হিল ভয়েস, ৯ এপ্রিল ২০২২, বান্দরবান: আজ আবারও বান্দরবান পার্বত্য জেলাধীন লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে রাবার কোম্পানির নামে বহিরাগত মুসলিম বাঙালি ভূমিদস্যুদের কর্তৃক আদিবাসী জুম্মদের তিনটি গ্রামের প্রায় ৪০০ একর পরিমাণ ভূমি ও বাগান বেদখলের চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভূমিদস্যুরা দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকার প্রধান অবলম্বন এইসব ভূমি বেদখলের চেষ্টা চালিয়ে আসছে।
আজ (৯ এপ্রিল ২০২২) আবার সকাল ৯:০০ টার দিকে শতাধিক বহিরাগত বাঙালি লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঐ এলাকায় এসে জুম্মদের লাগানো শত শত গাছ কেটে দেয় ও জঙ্গল পরিষ্কার করে। আদিবাসীরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাদেরকে হামলার চেষ্টা করে, মেরে ফেলার হুমকি দেয় এবং একজন আদিবাসী জুম্মকে মারতে পারলে তারা দশ লাখ টাকা পাবে বলেও উল্লেখ করে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সরই ইউনিয়নের দুলুছড়ি মৌজার ৪নং ওয়ার্ডের লাংকম ম্রো কার্বারি পাড়া, রেংয়েন ম্রো কার্বারি পাড়া ও জয়চন্দ্র ত্রিপুরা কার্বারি পাড়ায় ৩৯ পরিবারের প্রায় ২০০ নারী-পুরুষ বসবাস করে আসছেন। তাদের গ্রামের প্রায় ৪০০ একর ভূমিতে তারা বংশপরম্পরায় জুমচাষ ও বাগান-বাগিচা করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কিন্তু ২০১৯ সালে হঠাৎ লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজ নামের একটি কোম্পানী রাবার প্লটের নামে জুম্মদের ঐসব ভূমি দখলে নেয়ার অপচেষ্টা শুরু করে। এসময় গ্রামবাসীরা বাঁধা দিলে, কোম্পানির লোকেরা জুম্মদের মামলা, হামলা, খুন ও পুলিশের ভয় দেখায়। তখন থেকে কোম্পানির লোকেরা একাধিকবার শ্রমিক এনে জুম্মদের ঐ ভূমি বেদখলের চেষ্টা করে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ এর উপ-পরিচালক মোঃ কামাল উদ্দিন জুম্মদের ভূমি দখলের জন্য আজ নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারি ও কক্সবাজার এলাকা থেকে ১০০ জনের অধিক সশস্ত্র রোহিঙ্গা ও বাঙালি মুসলিম নিয়ে আসেন। স্থানীয় জুম্মরা বাধা দেয়া সত্তেও ওই বহিরাগত ভূমিদস্যুরা জুম্মদের গাছ কেটে দেয় ও জঙ্গল পরিষ্কার করে। জানা গেছে, এই ভূমি বেদখলের চেষ্টায় নেতৃত্ব দেয় লিডার নুরু নামের এক সন্ত্রাসী ও মস্তান।
স্থানীয় আদিবাসীদের অভিযোগ, লামা রাবার ইন্ড্রাষ্টিজ নামের একটি কোম্পানীর লোকেরা জুম্মদের ভূমি দখলের উদ্দেশ্যে গত কয়েকদিনে শত শত বনজ, ফলদ গাছ কেটে দেয় ও একটি খামার ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এ ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগও করা হয়। বর্তমানে ভূমিদস্যুদের হুমকিতে ভীত তিন পাড়ার সবাই। এসব বিষয়ে গ্রামবাসী প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে জায়গা জবরদখল বিষয়ে আবেদন করে আসলেও কোন সূরাহা হয়নি বলে পাড়াবাসীর অভিযোগ। জায়গা বেদখলকে কেন্দ্র করে যে কোন মুহূর্তে দুই পক্ষের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
গ্রামবাসীদের একটি সূত্র জানায়, ঐ ভূমি বেদখলের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সেনামদদপুষ্ট সংস্কারপন্থীরা রাবার কোম্পানির উপ-পরিচালক মোঃ কামাল উদ্দিনের কাছ থেকে একটি মোটা অংকের টাকা নিয়েছে। লাংকম ম্রো কার্বারি পাড়ার কার্বারি লাংকম ম্রো ঐ টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা ভাগ পেয়েছে।
