হিল ভয়েস, ২৫ মার্চ ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদনঃ
আজ ২৫ মার্চ ২০২২, কাউখালী গণহত্যার ৪২ বছর। পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জুম্মদের উপর সংঘটিত অন্যতম বর্বরতম পাশবিক গণহত্যা এটি। ১৯৮০ সালের এই দিনে বর্তমান রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন কাউখালী উপজেলার কলমপতি ইউনিয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক স্থানীয় নিরীহ নিরস্ত্র জুম্মদের উপর এই গণহত্যা চালানো হয়। ‘কাউখালী গণহত্যা’ ছাড়াও অনেকের কাছে এটি ‘কলমপতি গণহত্যা’ হিসেবেও পরিচিত। এই গণহত্যায় অন্তত ৩০০ জুম্ম নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয় বলে হিসাব করা হয়। অনেক জুম্ম নারী ধর্ষণের শিকার হয় বলে ধারণা করা হয়।
ঐদিন সকালের দিকে সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে ও ঠান্ডা মাথায় সেনাবাহিনী ও মুসলিম সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক প্রায় একই সময়ে প্রথমে কাউখালী বাজারে ও স্থানীয় পোয়াপাড়া বৌদ্ধ বিহারে আগত জুম্মদের উপর হামলা চালানো হয়। এর পরপরই কাউখালী বাজারের চতুর্দিকে অন্তত ২৪টি জুম্ম গ্রামে হামলা চালিয়ে জুম্মদের খুন ও আহত করা হয়, বাড়িতে লুটপাট চালানো হয় এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে অন্তত ৯টি বৌদ্ধ বিহারে লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, কাউখালী বাজার সেনা ক্যাম্পের কম্যান্ডার ক্যাপ্টেন কামাল নামে এক সেনা কর্মকর্তার নির্দেশে সকাল ৮:০০ টার দিকে এলাকার আইন-শৃঙ্খলা সমস্যা বিষয়ে আলোচনার জন্য স্থানীয় আদিবাসী জুম্ম নেতা ও গ্রামবাসীরা কাউখালী বাজারে জমায়েত হন। প্রায় একই সময়ে ঐ সেনা কর্মকর্তা বিহার পুনর্গঠনের কথা বলে আশেপাশের ধর্মপ্রাণ জুম্মদের কাউখালী বাজারের অনতিদূরে পোয়াপাড়া বৌদ্ধ বিহারে উপস্থিত থাকার পরামর্শ দিলে কয়েকশ জুম্ম সেখানেও সমবেত হন।
সকাল ৯:০০ টার দিকে হঠাৎ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল কাউখালী বাজারে আসে এবং সেখানে সমবেত হওয়া জুম্মদের উপর এলোপাতাড়ি ব্রাশ ফায়ার করে। এতে কাউখালী বাজার চৌধুরী কুমুদ বিকাশ তালুকদার (৬০) ও পোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় কমিটির সভাপতি শশী দেব চাকমাসহ অনেক জুম্ম ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
প্রায় একই সময়ে সেনাবাহিনীর আরেকটি দল পোয়াপাড়া বৌদ্ধ বিহারে উপস্থিত হয়ে সেখানে সমবেত নিরীহ জুম্মদের উপর সশস্ত্র হামলা চালায়। সেনাবাহিনী প্রথমে উপস্থিত জুম্ম নারী-পুরুষকে বিহারের প্রাঙ্গণে লাইন করে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়। এরপরপরই সেনারা জুম্মদের পাখির মত গুলি করে হত্যা করে তাদের পাশবিক তৃষ্ণা চরিতার্থ করে। সেনাবাহিনী ও বাঙালি সেটেলাররা বুদ্ধমূর্তিসহ পোয়াপাড়া বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করে দেয়। এরপর তারা জুম্মদের মৃতদেহগুলো পোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম কোণে গণকবর দেয়। এই অবস্থায় সামাজিক রীতি বা ধর্মীয় বিধি অনুসরণ করে মৃতদেহগুলো সৎকারের ব্যবস্থা করার জুম্মদের পক্ষে কোনো বাস্তবতা ছিল না। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া গুরুদাস চাকমা নামে এক ব্যক্তি ঐ ঘটনা ও গণকবর দেয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন।
কাউখালী বাজারে ও পোয়াপাড়া বৌদ্ধ বিহারে হত্যাযজ্ঞের পরপরই সকাল প্রায় ১০:০০ টার দিকে সেনাবাহিনীর ও ধারালো অস্ত্রে সজ্জিত মুসলিম বাঙালি সেটেলাররা একসাথে আশেপাশের জুম্ম বসতিতে হামলা শুরু করে। এসময় সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালিরা একে একে চেলছড়ামুখ পাড়া, হেডম্যান পাড়া, টংগাপাড়া, বেতছড়ি, কচুখালিমুখ পাড়া, রাঙেপাড়া, পোয়াপাড়া, ছোটডুলু, বড়ডুলু, ত্রিপুরাদীঘি পাড়াসহ অন্তত ২৪টি জুম্ম গ্রামে হামলা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী ধর্ষণ চালায়। কেবল কচুখালিমুখ পাড়া, বেতছড়ি, রাঙেপাড়া, ছোটডুলু ও বড়ডুলু এই পাঁচটি গ্রামেই প্রায় ৪০০ পরিবার এই হামলার শিকার হয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রায় ৩০-৩২ জন জুম্ম নারীকে জোরপূর্বকভাবে সেনাক্যাম্পে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। সন্ধ্যার দিকে বয়স্ক ও শিশুদের ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে তরুণ বয়স্ক নারীদের ৪-৫ দিন ক্যাম্পে আটক করে রাখা হয়।
