জনসংহতি সমিতির বিবৃতি: জুম্ম জনগণ, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র-যুব সমাজের প্রতি বৃহত্তর আন্দোলনের আহ্বান

হিল ভয়েস, ২ ডিসেম্বর ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: আজ ২ ডিসেম্বর ২০২২ ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছরপূর্তি তথা রজতজয়ন্তী উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি আপামর জুম্ম জনগণ, জুম্ম বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র-যুব সমাজের প্রতি জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নসহ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার বৃহত্তর আন্দোলন সংগঠিত করার আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতি প্রকাশ করেছে। এছাড়া জনসংহতি সমিতি বিবৃতিতে শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র, আগ্রাসন ও অত্যাচার-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধের সংগ্রামকে অধিকতর জোরদার করার এবং শাসকগোষ্ঠীর উগ্র জাতীয়তাবাদী, সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসীবাদী মুখোশ উন্মোচন করারও আহ্বান জানিয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “বর্তমানে জুম্ম জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাদের আর পেছনে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইস্পাত-কঠিন জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে জুম্ম জনগণের বৃহত্তর আন্দোলন অধিকতর জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই। পার্বত্য চুক্তি-পূর্ব সময়ের মতো আপামর জুম্ম জনগণকে আত্মবলিদানে উৎসর্গিত হয়ে অধিকতর মরণ-পণ বৃহত্তর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে ছাত্র-যুব সমাজকে বৃহত্তর আন্দোলনের দায়িত্ব কাঁধে নিতে এগিয়ে আসা অত্যন্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।”

এতে আরও বলা হয়, “জুম্ম জনগণ আজ চরম বৈষম্য, নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। উপরন্তু সামগ্রিকভাবে এদেশের আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সরকার তথা দেশের শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব বিলুপ্তিকরণ, অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা, সর্বোপরি জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণে উঠে পড়ে লেগেছে। এমতাবস্থায়শাসকগোষ্ঠীর পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আদিবাসী জুম্ম জনগণের চলমান প্রতিরোধ আন্দোলনে অধিকারকামী জুম্ম জনতার অধিকতর ঐক্য, সংহতি ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রামী ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।”

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, “পার্বত্যবাসীরা আশা করেছিল যে, এই ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের স্মরণাতীত কালের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সংরক্ষিত হবে। জুম্ম জনগণের জাতীয় পরিচিতি, সংস্কৃতি, ভাষা, প্রথা, রীতিনীতি ইত্যাদি বিকাশ ও সংরক্ষিত হবে। তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বহু জাতি, বহু সংস্কৃতি ও বহু ভাষার বৈচিত্র্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আরো শক্তিশালী ও মজবুত হবে। কিন্তু চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন না করে বরঞ্চ শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক পার্বত্য চুক্তিকে অব্যাহতভাবে পদদলিত ও খর্ব করার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য তথা জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব আজ বিলুপ্ত হতে বসেছে।”

এতে বলা হয়, “পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় জুম্ম জনগণ এখনো তাদের বেহাত হওয়া জায়গা-জমি ফেরত পায়নি। ভারত-প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুরা এখনো নিজ দেশে পরবাসীর জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। এখনো বন্ধ হয়নি ভূমি বিরোধকে নিয়ে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় জুম্মদের উপর সেটেলারদের সাম্প্রদায়িক হামলা, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদ, নারী ধর্ষণ ও অপহরণইত্যাদি সাম্প্রদায়িক ও সহিংস তৎপরতা। বরঞ্চ এসব জাতিগত নির্মূলীকরণের হীনতৎপরতা দিন দিন জোরদার করা হচ্ছে।”

বিবৃতিতে আরো উল্লেখ করা হয়, “পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর জুম্ম জনগণ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন চায়। চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠীর নির্দয় নির্মম অত্যাচার-উৎপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে চায়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের নাগরিকদের মতো তারাও আত্মমর্যাদা ও সমমর্যাদাসম্পন্ন সুখী সমৃদ্ধ ও নিরাপদ জীবন পেতে বদ্ধপরিকর। বিগত এক শতাব্দী ধরে ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে জুম্ম জনগণ যে কোন কঠিন পরিস্থিতিতেও মরণপণ সংগ্রাম পরিচালনা করতে শিখেছে। মহান নেতা এম এন লারমা তাঁর অমূল্য জীবন বিসর্জন দিয়ে জুম্ম জনগণকে আত্মবলিদানের পথ প্রদর্শন করে গেছেন। তাই জুম্ম জনগণ আত্মমর্যাদা ও স্বকীয় পরিচিতি নিয়ে বাঁচার জন্য রক্ত দিতেও বদ্ধপরিকর। সংগ্রামে পোড় খাওয়া জুম্ম জনগণ আত্মবলিদানের মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মুক্তিপাগল জুম্ম জনগণ কোনো শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়-অবিচারের কাছে কখনোই মাথানত করেনি। ভবিষ্যতে চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী শাসকগোষ্ঠীর কোন প্রকার ষড়যন্ত্রের কাছে মাথানত করবে না, করতে পারে না।”

বৃহত্তর আন্দোলনের আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, “তাই আসুন, গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে, পাহাড়ে-সমতলে, বনে-জঙ্গলে ছাত্র-যুব-জনতার লৌহ দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলে শাসকগোষ্ঠীরও কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহলের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী সকল প্রকার ষড়যন্ত্র এবং সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে জুম্ম জনগণের অধিকারের সনদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করি। জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও বিকাশের লক্ষ্যে এম এন লারমা ও শহীদদের আত্মবলিদানে বলিয়ান হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়ে জুম্ম জনগণের ন্যায়সঙ্গত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করি।

তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির এই রজতজয়ন্তীতে আপামর জুম্ম জনগণ, জুম্ম বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র-যুব সমাজের প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি আহ্বান জানাচ্ছে যে, আসুন-
-জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নসহ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার বৃহত্তর আন্দোলন সংগঠিত করি।
-শাসকগোষ্ঠীর যে কোনো ষড়যন্ত্র, আগ্রাসন ও অত্যাচার-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াই এবং প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সংগ্রামকে অধিকতর জোরদার করি।
-পাহাড়ে-সমতলে, বনে-জঙ্গলে, শহরে-গ্রামে কিংবা দেশে-বিদেশে যেখানে থাকি না কেন শাসকগোষ্ঠীর উগ্র জাতীয়তাবাদী, সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসীবাদী মুখোশ উন্মোচন করি এবং জুম্ম জাতিবিদ্বেষী সকল প্রকার ষড়যন্ত্র প্রতিহত করি।”

More From Author