হিল ভয়েস, ১ ডিসেম্বর ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: ‘নিরাপত্তাহীনতার কারণে প্রতিবেশী ভারতের মিজোরামে আশ্রয় গ্রহণের উদ্দেশ্য রুমাসহ বান্দরবান থেকে পলায়নপর বম গ্রামবাসীদেরকে জেএসএস কর্তৃক এ্যাম্বুশ করার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট’ বলে দাবি করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)-এর এক শীর্ষস্থানীয় সদস্য।
জেএসএসের বিরুদ্ধে বম জনগোষ্ঠীকে উস্কে দিতে বমপার্টি খ্যাত কেএনএফ এই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ প্রচার করছে বলে দাবি করেছে জনসংহতি সমিতির উক্ত নেতা।
আজ বৃহস্পতিবার (১ ডিসেম্বর) ‘বমরাম নিউজ’ নামক ফেসবুক গ্রুপে প্রকাশিত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর ‘We strongly condemn’ শীর্ষক প্রতিবাদলিপিতে বলা হয় যে, “ইতিমধ্যে আমরা শুনেছি যে, জেএসএস সশস্ত্র গ্রুপ এখন ঠেগা (ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত)-এর কাছাকাছি স্থানে নিরীহ কুকি-চিন-মিজো লোকেদেরকে, যারা নিরাপত্তার জন্য মিজোরাম রাজ্যে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছে, তাদেরকে বাধা প্রদান করতে এ্যাম্বুশ করে বসে আছে। আমাদের এই দুর্গতির সময়ে জেএসএসের এই ধরনের কার্যকলাপ সত্যিই নিন্দনীয় কাজ এবং এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।”
বমরাম নিউজে এ বিষয়টি প্রচারের পর অনেকে হিল ভয়েসের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে মেসেজ করে জানতে চেয়েছেন জেএসএস আসলে কী এ ধরনের অমানবিক কাজ করছে কিনা? এরপর হিল ভয়েসের পক্ষ থেকে জেএসএস নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। অনেক চেষ্টার পর প্রথমে জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য ও রুমা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অংথোয়াইচিং মারমার সাথে যোগাযোগ হয়।
অংথোয়াইচিং মারমা হিল ভয়েসকে বলেন, কেএনএফ/কেএনএ-এর এই অভিযোগ সর্ববৈ মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। জনসংহতি সমিতি কর্তৃক নিরীহ বম জনগোষ্ঠীর সাধারণ লোকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অমানবিক পদক্ষেপ নেয়ার প্রশ্নই উঠে না। কারণ জনসংহতি সমিতি বম জনগোষ্ঠীসহ ১১টি জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর অধিকারের জন্য আন্দোলন করছে।
তিনি আরো বলেন, “জনসংহতি সমিতির দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে আমি ইতিমধ্যেই মিজোরামে আশ্রিত নিরীহ বম জনগোষ্ঠীর লোকজনকে যথাযথ নিরাপত্তা বিধান করে এবং উপযুক্ত পুনর্বাসনের প্যাকেজ ঘোষণা করে স্বদেশে ফিরিয়ে আসার জন্য স্থানীয় প্রশাসন তথা বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এমনকি আমি নিরীহ নিরপরাধ বম গ্রামবাসীদের উপর বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হয়রানিমূলক কার্যকলাপও বন্ধ করতে দাবি জানিয়েছি।”
অংথোয়াইচিং মারমা আরো বলেন, “যেখানে জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে সাধারণ বম জনগোষ্ঠীর লোকজনদের উপর চলমান হয়রানির প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে এবং নিরাপত্তার কারণে মিজোরামে আশ্রিত বম জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ-শিশুদেরকে নিরাপত্তা সহকারে স্ব স্ব গ্রাম ও জায়গায় ফিরিয়ে আনার দাবি জানানো হচ্ছে, সেখানে জেএসএসের বিরুদ্ধে এধরনের অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত বৈ কিছু নয়। মূলত বমপার্টি খ্যাত কেএনএফ তাদের আত্মঘাতি ও হঠকারি কর্মকান্ডের কারণে বম জনগোষ্ঠীর উপর চলমান দুর্ভোগকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে, সর্বোপরি সাধারণ বম জনগোষ্ঠীর লোকজনকে জেএসএসের বিরুদ্ধে উস্কে দিতেই এধরনের ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ তুলে ধরেছে।”
