হিল ভয়েস, ২৯ মার্চ ২০২২, ঢাকা: বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে আদিবাসী নারীদের প্রতি ক্রমাগত নির্যাতন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এবং বিচারহীনতার কারণে অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে অপরাধীরা একই ঘটনা বারবার ঘটানোর সাহস পায় বলে বলে গবেষণার ফলাফলে উঠে এসেছে।
আজ মঙ্গলবার (২৯ মার্চ) মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক ও কাপেং ফাউন্ডেশন এর যৌথ উদ্যোগে রাজধানীর ডেইলি স্টার আজিমুর রহমান কনফারেন্স হল-এ ‘বাংলাদেশে আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতা: কারণ, ফলাফল ও আইনি সহায়তা’ শীর্ষক একটি গবেষণার ফলাফল নিয়ে একটা আলোচনা সভায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা জাহেদ হাসান-এর সঞ্চালনায় এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও লেখক সোহরাব হাসান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপ-পরিচালক গাজী সালাহউদ্দিন ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা। গবেষণার প্রতিবেদন তথ্য উপস্থাপন করতে গিয়ে তিনি বলেন, অন্যান্য জেলার তুলনায় তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যে গত ১০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল ও গারো নারীরা সহিংসতার শিকার হয়েছে বেশি।
তিনি প্রতিবেদনের তথ্য দিয়ে বলেন, বিচারহীনতার কারণে অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে অপরাধীরা একই ঘটনা বারবার ঘটানোর সাহস পায়। এছাড়া সচেতনতার অভাব, ভাষাগত সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যা, নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক চাপ প্রভৃতি কারণে ঘটনার শিকার নারী বা কন্যাশিশু ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্থ হয়। প্রতিবেদনে তিনটি সুপারিশ এর কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হল- ভিক্টিমকে সাপোর্ট করা, সেটি পরামর্শ থেকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা পর্যন্ত হতে হবে; আইনি সহায়তা প্রদান করা এবং সবশেষে প্রতিরোধ হিসেবে প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রান্তিক পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করা।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে শাহীন আনাম বলেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন দীর্ঘদিন আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করছে। কাপেং ফাউন্ডেশন ও আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সাথে এই গবেষণাটিও সেই কাজেরই অংশ। এই গবেষণার ফলাফল যা-ই হোক না কেন, এটা আমাদের মনে রাখতে হবে এটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয় বরং রাষ্ট্রকে সহযোগিতার জন্য এটি সবার সাথে তথ্য বিনিময় হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, কেউ-ই নিরাপদ নয়, সেখানে আদিবাসী নারীরা আরো বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছে। মূলত ন্যায় বিচার পাওয়ার আইনি প্রক্রিয়াটাই নারী বান্ধব নয়, ফলে আদিবাসী বা প্রান্তিক নারী আরো বৈষম্যের শিকার হয়।
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের আদিবাসীদের এখনো সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি হয়নি। সে জায়গায় এ ধরনের গবেষণা ভবিষ্যতে আইন প্রণেতা ও শিক্ষাবিদদের কাজে লাগবে। এই প্রতিবেদনটি বলছে বিচারহীনতা সংস্কৃতির কারণে আদিবাসী নারীরা কী নাজুক অবস্থায় আছে। তিনি বলেন, আমাদের কন্ঠস্বর যেন প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে পৌঁছুতে পারে, সেজন্যে আমাদের আরও কাজ করা দরকার। সেই সাথে আদিবাসীদের প্রতি তাদের জীবনধারার প্রতি আমাদের যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সেটিও আমাদের পরিবর্তন করতে হবে বলে তিনি বলেন। তিনি কোয়ালিশনের মাধ্যমে সবার সাথে সেতুবন্ধন তৈরির কথা বলেন।
ড. সাদেকা হালিম বলেন, মনস্তাত্বিকভাবে ভিক্টিম ব্লেমিং বা ঘটনার শিকার নারীকে দোষারোপ করা আমাদের খুব সহজাত বৈশিষ্ট্য। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আদিবাসী নারীরা নারী হওয়ার কারণে ও প্রান্তিকতার কারণেও আদিবাসী নারীরা বৈষম্যর শিকার হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
গাজী সালাহউদ্দিন জানান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ন্যাশনাল ইনকোয়ারি খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দেয়া হবে।
সঞ্জীব দ্রং বলেন, আদিবাসী নারীদের প্রতি দিন দিন নির্যাতন বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে অনেক ভাল ভাল আইন আছে, কিন্তু বাস্তবে এগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এছাড়া তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতার মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেড়ে চলেছে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সকলকে একসাথে আন্দোলন করার জন্য আহ্বান জানান এবং সমস্যায় পড়লে আইনি সহায়তা প্রাপ্তির পন্থাগুলোও আমাদের জানতে হবে বলে উল্লেখ করেন।
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, রাষ্ট্র নারীবান্ধব নয়। আদিবাসী নারীর প্রতি যে সহিংসতা সেটা মূলত সম্পদ দখল করার জন্য শেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিনি আরও বলেন, বাইরের দেশের মানুষের মানবাধিকার লংঘন হলে আমরা সেটা নিয়ে কথা বলি, কিন্তু আমার দেশের প্রান্তিক মানুষেরা, আদিবাসীরা যে নির্যাতনের শিকার হয় তাতে আমরা নিশ্চুপ থাকি। তিনি ক্ষমতার দৌরাত্ম বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানান। সেই সাথে নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করতে হবে বলে মন্তব্য প্রকাশ করেন।
মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অজয় এ মৃ, চঞ্চনা চাকমা, নমিতা চাকমা, সাবিত্রী হেমব্রম, নিও প্রু মারমা, লালসা চাকমা, বিচিত্রা তির্কী, হরেন্দ্র নাথ সিং, পলাশ পাহান ও নিশি ত্রিপুরা প্রমুখ ব্যক্তিরা স্থানীয় পর্যায়ের আদিবাসী নারীদের অবস্থা তুলে ধরেন।