মিতুল চাকমা বিশাল
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির কথা বলতেই দু’চোখ জুড়ে ভেসে ওঠে চিরচেনা সেই ছবিগুলো, বছর পেরিয়ে যেন সেই ছবিরা আবার প্রাণ ফিরে পায়। যেখানে মানুষের মত মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে অস্ত্র হাতে নেওয়া আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের স্বপ্নে বিভোর একদল সৈনিক স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসছে, তাদের হাতে-কাঁধে থাকা একে-৪৭, এম-১৬, জি-৩, কার্বাইন, চাইনিজ রাইফেল, থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর এলএমজিগুলো যেন সেই সৌন্দর্য্য আর স্বপ্নকে আরো বিকশিত করছে, আরো প্রসারিত করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিকামী জনতা এবং শান্তিবাহিনীর অনেক সদস্য সেদিন আনন্দের সাথে অনিশ্চয়তার অশ্রুও বিসর্জন করেছিল। কেননা ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে, কী হবে, সেটা কেউই জানে না। যেখানে দেশের সমগ্র উচ্চ পর্যায়ের আমলা, জনপ্রতিনিধিরা এসে একত্রিত হয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী যেখানে ভাষণ দিয়ে বলে চলেছেন, “যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই; ধ্বংস নয় সৃষ্টি চাই; পশ্চাৎপদতা নয় অগ্রগতি চাই”। জনমানুষের করতালির ভিড়ে শান্তিবাহিনীর সদস্যদের মুখ ছিল যেন কিছুটা স্বস্তি, কিছুটা অজানা ভাবনায় ভরা। চোখে-মুখে যেন একটাই প্রশ্ন সবার মনে, স্বাভাবিক জীবন স্বাভাবিকের মত হবে তো? সেদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষি মানুষগুলো এই চুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করেছিল এই ভেবে যে, পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে, পাহাড় থেকে সেনাবাহিনী নেমে যাবে, পাহাড়ে পাহাড়িদের অধিকার থাকবে, বহিরাগত আর ভূমিদস্যুরা পাহাড় থেকে চলে যাবে, দুই যুগ ধরে রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পাহাড়ে আবারে জন্ম নেবে সবুজ বৃক্ষরাজির দল, পাহাড়ের জুমে জুমে ফুটে উঠবে জুম্ম শতদল। পাহাড়ের স্বপ্নরা যেন নতুন করে জেগে উঠেছিল, যেন ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত নতুন সকাল।
পৃথিবীর বুকে এই ধরনের চুক্তিগুলো শান্তিচুক্তি নামেই বেশি পরিচিত হয়ে থাকে। বহুদেশে, বহু অঞ্চলে এভাবে অজস্র চুক্তি হয়েছে। চুক্তিপক্ষ হিসেবে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকার চুক্তির ধারা, নিয়ম ও বিধি অনুসারে তাদের প্রতিপালনীয় দায়-দায়িত্ব পালন করে গিয়েছে এবং করছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও আমরা তাই দেখতে পাই। ১৯৬৬ সালে শুরু হওয়া মিজোদের লড়াইয়ের ফলস্বরূপ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৮৬ সালে মিজোদের সাথে শান্তিচুক্তি করে এবং একই বছরের ৭ই আগস্ট মিজোরামকে রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ১৯৮৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ২৩তম রাজ্য হিসেবে মিজেরামকে ভারতীয় ইউনিয়নের সাথে যুক্ত করা হয়। ব্যতিক্রম কেবল বাংলাদেশের বেলায়। দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংঘাতের অবসানে কাঙ্খিত সেই চুক্তির ধারা-উপধারা বাস্তবায়নের বিপরীতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বারংবার চুক্তি ভঙ্গের নজির পাওয়া যায়। তারা চুক্তি বাস্তবায়ন না করার নানা কারণ খোঁজা শুরু করেছে, নানা প্রতিবন্ধকতা দেখানোর গল্প বানাচ্ছে। বাস্তবিকপক্ষে চুক্তি বাস্তবায়নে তাদের আন্তরিকতার অভাব এবং রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা রয়েছে, এই সত্যকে তারা কদাপি স্বীকার করতে নারাজ।
পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন হয়েছে এটি যেমন ধ্রুব সত্য, একইভাবে সেই নিপীড়নের একটি রাজনৈতিক প্রকৃতি ছিল, সেটিও সত্য। জাতিগত বৈচিত্র্যতা এবং বৈচিত্র্যময় এক বহুসংস্কৃতির বাংলাদেশের বিপরীতে একজাতি একরাষ্ট্র গঠনের যে হীন পায়তারা, সেটি দেশের সংবিধানেই অতি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাষ্ট্রের সেই নগ্নতা আর শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করতে পাহাড়ের একদল তরুণ যুবক রাজপথের ময়দান ছেড়ে আপন করে নিয়েছিল সবুজ পত্র-পল্লবে সুশোভিত ঠাই হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ পাহাড়কে। যে পাহাড় তাদের ভালোবাসা শিখিয়েছে, বেঁচে থাকার মর্ম বুঝিয়েছে, ভিন্ন ভাষাভাষি আদিবাসী জুম্ম জাতিগোষ্ঠীকে আবদ্ধ করেছে এক আত্মিক বন্ধনে। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের পরে ঐতিহাসিক স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে উপনীত হয়, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নামে অভিহিত হয় এবং ”শান্তিচুক্তি” নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করে। এই চুক্তির মধ্যদিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান করার প্রচেষ্ঠা করা হয়েছে এবং জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয়ে এক বিশেষ শাসনব্যবস্থার স্বীকৃতিস্বরূপ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়েছে।