জনসংহতি সমিতির আরেক শীর্ষস্থানীয় সদস্য সজীব চাকমা হিল ভয়েসকে বলেন, জেএলএ নামে কোন সশস্ত্র গ্রুপ আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে থাকলেও থাকতে পারে, যা হয়তো আমার জানা নেই। তবে জনসংহতি সমিতির কোন প্রকার সশস্ত্র গ্রুপ নেই। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর জনসংহতি সমিতি গণতান্ত্রিক উপায়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা বম জনগোষ্ঠীসহ আপামর জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
কেএনএফের একের পর এক আত্মঘাতি ও হঠকারি কর্মকান্ড
বমপার্টি খ্যাত কেএনএফ কর্তৃক একের পর এক আত্মঘাতি ও হঠকারি কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার ফলে কেএনএফ/কেএনএ এখন দিশাহারা। নাথান বম ও ভাঙচুংলিয়ান বমের নেতৃত্বাধীন কেএনএফ/কেএনএ-এর অবিমৃষ্যকারিতার ফলেই নিরীহ নিরপরাধ বম জনগোষ্ঠীকে এখন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে বম জনগোষ্ঠীর প্রবীন ব্যক্তিসহ অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
প্রথমত কেএনএফ/কেএনএ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর নিপীড়ন-নির্যাতনের অন্যতম রাষ্ট্রীয় নিপীড়ক যন্ত্র সেনাবাহিনীর সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ও তাদের উস্কানীতে জুম্ম জনগণের মধ্যে জাতিগত বিভাজন শুরু করে। বস্তুত সেনাবাহিনী বম জনগোষ্ঠী তথা কেএনএফের কথিত ছয় জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও অধিকারের কথা বললেও তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো জুম্ম জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরী করা। সেনাবাহিনীর সেই ভাগ করো শাসন করো ঔপনিবেশিক নীতির ফাঁদে প্রথম পা দিয়েছে কেএনএফ।
বর্তমানে কেএনএফ দাবি করছে তারা সেনাবাহিনী তথা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো পার্বত্য চুক্তিকে ভন্ডুল করা এবং জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের চলমান আন্দোলন নস্যাত করার হীনউদ্দেশ্যেই সেনাবাহিনীর গর্ভে কেএনএফ/কেএনএ-এর জন্মই হয়েছে তার প্রেক্ষাপট আর নতুন করে তুলে ধরার দরকার পড়ে না। ইসলামী জঙ্গীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার কারণে আজ সেনাবাহিনীর সাথে কেএনএফ/কেএনএ-এর হয়তো সাময়িক বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে বটে, তবে কেএনএফ জন্মের পেছনে সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্র যে ছিল আজ সবাইয়ের কাছে স্পষ্ট।
দ্বিতীয়ত কেএনএফ/কেএনএ পা দিয়েছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামী জঙ্গীদের ফাঁদে। অর্থের বিনিময়ে বমপার্টি খ্যাত কেএনএফ ‘জামায়াত আরাকান’ বা ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দা শারক্বীয়’ নামক ইসলামী জঙ্গী সংগঠনকে তাদের আস্তানায় আশ্রয় দেয়া এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করে আসছে, যা হচ্ছে সবচেয়ে হঠকারি ও আত্মঘাতি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে যারা ওয়াকিবহাল তারা সবাই জানেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় দেশের শাসকগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য হলো অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা। আর অন্যদিকে অনেক দিন আগে থেকেই ইসলামী জঙ্গীদেরও টার্গেটে ছিল এই পার্বত্যাঞ্চল। কেননা এই অঞ্চলটি চট্টগ্রাম সমদ্র বন্দর, মিয়ানমার ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের লাগোয়া হওয়ায় ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি ছিল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
