হিল ভয়েস, ৬ ডিসেম্বর ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: গত শনিবার (৩ ডিসেম্বর) জাতীয় সংসদ ভবনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির ৬ষ্ঠ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। উক্ত সভায় কমিটির ৫ম সভার কার্যবিবরণী অনুমোদন করা হয়। তবে প্রত্যাহৃত সেনা ক্যাম্পের জায়গায় এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপনের বিষয়টি সভায় অনুমোদন করা হয়নি।
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণকমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসনাত আবদুল্লাহের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কমিটির অপর দুই সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা এবং ভারত-প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গৌতম কুমার চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি, মন্ত্রণালয়ের সচিব মোসাম্মত্ হামিদা বেগম, চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়কের ব্যক্তিগত সচিব খায়রুল বাশার ও অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির ৫ম সভার এক বছরের পর কমিটির এই ৬ষ্ঠ সভা অনুষ্ঠিত হলো।
৬ষ্ঠ সভায় আলোচ্য বিষয় ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও ৫ম সভার কার্যবিবরণী অনুমোদন প্রসঙ্গে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য সভায় আলোচন্য বিষয় নির্ধারিত থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোন কার্যপত্র উপস্থাপন করা হয়। ফলে সে বিষয়ে কোন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়নি।
৫ম সভার কার্যবিবরণী অনুমোদনের উপর সভায় আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৫ম সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বিধিমালা অচিরেই প্রণয়ন/চূড়ান্তকরণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ও বিগত এক বছরে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তাই এ বিষয়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে পুনরায় তাগাদা দেয়া হয়েছে।
নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে অহস্তান্তরিত বিষয়গুলো অচিরেই হস্তান্তরের জন্য ৫ম সভার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তও বাস্তবায়িত হয়নি। সে বিষয়েও পুনরায় পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে তাগাদা দেয়া হয়েছে।
৫ম সভায় পার্বত্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক পার্বত্য মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের মধ্যে সমন্বয় সভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তও বাস্তবায়িত হয়নি। উক্ত সিদ্ধান্ত বিষয়ে কেন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি সে বিষয়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব যথাযথভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারেননি। পরে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিংও এ বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করেন।
বান্দরবান পার্বত্য জেলার ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি লীজ ও রাবার বাগানের তালিকাসহ একটি প্রতিবেদন চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির নিকট জমা নেয়ার জন্য ৫ম সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু ডেপুটি কমিশনারের পক্ষ থেকে কোন প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়নি। এ বিষয়েও প্রয়োজনীয় কার্যকর উদ্যোগ নিতে পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে পুনরায় তাগাদা দেয়া হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ আইন অনুসরণে আঞ্চলিক পরিষদের প্রবিধান প্রণয়নের বিষয়ে পুনরায় আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির ২৭ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী সম্বলিত অর্গানোগ্রাম অনুমোদন ও তদনুসারে জনবল নিয়োগের জন্য কমিটির ৫ম সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু এ বিষয়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
জনসংহতি সমিতির সদস্যদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা প্রত্যাহারের জন্য ৫ম সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু এ বিষয়েও পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। মামলার তালিকা প্রেরণের জন্য আঞ্চলিক পরিষদের নিকট চিঠি দেয়া হয়েছে মর্মে উল্লেখ করে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তখন আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান বলেন, এটা আঞ্চলিক পরিষদের বিষয় নয়। এটা জনসংহতি সমিতির বিষয়। কাজেই আঞ্চলিক পরিষদকে চিঠি না লিখে জনসংহতি সমিতিকে লেখার জন্য আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ থেকে প্রত্যুত্তর দেয়া হয়েছে। কিন্তু এরপর পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নিমিত্তে মামলার তালিকা প্রণয়নের জন্য পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে আবার তাগাদা দেয়া হয়।
প্রত্যাহৃত সেনা ক্যাম্পের জায়গায় এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপনের জন্য ৫ম সভার কার্যবিবরণীতে সিদ্ধান্ত হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়। এতে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বিরোধিতা করেন। উল্লেখ্য যে, এ বিষয়ে ৫ম সভায় আলোচনা হয়েছে বটে, তবে কোন সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হয়নি। এছাড়া এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ পার্বত্য চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিকও বটে।
অবশেষে প্রত্যাহৃত সেনা ক্যাম্পের জায়গায় এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপনের বিষয়টি ছাড়া ৫ম সভার উপরেল্লেখিত সকল সিদ্ধান্তবলী অনুমোদন পূর্বক চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির ৫ম সভার কার্যবিবরণী চূড়ান্ত করা হয়। ৫ম সভার কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ প্রত্যাহৃত সেনা ক্যাম্পের জায়গায় এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপন করার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়নি। এ বিষয়ে পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করা যেতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভার কার্যবিবরণী পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি ও আঞ্চলিক পরিষদের নিকট প্রেরণের জন্য ৬ষ্ঠ সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক শিক্ষক নিয়োগ কমিটিতে ডেপুটি কমিশনারদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রেরিত নির্দেশনার বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এধরনের নির্দেশনা পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। তাই এধরনের আইন বহির্ভুত নির্দেশনা প্রদান না করার জন্য পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এ ধরনের নির্দেশনা আর দেয়া হবে না মর্মে পার্বত্য মন্ত্রী বীর বাহাদুর প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক বর্তমান সরকারের আমলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি পুনর্গঠিত হয়ে আসছে। তবে এ কমিটি গঠিত হলেও কমিটির সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তবলী বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে এ যাবৎ কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অধিকন্তু এ কমিটির নেই কোন অফিস, জনবল ও তহবিল। ফলে এ কমিটি গঠিত হলেও সরকার নানাভাবে এ কমিটিকে নামকাওয়াস্তে বলবৎ রেখেছে বলে সংশ্লিষ্ট অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এতে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার কতটা আন্তরিক তা সহজেই অনুমান করা যায় বলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।