হিল ভয়েস, ৮ মার্চ ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক:পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে জুম্ম নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত সম্ভব হয়নি। তাই জুম্ম নারীর নিরাপত্তার জন্য অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যক। আদিবাসীদের সুরক্ষার জন্য তথা দেশের নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতিবিদদের জন-বান্ধব এবং গণমুখী হতে হবে।
আজ ৮ মার্চ ২০২২ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি’র উদ্যোগে রাঙ্গামাটিতে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব মতামত তুলে ধরেন।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যার স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, আলোচনা সভার আগে আয়োজিত র্যালী উদ্ধোধন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি’র কেন্দ্রীয় সদস্য জ্যোতিপ্রভা লারমা (মিনু)। র্যালীটি জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে ডিসি অফিস প্রাঙ্গণ ঘুরে এসে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে শেষ হয়। র্যালীতে রাঙ্গামাটির বিভিন্ন এলাকা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় হাজারের অধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যার সঞ্চালনায় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি’র কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মনি চাকমা’র সভাপতিত্বে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য গৌতম কুমার চাকমা।
অন্যান্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান, টিআইবি’র ট্রাষ্টি ও মানবাধিকারকর্মী এডভোকেট সুষ্মিতা চাকমা, সাংবাদিক সুমি খান, এম এন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ইন্টুমনি তালুকদার, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটি’র সহ সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর ত্রিপুরা (নান্টু), পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক ইমরান চৌধুরি। আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ম্রানুচিং মারমা।
প্রধান আলোচক গৌতম কুমার চাকমা বলেন, আমরা অধিকার পেতে চাই। আমরা অধিকার সচেতন। আমরা সংগ্রাম করতে চাই। সেজন্য আমাদের ভাবলে হবে না যে, আমাদের কত সম্পদ আছে? অর্থ আছে? আমাদের ভাবতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য কি অবদান রাখবো। আমাদের ভাবতে হবে আমাদের যারা প্রতিপক্ষ তারা কি চায়? প্রতিপক্ষ যা চায়, আমরা তা করবো না। প্রতিপক্ষ যা চায় না , আমরা তাই করব। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারী সমাজকে মানুষ চিনতো না। তারা হয়তো ভাবত তারা জঙ্গলে থাকে, পাহাড়ের মেয়ে কিন্তু জুম্ম নারীরা আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের অধিকারকে চিনেছে। কাজেই লড়াই করার মানসিকতা আমাদের অস্তিত্ব সুরক্ষার হাতিয়ার।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, আমরা পাহাড়ে দুইযুগ ধরে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করেছি। সেখানেও নারীরা বিশাল অবদান রেখেছে। পৃথিবীতে যত আন্দোলন সংগ্রাম কিংবা যুদ্ধ হয়েছে, সেখানে নারীরা সমানভাবে ভূমিকা পালন করেছে। এদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও রয়েছে নারীদের বিশাল অবদান। সমাজে নারীদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে নারী-পুরুষ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আজ পার্বত্য চুক্তির দুই যুগ পেরিয়ে ২৫ বছর চলছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদেরকে এই সময়ে এসেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়নের কথা বলতে হচ্ছে। তারা যে এত পার্সেন্ট কিংবা এতগুলো ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে বলে বলছে, এটা তো গাণিতিক হারে বলার বিষয় না। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।
তিনি আরও উপজাতীয় শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ বিষয়ক টাষ্কফোর্সের বিষয়ে বলেন, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংখ্যা ৮৩ হাজার পরিবার। প্রতি পরিবারে ৫ জন করে মানুষ থাকলে সংখ্যাটা ধারায় ৪ লাখ। এই ৪ লাখ মানুষের জন্য সরকারের বাজেট ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা। এটা কি ধরনের উপহাস। এটা তো মানা যায় না।
সাংবাদিক সুমি খান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি এখানকার মানুষদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য। ভূমি বেদখল করে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করার জন্য নয়। জুম্ম জনগণকে হত্যা, অত্যাচার, দমন-পীড়নের জন্য নয়। আদিবাসী নারীদের শ্লীলতাহানি কিংবা ধর্ষণের মতো অপরাধ করার জন্য নয়। আজকে ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে কিন্তু বিধিমালা এখনো তৈরি করা হয়নি। এই প্রতিষ্ঠানকে কার্যত অথর্ব করে রাখা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুইযুগ পরেও। তাহলে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত হবে কিভাবে? ভূমির অধিকার নিশ্চিত না হলে তারা এদেশে কিভাবে টিকে থাকবে?
তিনি আরো বলেন, এখানে জুম্ম জনগণ শত শত বছর ধরে রয়েছে। তারা কোন যুক্তিতে উপজাতি হন। কি করে রাষ্ট্র আজ তাদেরকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি দেয়। একটি জাতি কি হিসেবে পরিচিতি পাবে, সে অধিকার রাষ্ট্রের শাসকদের নেই, সে অধিকার সেই জনগোষ্ঠীর। আজকে একটি সরকার ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। এই এতগুলো বছরেও যদি পাহাড়ের মানুষদের প্রাণের দারি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় এ সরকার জন-বান্ধব এবং গণমুখী কিনা! তিনি আদিবাসীদের সুরক্ষার জন্য তথা দেশের নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতিবিদদের জন-বান্ধব এবং গণমুখী হওয়ার আহ্বান জানান।
এডভোকেট সুস্মিতা চাকমা বলেন, দেশের নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা সংগঠনগুলোতে নারীদের পুরুষের সমসংখ্যক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। তাদের ক্ষমতায়নের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। একটা সমতা ভিত্তিক সমাজ কিংবা স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সমাজের সবাইকে নারী অধিকার বিষয়ে সচেতন হতে হবে। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে জুম্ম নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত সম্ভব হয়নি। তিনি অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নের দাবি জানান।
এম এন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ইন্টুমনি তালুকদার বলেন, লড়াই করতে হবে, লড়াই ছাড়া অধিকার পাওয়া যায় না। পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আন্দোলন ছাড়া কোন অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র-যুব সমাজ, মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনসহ সবাই যদি চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে সামিল হই তাহলে অবশ্যই জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।