পার্বত্য চুক্তি আজ ২৫ বছর পূর্ণ করে ২৬ বছরে পদার্পণ করতে চলেছে। অপরদিকে চুক্তিতে ৪টি খন্ডে মোট ৭২টি ধারা রয়েছে। সেই হিসাবে প্রতি বছরে ৩টি ধারা বাস্তবায়ন করলেও এতক্ষণে চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে। তাহলে ২৫ বছরে চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি মাত্র ২৫টি ধারা। চুক্তি বাস্তবায়নের এই ধারাবাহিকতা দেখলে যে কেউ চোখ বন্ধ করেই বলতে পারবে, চুক্তি বাস্তবায়নে রাষ্ট্র এবং সরকারের আন্তরিকতা কতটুকু। তারপরেও সরকারের মন্ত্রী-আমলারা হর-হামেশাই বলে চলেছে, চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতি তাদের পালনীয় দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে নাই। তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পরে চুক্তির মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়ন হওয়ার পরেও জনসংহতি সমিতি এবং জুম্ম জনগণ যে ধৈর্য্য ও সংযমের পরিচয় দিয়ে চলেছে, সেটির প্রশ্নে রাষ্ট্র ও সরকারের জবাব কী হবে?
আমরা স্পষ্টতই দেখতে পাই যে, চুক্তির ২৫ বছর পরেও এখনো চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোও বাস্তবায়ন না হওয়াতে পাহাড়ে শান্তি এখনও অধরাই থেকে গেছে। শান্তির শ্বেত কপোতগুলি আকাশে উড়ার আগেই যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। বাস্তবিকপক্ষে চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে পাহাড়ের সমস্যার স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধান তথা এতদঞ্চলের শান্তি যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয়ে যে বিশেষ শাসন কাঠামো, সেই বিশেষ শাসন কাঠামো তার মর্যাদা লাভ করতে পারে নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন ইত্যাদি বিষয়গুলো এখনও পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের নিকট যখাযথভাবে হস্তান্তর করা হয় নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম (উপজাতি) অধ্যূষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য কোন কার্যকর উদ্যেগ গ্রহণ করা হয় নি।
অপরদিকে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য পাহাড়ের স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়ে আলাদা ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদেরও যথাযথভাবে পূনর্বাসন করা হয় নি। তদুপুরি সেনাবাহিনী ও তিন পার্বত্য জেলার ডেপুটি কমিশনারগণ নিজেদের ইচ্ছামাফিক পার্বত্য চুক্তিকে লঙ্ঘন করে তাদের কার্য করে চলেছে। বিশেষ শাসনব্যবস্থার কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় না করে বরং তাদেরকে পাশ কাটিয়েই তারা কাজ চালিয়ে নিচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে পার্বত্য চুক্তির লঙ্ঘন। চুক্তির ২৫ বছর পরে এসে আমরা এমন এক সংকটময় মুহূর্ত অতিক্রান্ত করতে চলেছি, যেখানে পাহাড়ের গণ মানুষের মৌলিক অধিকারকে ভূলুন্ঠিত করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সর্বোপরি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে রাষ্ট্রের এবং সরকারের সদিচ্ছা আমরা কোনোভাবেই আর দেখতে পাচ্ছি না। বরং চুক্তিপূর্বের ন্যায় রাষ্ট্র আবারো তার নগ্নতা আর উন্মত্ততা নিয়ে একের পর এক জুম্ম স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ ও সে অনুযায়ী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে এক ভিন্নমাত্রায় বিকশিত করছে।
পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ে এই চুক্তির আইনী বৈধতা অর্জনের বিষয়ে অর্থাৎ চুক্তিকে সাংবিধানিক আইনে পরিণত করার বিষয়ে জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে বারেবারে জোর দাবি জানানো হয়েছিল। তৎসময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট প্রয়োজন। অতএব কোনো সময় তারা সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেলে, তখন চুক্তিকে সাংবিধানিক আইন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করবে। অথচ গত ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আছে, এমনকি সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতাও তারা পেয়েছে। তথাপি তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে সাংবিধানিক আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে নি। চুক্তিটি সাংবিধানিক আইন হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়াতে ২০০০ সালে ও ২০০৭ সালে দায়েরকৃত পৃথক দুটি মামলায় ২০১০ সালের ১২-১৩ এপ্রিল হাই কোর্ট থেকে আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে অসাংবিধানিক এবং অবৈধ মর্মে রায় দেওয়া হয়েছে। পরে সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে আপীল বিভাগের চেম্বার আদালত বিষয়টির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত রায়টি স্থগিত ঘোষণা করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে, বিগত ১৩ বছরেও সরকারের তরফ থেকে এই আপীল মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির কোনো প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় নি।
এছাড়া চুক্তি স্বাক্ষরের পরে প্রায় সাড়ে তিন বছর এবং ২০০৯ সাল থেকে টানা ১৪ বছর সহ প্রায় ১৮ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামীলীগ সরকার। তথাপি এই সুদীর্ঘ সময়ে সরকারের তরফ থেকে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া তূলনামূলকভাবে অতি নগণ্য। বরং এই সময়েই সরকারের পক্ষ থেকে গোয়েবলসীয় কায়দায় চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে নানা অসত্য ও অপপ্রচার করা হয়েছে এবং প্রতিনিয়তই তা করা হচ্ছে। নানা সময়ে নানাভাবে সরকার বলছে যে, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, ১৫টি ধারা আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ৯টি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিন্তু সরকারের এই বক্তব্য সম্পূর্ণ অসত্য। নিজেদের ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দিতে সরকার এই অপপ্রচারের আশ্রয় নিয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, ১৮টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ২৯টি ধারা এখনও অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গেছে। অপরদিকে সরকারের তরফ থেকে নানাভাবে চুক্তিকে ভূলন্ঠিত করা হচ্ছে। বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোন সরকারি-বেসরকারি আমলারাও এখন নানা সময়ে চুক্তিবিরোধী নানা উদ্ভট বক্তব্য প্রদান করতে শুরু করেছেন। তারা প্রকাশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধীতা করে বক্তব্য দিলেও রাষ্ট্রের পক্ষ থকে এসম্পর্কিত কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কিংবা তাদের সতর্ক করার কোনো উদ্যোগ আমরা দেখতে পাই না।
পার্বত্য চুক্তি অনুসারে এতদঞ্চলের সাধারণ প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বিষয়টি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের হাতে ন্যস্ত করার কথা। কিন্তু বাস্তবে পাহাড়ের চিত্রটা সম্পূর্ণ উল্টো। চুক্তির ২৫ বছর পরেও এখনও সেনাবাহিনী একচ্ছত্রভাবে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন থেকে শুরু করে উন্নয়ন কার্যক্রমসহ পর্যটন, বাগান সৃজন ও সামাজিক বিষয়সহ ইত্যাদি বিষয়গুলোতেও সেনাবাহিনী আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পরে ১৯৯৭-১৯৯৯ সালে মাত্র ৭০টি অস্থায়ী ক্যাম্প এবং ২০০৯-২০১৩ সালের মধ্যে আরো ৩৫টি ক্যাম্পসহ এই পর্যন্ত মোট ১০৫টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। তৎপরবর্তী ২০১৩ সালের পর থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে স্থগিত রাখা হয়। অপরদিকে প্রত্যাহারকৃত ক্যাম্পগুলোর মধ্যে পরবর্তীতে কয়েকটি ক্যাম্প আরো পুনঃস্থাপন করা হয়। এছাড়া করোনা মহামারীর সময়ে আরো নতুন করে কমপক্ষে ৩০টির অধিক নতুন সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
অন্যদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহারের পর পরিত্যক্ত ভূমিগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের যথাযথ মালিকদের নিকট বা সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তরের বিধান থাকলেও কার্যত সেই সমস্ত পরিত্যক্ত ভূমিগুলোতে এপিবিএন ও পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় এবং এই লক্ষ্যে গত ২৬ মে ২০২২ রাঙামাটিতে ১৮ এপিবিএন, খাগড়াছড়িতে ২০ এপিবিএন এবং বান্দরবানে ১৯ এপিবিএন-এর কার্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং রাষ্ট্রের দমননীতির আরো একটি বড় প্রমাণও বটে।