অপরদিকে সরই মৌজা হেডম্যান দূর্যধন ত্রিপুরা ও মৌজা হেডম্যানের সাবেক মুহুরী হাজিরাম ত্রিপুরার মদদে রাবার কোম্পানি এসব জায়গা জবর দখলের সাহস পাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন গ্রামবাসী। তবে অভিযুক্ত দূর্যধন ত্রিপুরা বলেন, আমি একজন হেডম্যান হয়ে কোম্পানিকে মদদ দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।
গ্রামবাসীরা জানান, গত ২০-২৫ দিনে শতাধিক শ্রমিক লাগিয়ে প্রায় ২৫০-৩০০ একর জায়গার জঙ্গল ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছ জোরপূর্বক কেটে ফেলেছে কোম্পানীর লোকজন।
মেনসিং ম্রো ও মেনরাও ম্রোসহ কয়েকজন গ্রামবাসী অভিযোগ করেন, ভূমি দখলকারীরা তাদের ভয়ভীতি ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এই কাজ করছে। ঐ এলাকা থেকে কাঠ, বাঁশ, লাকড়ি সংগ্রহ করতেও জুম্মদের বাধা দিচ্ছে ভূমিদস্যুরা। গাছ ও জঙ্গল কেটে তাতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। জঙ্গল কাটার সময় রোহিঙ্গা ও বহিরাগত বাঙালি শ্রমিকরা লাঠিসোটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিয়ে থাকে এবং পাশাপাশি মদ জুয়ার আড্ডা বসায় সেখানে।
তারা আরো জানায়, কোম্পানির জবরদখলের কারণে এখন বাকী আছে শুধু পাড়ার বাড়ির জায়গাগুলো। লোকজন গ্রামের বাইরে গরু-ছাগল চরাতে গেলে ভূমিদ্যুরা বাধা দেয়। তারা প্রশ্ন করেন, জুমচাষ করতে না পারলে, চলাচল করতে না পারলে, গরু-ছাগল পালতে না পারলে আমরা খাব কী? নিরুপায় হয়ে কি পাড়া ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে?
গ্রামবাসী অনারাম ত্রিপুরা বলেন, ৪৫ বছর ধরে ৩০৩নং ডলুছড়ি মৌজাস্থ নিজেদের জায়গায় জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। অথচ এত বছর পরে কোম্পানির লোকজন এসে বলছে, এসব জায়গা তাদের।
তিনি বলেন, এই জুমচাষ ছাড়া আমাদের চলার কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই। যে কোন মুহূর্তে কোম্পানির লোকজন আমাদের উপর হামলা করতে পারে। ঐ জায়গা-জমির মধ্যে রোপিত বাঁশ-গাছ কাটা ও চাষাবাদের কাজে কোম্পানির লোকজন বাধা দিচ্ছেন।
লাংকম পাড়ার কার্বারি লাংকম ম্রো বলেন, যুগ যুগ ধরে গ্রামগুলোর আশপাশের জায়গাতে জুমচাষ করে আসছেন পরিবারগুলো। এখন লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ সেগুলো দখল করার চেষ্টা করছে। গত বছরও ১০০ একরের মত দখল করেছে। এ বছরও দখলের উদ্দেশ্যে ২৫০ থেকে ৩০০ একর জায়গার জঙ্গল ও গাছ কেটে পরিষ্কার করেছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপক আরিফ হোসেন বলেন, কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারগণের নামে ১৯৮৮-৮৯ সালে রাবার বাগানের জন্য ইজারা নেওয়া জমিতে এতদিন ম্রো ও ত্রিপুরারা অবৈধভাবে বসবাস করছেন। তাদের নামে কোন বন্দোবস্তি বা বৈধ কাগজপত্র নেই।
এ বিষয়ে ডলুছড়ি মৌজা হেডম্যান যোহন ত্রিপুরা জানান, লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজের লোকজন যে জায়গাগুলো পরিষ্কার করছে, মূলত সে জায়গাগুলো লাংকম কার্বারি পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা কার্বারি পাড়া ও রেংয়েন ম্রো কার্বারি পাড়াবাসীর। তারা বংশ পরম্পরায় ওই জায়গায় জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। মাঝখানে যখন আমার হেডম্যানশিপ ছিল না, তখন এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোম্পানি ওইসব জায়গা জবরদখল শুরু করেন।
এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত, আগামীকাল ১০ এপ্রিল ২০২২ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এসিল্যান্ড কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি টিম তদন্তের জন্য ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাবেন বলে জানা গেছে।