এলাকার হেডম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজার বাড়িতেও একইভাবে লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। তাঁর বাড়ির বৌদ্ধ মন্দিরটি ধ্বংস করা হয়।
বহু আদিবাসী জুম্ম সেনাবাহিনীর গুলিতে ও বাঙালি সেটেলারদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আহত অনেকজনকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু তাদেরকে আর দেখা যায়নি।
ঘটনার পাঁচ দিন পর ১ এপ্রিল ১৯৮০ ঢাকার এসেমব্লি হলে অনুষ্ঠিত এক প্রেস কনফারেন্সে সংসদ সদস্য উপেন্দ্র লাল চাকমা কর্তৃক বিলিকৃত এক বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়- ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চের সকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেতবুনিয়া থানার কলমপতি ইউনিয়নের কাউখালি বাজারে সেনাবাহিনীর দল কর্তৃক (সশস্ত্র বাঙালি অভিবাসীদের সাথে একত্রে মিলে) আনুমানিক ৩০০ ট্রাইবাল নারী, পুরুষ ও শিশু গণহত্যার শিকার হয়।
২২ ও ২৩ এপ্রিল ১৯৮০ শাজাহান সিরাজ এমপি, রাশেদ খান মেনন এমপি ও উপেন্দ্র লাল চাকমা এমপি, এই তিন সংসদ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল কাউখালী গণহত্যার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। পরিদর্শন শেষে তারা ২৫ এপ্রিল ১৯৮০ ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। সংবাদ সম্মেলনে উক্ত সংসদীয় দল অভিযোগ করে বলেন, সরকার সুকৌশলে ঘটনার বিষয়ে জনগণকে সম্পূর্ণভাবে অন্ধকারের মধ্যে রেখেছে। সরকার এবিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো বিবৃতি দেয়নি বলে উল্লেখ করেন।
উক্ত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধিবৃন্দ উল্লেখ করেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আমরা ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেতবুনিয়া থানাধীন কলমপতি ইউনিয়নের কাউখালী বাজারে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট কর্তৃক হত্যাকান্ড ও নিপীড়নের সাক্ষ্য খুঁজে পেয়েছি। নবাগত শরণার্থীরাও (১৯৭৯-৮০ সালে সরকার কর্তৃক বেআইনীভাবে বসতিদানকারী মুসলিম বাঙালি সেটেলার) ট্রাইবাল জনগণকে হত্যা ও লুটপাটের কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে।
সেই সময় ঘটনাটির বিষয়ে এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল ও এন্টি-স্লেভারি সোসাইটি এই সংস্থা কর্তৃক বিস্তারিত প্রতিবেদন তুলে ধরা হয় বলে জানা যায়।
বলাবাহুল্য, স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত অন্যতম ভয়াবহতম গণহত্যা এটি। এটা রাষ্ট্রীয় বাহিনী সেনাবাহিনী কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের উপর চরম মানবাধিকার লংঘনের ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত। এর দায় অবশ্যই তৎকালীন রাষ্ট্র ও সরকারকে যেমন নিতে হবে, তেমনি তৎপরবর্তী কোন সরকারই এর দায় এড়াতে পারে না। এমনকি বর্তমান সরকারও এই গণহত্যার দায় এড়াতে পারে না। এটি মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ ছাড়া আর কিছু নয়।
এটাও প্রনিধানযোগ্য যে, এই গণহত্যা ওই এলাকার জুম্মদের জীবনে চরম এক ক্ষতের সৃষ্টি করে। যা কখনো পূরণ হবার নয়। এতে শুধু যে অনেক জুম্ম হত্যার শিকার হন তা নয়, এতে অনেক নারী চিরতরে স্বামীহারা, অনেক মা-বাবা সন্তানহারা, অনেক সন্তান পিতামাতাহারা হন। অনেকে চিরপঙ্গুত্ব বরণ করেন। ঘরবাড়ি পুড়ে গিয়ে অনেকে আর্থিকভাবে শোচনীয় হয়ে পড়েন। অনেক পরিবার বাঁচার তাগিদে স্ব স্ব বসতভিটা থেকে পালিয়ে গিয়ে আর ফিরে যাননি। এখনো অনেকের জায়গাজমি বাঙালি সেটেলারদের দখলে রয়েছে।
বিগত ৪২ বছরেও রাষ্ট্র বা সরকার কর্তৃক এই গণহত্যার বিষয়ে নিরপেক্ষ বিচারবিভাগীয় তদন্ত ও বিচারের উদ্যোগ যেমন গ্রহণ করা হয়নি, দোষীদের শাস্তির কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের এবং পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগের কথা জানা যায়নি। এভাবেই সেনাবাহিনী কর্তৃক ঠান্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে জুম্মদের উপর চালানো এই বর্বরতম গণহত্যাকান্ড বিগত ৪২ বছর ধরে তদন্তহীন ও বিচারহীন ভাবে রয়েছে। এই গণহত্যার বিচার না করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সরকার কখনো এই কলঙ্ক থেকে মুক্তি পাবে না।