের শতাধিক নেতা-কর্মী মোটরসাইকেল বহর নিয়ে সেখানে অবস্থান নেন। তাঁরা ওই এলাকায় কয়েক দফা মহড়াও দেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বনাঞ্চলের দোখলা ও চুনিয়া গ্রামের মাঝামাঝি এলাকায় আমতলী বাইদ নামক স্থানে ৪৫ বিঘা জমিতে ১৩ জন গারো জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বংশপরম্পরায় চাষাবাদ করছেন। ওই বাইদ এলাকার চার একর জমির মধ্যে লেক খননের উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ। কিন্তু ওই জমির মালিকেরা সেখানে লেক খনন করতে সম্মত হননি। এ নিয়ে বন বিভাগ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে জমির মালিকদের কয়েক দফা বৈঠকও হয়।
গত ২২ এপ্রিল ২০২২ বন বিভাগের দোখলা রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয়ের কর্মীরা ওই জমিতে একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেন। সেখানে লেখা ছিল, ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল, সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ, উন্নয়নমূলক কাজ চলমান, আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ’। এই সাইনবোর্ড দেখার পর স্থানীয় গারো জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। গত ২৩ এপ্রিল ২০২২ রাতে কে বা কারা ওই সাইনবোর্ডটি ভেঙে ফেলে। এ ঘটনায় বন বিভাগের দোখলা রেঞ্জ কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন বাদী হয়ে রোববার বিকেলে মধুপুর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। ষড়যন্ত্রমূলক কয়েকজন আন্দোলনকারীকে অভিযুক্ত করা হয়।