হিল ভয়েস, ২৮ মার্চ ২০২২, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক জুম্মদের ভূমি বেদখল করে সেনা ক্যাম্প স্থাপনের পাঁয়তারা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একতরফাভাবে উক্ত ভূমিতে ‘নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য নির্ধারিত স্থান’ বলে সাইন বোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে বসবাসকারী জুম্ম পরিবারসমূহকে জায়গাটি ছেড়ে দিতে হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ মার্চ ২০২২ সকাল আনুমানিক ১০:৪৫ টায় লংগদু সেনা জোনের অধীন দুরছড়ি বাজার সেনা ক্যাম্পের একদল সেনা সদস্য বাঘাইছড়ির সারোয়াতলী ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের উত্তর খাগড়াছড়ি (মেদেনীপুর) গ্রামে এসে জুম্মদের জায়গাতে ও বসতবাড়ির পাশেই ‘উত্তর খাগড়াছড়ি আর্মি ক্যাম্প’ এর নির্ধারিত স্থান বলে সাইনবোর্ড টাঙায়। সাইনবোর্ডে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য নির্ধারিত স্থান’, ‘উত্তর খাগড়াছড়ি আর্মি ক্যাম্প’, ‘উক্ত স্থানে কোনো প্রকার মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, গির্জা, কেয়াং ঘর বা অন্য কোনো প্রকার স্থাপনা নির্মাণ করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ও দন্ডনীয় অপরাধ’ এবং ‘আদেশক্রমেঃ লংগদু জোন’।
এছাড়া সেনাবাহিনীর দলটি সেইদিন সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের হুমকি দিয়ে বলে যে, যারা সেখানে বাড়ি নির্মাণ করেছে তাদেরকে জায়গাটি ছেড়ে দিতে হবে।
জানা গেছে, সেনাবাহিনী যে জায়গায় ‘উত্তর খাগড়াছড়ি আর্মি ক্যাম্প’ বলে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে, সেই জায়গাটি তিন জুম্ম গ্রামবাসীর নামে রেকর্ডভুক্ত রয়েছে। জায়গাটির মালিকরা হলেন- (১) চন্দ্র চাকমা, যার নামে .৫০ শতক রেকর্ডভুক্ত রয়েছে, (২) লক্ষীধন চাকমা, যার নামে ২.০০ একর রেকর্ডভুক্ত রয়েছে ও (৩) শুক্রচার্য চাকমা, যার নামে রেকর্ডভুক্ত রয়েছে .৫০ শতক।
বর্তমানে ঐ জায়গাটিতে ১৬টি জুম্ম পরিবার বসবাস করছে বলে জানা গেছে। উক্ত পরিবারগুলি হল- (১) সোনাধন চাকমা, পিতা-ধনঞ্জয় চাকমা, (২) ধর্মধন চাকমা, পিতা-তেরা চাকমা, (৩) বিমল চাকমা, পিতা-প্রভাত চন্দ্র চাকমা, (৪) মধু জীবন চাকমা, পিতা-রিজার্ব কুমার চাকমা, (৫) সুরেশ কুমার চাকমা, পিতা-মঙ্গল ধন চাকমা, (৬) চিত্তি রঞ্জন চাকমা,পিতা- মনচান চাকমা, (৭) সুমন চাকমা, পিতা-চিত্তি রঞ্জন চাকমা, (৮) জ্ঞান রঞ্জন চাকমা, পিতা-মুতু রায় চাকমা, (৯) বৃষকেতু চাকমা, পিতা-সংঘসুর চাকমা, (১০) সত্যবান চাকমা, পিতা-মঙ্গল চান চাকমা, (১১) টনু চাকমা, পিতা-ধন চাকমা, (১২) বেলটক চাকমা, পিতা-পাদল্য চাকমা, (১৩) বিনোদ বরন চাকমা, পিতা- শশী মোহন চাকমা, (১৪) চন্দ্র চাকমা, পিতা-ঐ, (১৫) রিপন চাকমা, পিতা-চন্দ্র চাকমা ও (১৬) মাতৃ চাকমা, পিতা-সমর চাকমা।
স্থানীয় সূত্রে আরো জানা গেছে, গত ৮ আগস্ট ১৯৮৮ সেনাবাহিনী ও বাঙালি সেটেলারদের কর্তৃক সারোয়াতলী ইউনিয়নের খাগড়াছড়ি এলাকা ও দুরছড়ি বাজারে নিরীহ জুম্মদের উপর এক বর্বব হত্যাকান্ড চালানো হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে যা বাঘাইছড়ি বা দুরছড়ি গণহত্যা নামে পরিচিত, যেখানে অন্তত ৫৩ জন নিরীহ জুম্মকে গুলি করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়।
ঐ হত্যাকান্ডের ফলে এলাকার জুম্ম জনগণ প্রাণ বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গেলে, ঐ দিনই সেনাবাহিনী ঐ জায়গাটিতে সেনা ক্যাম্প স্থাপন করে। তবে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর চুক্তি মোতাবেক প্রত্যাহার করা হয়। এরপর ১৯৮৮ সালে উদ্বাস্তু হওয়া কিছু জুম্ম পরিবার সেখানে আবার ঘরবাড়ি তুলে বসতিস্থাপন শুরু করে। সেনাবাহিনী ঐ জায়গাটি বেদখল ও সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে তাদেরকে আবার নিজেদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করতে চাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় অধিবাসীরা।
বিজিবিও একই কায়দায় ভূমি বেদখল ও ক্যাম্প স্থাপন করতে চাইছেঃ
ঐ এলাকার পার্শ্ববর্তী একই ইউনিয়নের পূর্ব হীরাচর গ্রামেও একই কায়দায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কর্তৃক এক জুম্মর ভূমি বেদখল করে ক্যাম্প স্থাপন করার পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঐ ভূমির ভুক্তভোগী মালিক রসিক চন্দ্র চাকমা, পিতা-নবীন চন্দ্র চাকমা।
জানা গেছে, ১৯৮৮ সালের ৮ আগস্ট সংঘটিত ঐ গণহত্যার পর রসিক চন্দ্র চাকমাও উদ্বাস্তু হন এবং অন্যত্র পালিয়ে যান। এর পরপরই তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) রসিক চন্দ্র চাকমার রেকর্ডভুক্ত উক্ত ভূমি বেদখল করে ক্যাম্প স্থাপন করে। চুক্তির পর ঐ ক্যাম্পটিও প্রত্যাহার করা হলে রসিক চন্দ্র চাকমা তার জায়গাটিতে ফিরে আসেন এবং সেখানে বসতি ও ফলজ বাগান গড়ে তোলেন। গত জানুয়ারি মাসে লংগদুর ৩৭ বিজিবি রাজানগর জোনের একদল বিজিবি সদস্য এসে একই ধরনের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়ে যায় এবং জায়গার মালিককে হুমকিমূলক কথাবার্তা বলে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জায়গার মালিক বলেন, ‘আমরা কতবার উদ্বাস্তু হবো, এবার মরলে নিজ জায়গাতে নিজ ভূমিতে আমি মরবো। তবু আমাদের জায়গা ভিটেমাটি দিতে পারব না।’