অথচ নাথান বম ও ভাঙচুংলিয়ান বম সেই ইসলামী জঙ্গীদেরকে ঘরের অন্দরমহলে ডেকে এনে জায়গা দিয়েছেন, যারা একদিন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বমসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে গিলে তো খাবেই, গোটা বাংলাদেশকেও জঙ্গী রাষ্ট্রে পরিণত করবে। এমনকি এটা মিজোরাম, মণিপুর, ত্রিপরাসহ উত্তরপূর্ব ভারত ও মিয়ানমারের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্যও হুমকি স্বরূপ। অথচ কেএনএফ সেই কুমীরকে খাল কেটে এনে প্রজনন কেন্দ্র তৈরী করে দিচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনো ইসলামী সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে বাফার জোন হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম যদি সম্পূর্ণভাবে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হয়, তাহলে ইসলামী সম্প্রসারণবাদের ফ্রন্ট লাইনে চলে আসবে মিজোরাম তথা কুকি-চিন-মিজো জনগোষ্ঠী। কেএনএফ কেবল জুম্ম জনগণকে ইসলামী সম্প্রসারণবাদের করাল গ্রাসে ঠেলে দিচ্ছে না, গোটা কুকি-চিন-মিজো-রাখাইন জনগোষ্ঠীসহ এতদাঞ্চলের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীও ঠেলে দিচ্ছে। এটা হয়তো এখনি কল্পনা করা যাচ্ছে না, কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে ৫০, ১০০ বছর পরে এমনটা হবে তা নি:সন্দেহে বলা যেতে পারে।
তৃতীয়ত কেএনএফ যেটাতে ফাঁদে পা দিয়েছে, সেটি হলো সেনাবাহিনী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোর মদদে পার্বত্য চুক্তি, চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতি, আদিবাসী জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী চাকমা-মারমা-ত্রিপুরাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আদিবাসীদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা। জনসংহতি সমিতির ভাষ্য অনুসারে কেএনএফ যতই জেএসএসের বিরুদ্ধে রণ দামামার ডাক দিক না কেন, জেএসএস প্রথম থেকেই সহনশীল নীতি গ্রহণ করে আসছিল। কিন্তু সেই সহনশীলতা ও সমঝোতাকে উপেক্ষা করে এ বছরে মার্চ-এপ্রিলের দিকে কেএনএফ চুক্তি পক্ষীয় কর্মীদের উপর বিশ্বাসঘাতকতামূলক অতর্কিত সশস্ত্র হামলা চালায়। এতে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে, যা ছিল চরম হঠকারি ও আত্মঘাতি।
সেনাবাহিনী তথা সরকার চায় জুম্ম জনগণের অধিকার সনদ পার্বত্য চুক্তিকে নস্যাৎ করে দিতে, জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের জন্য চলমান আন্দোলনকে ভন্ডুল করতে, সর্বোপরি জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে জাতিগত বিভেদ ও সংঘাত বাঁধিয়ে দিতে। অথচ আপনাআপনিই সেই ফাঁদে পা দিয়েছে বমপার্টি খ্যাত কেএনএফ।
তাই তো কেএনএফকে দেখা যায় পার্বত্য চুক্তি, জেএসএস, সংখ্যাগুরু জুম্ম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, উগ্র বাঙালি জাতীয়তবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তথা শাসকদল যা অপপ্রচার চালায়, কেএনএফকেও সেই অপপ্রচারের বুলি টোটা পাখির মতো আওড়াতে। ১০ লক্ষ জুম্ম জনগণের অধিকার সনদ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে যেখানে সেনাবাহিনী ও সরকার একের পর এক ষড়যন্ত্র করে চলেছে, সেখানে কেএনএফের অঙ্কিত ২০ হাজার বম জনগোষ্ঠীর জন্য কুকি-চিন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে কতটুকু এগিয়ে আসবে তা নতুন করে মূল্যায়নের দরকার পড়ে না। ঐক্য-সংহতির পরিবর্তে বিভাজনের ষড়যন্ত্রে পা দিলে কোন জনগোষ্ঠীর মঙ্গল হবে না তা বলাই বাহুল্য।
পার্বত্য চুক্তি, জেএসএস, সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আখেরে নাথান বম ও ভাঙচুংলিয়ান গংদের কিছু সাময়িক লাভ হতে পারে, কিন্তু সুদূর প্রসারী চাকমা, বম, লুসাই কিংবা মারমা-ত্রিপুরা কোন জনগোষ্ঠীর জন্য শুভ ফল বয়ে আনবে না তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আজকে বম জনগোষ্ঠীর উপর যে দুর্ভোগ শুরু হয়েছে, সেটাই তার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বলে বিবেচনা করা যায়।
তাই বমপার্টি খ্যাত কেএনএফ এধরনের আত্মঘাতি ও হঠকারি কার্যকলাপ থেকে যতই দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারবে এবং আপামর জুম্ম জনগণের চলমান পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনে সামিল হতে পারবে, ততই বমপার্টি বা কেএনএফ তথা বম জনগোষ্ঠী এবং আপামর জুম্ম জনগণের কল্যান বয়ে আনবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বম জনগোষ্ঠীর প্রবীন ব্যক্তিবর্গসহ অনেক অধিকার কর্মী।