আমরা আরো দেখতে পাচ্ছি যে, চুক্তি বাস্তবায়নের বিপরীতে রাষ্ট্র পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলতে সমস্যাকে প্রতিনিয়তই বহুমাত্রিকতা প্রদান করা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন তথা সেনাবাহিনীর আধিপত্যকে ধরে রাখতে এবং পাহাড়ে নিজেদের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী নানা সশস্ত্র সংগঠন তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের একটি বিপথগামী অংশকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনী সৃষ্টি করে চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ। “No full autonomy, No rest” বলে ব্যানার উঁচিয়ে ধরে নিজেদের উপস্থিতিকে জানিয়ে দেয় সেই বিপথগামীরা। নয়া যুগের নয়া পার্টি বলে নিজেদেরকে জাহির করা শুরু করলো তারা। একইভাবে সেই সংগঠনটি আবার সশস্ত্রও। শান্তিবাহিনীর প্রত্যাগত সদস্যরা যে অনিরাপত্তা আর অনিশ্চয়তার শঙ্কা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, দিন গড়াতেই সেই শঙ্কা যেন বাস্তবতায় রূপ নিলো।
তথাকথিত পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আদায়ের জন্য প্রধান শত্রু হিসেবে জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ ও শান্তিবাহিনীর প্রত্যাগত সদস্যদেরকে ধরে ধরে হত্যা, গুম ও অপহরণ করা শুরু করে এই ইউপিডিএফ। শুরু হলো আরেকটি কালো অধ্যায়। পরবর্তীতে একইভাবে জেএসএস (এম এন লারমা), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগ পার্টি, বম পার্টি ইত্যাদি চুক্তি ও জেএসএস বিরোধী সংগঠন এবং আরসা, আরএসও, জামায়াতে আনসার সহ সাম্প্রদায়িক ও ইসলামিক মৌলবাদী দলের নামধারী বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠন দিয়ে প্রতিনিয়ত সেনাবাহিনী পাহাড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে। একইভাবে এসব সংগঠনগুলোকে পার্বত্য চুক্তিবিরোধী ভূমিকায় নামিয়ে দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে ভূলন্ঠিত করা হচ্ছে। এই সমস্ত সশস্ত্র সংগঠনগুলো পাহাড়ে সেনাবাহিনীর নাকের ডগায় চাঁদাবাজি ও অস্ত্রবাজি করে বেড়ায়, আর সেনাবাহিনী সন্ত্রাসী খোঁজার নাম দিয়ে এদেরকে পাশ কাটিয়ে জনসংহতি সমিতির কর্মী ও সমর্থক এবং সাধারণ জনগণকে গ্রেপ্তার অভিযানে নামে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী এই ভূঁইফোড় সশস্ত্র সংগঠনগুলোর দ্বারা পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে পাহাড়ের মূল সমস্যাটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার নীতি অনুসরণ করছে। একইভাবে এই সংগঠনগুলোর দ্বারা কৃত কর্মকে সমগ্র জুম্ম জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়ে পাহাড়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিকে বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাস্তবিকপক্ষে সেনাবাহিনীই এসব সশস্ত্র সংগঠনসমূহকে নিরাপত্তা দিয়ে পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি চালু রেখেছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে এসব অস্ত্রধারীদের কথা সেনাবাহিনী উল্লেখ করলেও বাস্তবিকপক্ষে রাষ্ট্রীয় বাহিনীই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের অন্যতম এবং প্রধান অন্তরায়।
একইভাবে পাহাড়ের সমস্যাকে জাতিগত দ্বন্দ্বে রূপায়িত করতে এবং এতদঞ্চলকে উত্তপ্ত রাখার প্রয়াসে বহিরাগত সেটেলারদের দিয়ে সাম্প্রদায়িক ও ভূঁইফোড় সংগঠন তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। যারা প্রতিনিয়তই পাহাড়ে উস্কানিমূলক প্রচারণা করে চুক্তি বিরোধী বিভিন্ন বক্তব্য ও কার্যকলাপ করে থাকে। ভূমি কমিশন বাতিলের দাবিতে এই ভূঁইফোড় সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো সবচেয়ে সোচ্চার। গত ৭ সেপ্টেম্বর বহিরাগতদের এই নাগরিক পরিষদের ৩২ ঘন্টার সড়ক অবরোধের কারণে ভূমি কমিশনের সভা বাতিল করতে হয়। তাহলে স্পষ্টতই বোঝা যায়, এদের পিছনের মদদদাতা কারা। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট বাঙালি জাতিসত্তার মানুষ হয়েও এই বহিরাগতরা পাহাড়িদের কাছ থেকে তথাকথিত সম-অধিকার দাবি করে, যা অত্যন্ত হাস্যকরও বটে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী এই বহিরাগতদেরকেই মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রত্যক্ষভাবে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে। পাহাড়ের প্রত্যেকটি সাম্প্রদায়িক ঘটনার পেছনে এই বহিরাগতদের একহাত অবশ্যই থাকে।
চুক্তি বাস্তবায়নের বিপরীতে সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তি লঙ্ঘনের বিষয়গুলোও সবচেয়ে বেশি। চুক্তি করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামো তথা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার অভ্যন্তরে রাখা। এমনকি চুক্তির প্রস্তাবনাতেও সেই কথাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু দীর্ঘ ২৫ বছরে এসে আমরা এটুকুই দেখতে পাচ্ছি, রাষ্ট্র পাহাড়িদেরকে নানাভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদীর তকমা দিলেও সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রই হচ্ছে প্রকৃত বিচ্ছিন্নতাবাদী। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সরকারই পাহাড়িদেরকে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের মূল ভূ-খন্ড থেকে তথা বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের আত্মিক বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যার কারণে প্রতিনিয়তই পাহাড়ের ভিন্ন ভাষাভাষি জুম্ম জনগণের উপর বৈষম্য আর নিপীড়নের স্টীমরোলার চলমান রাখা হয়েছে। পাহাড়িদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যে রাষ্ট্রের হীন ও জঘন্য মানসিকতার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে, ২০১৫ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণাকয় কতৃক জারীকৃত বৈষম্যমূলক সেই ১১টি নির্দেশনা। যেখানে বিদেশী কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার কোনো সদস্যের সাথে পাহাড়িদের সাক্ষাতের বিষয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সরকার দলীয় লোকেদের উপস্থিতি থাকতে হবে মর্মে নির্দেশনা দেওয়া হয়। যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে হীন ও ঘৃণ্য উদ্যোগ। এর দ্বারা এটিই প্রমাণ হয় যে, পাহাড়িরা নয় বরং রাষ্ট্রই পাহাড়িদেরকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
অতি সম্প্রতি গত ১২-১৭ নভেম্বর বিদেশী কূটনীতিক ও মানবাধিকার সংস্থার কয়েকজন সদস্য তিন পার্বত্য জেলার রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি সফরে আসেন। তাদের উপর কড়াকড়িভাবে ১০টি শর্ত আরোপ করা হয়, সেই শর্তেই তাদেরকে পাহাড়ে সফরের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাহলে বিষয়গুলো কত ভয়াবহ ও জঘন্য তা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বরে সম্পাদিত ঐতিহাসিক সেই পার্বত্য চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বীর যোদ্ধারা যে স্বপ্ন আর আকাঙ্খা নিয়ে জঙ্গল জীবন ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিল, সেই স্বপ্নরা এখনও অধরাই থেকে গেছে। চুক্তির সময়ে জন্ম নেওয়া সেই ছোট্ট শিশুটিও আজ ২৫ বছরের টগবগে যুবকে পরিণত হয়েছে। ধীরে ধীরে পার্বত্য চুক্তির আওতায় স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসা সেই প্রজন্মটি আজ লয়প্রাপ্ত হতে চলেছে। বয়সের বার্ধক্যের চেয়ে হতাশা আর প্রতিশোধের নেশায় যেন তাদেরকে আরো বেশি অনুপ্রাণিত করছে। রাষ্ট্র এই পাহাড়ি জনগণের বিশ্বাসের সাথে খেলা করেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। রাষ্ট্রের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে উদযাপনের দিনটিও আজ প্রতিবাদের উত্তাল দিবসে পরিণত হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতা আর অনিশ্চয়তায় ভরা সেই জীবনের অবসান জুম্ম জনগণের এখনও হয় নি। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়তই জুম্ম জনগণের উপর অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার এক হীন মানসিকতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিক সমস্যা এবং এই সমস্যা সমাধানে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরেও দেশের সেনা-আমলারা এই চুক্তি নিয়ে সরাসরি বিরোধিতা করে চলেছে, যা দেশের জন্য কখনই ভালো ফল বয়ে আনবে না।
যুদ্ধের ভয়াবহতা কিরূপ হয়, সেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সময়ের প্রজন্মরা ভালো জানে এবং বুঝে। অতএব, সরকারের উচিত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আরো উদ্যোগী ও কার্যকরী ভূমিকা পালন করা।