হিল ভয়েস, ৭ ডিসেম্বর ২০২২, ঢাকা: এসব বৈষম্যের প্রতিরোধ শুধু আদিবাসী সমাজ করলেই হবে না। সবাইকে নিয়ে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়তে হবে। নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে শুধু নারী নয়, পুরুষদেরও এগিয়ে আসতে হবে, তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
গতকাল বুধবার (৭ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক কর্তৃক ঢাকার মোহাম্মদপুরস্থ আসাদ গেইট-ওয়াইডব্লিউসিএ-এর মিলনায়তনে আয়োজিত 16 days Activism-এর অংশ হিসেবে “আদিবাসী নারী ও শিশুর উপর সহিংসতা বন্ধ করুন” শীর্ষক একটি সেমিনারে বক্তারা এসব অভিমত তুলে ধরেন।
উক্ত সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের যুগ্ম আহ্বায়ক চৈতালী ত্রিপুরা এবং লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক এর সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা ও শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক এর সদস্য সুজয়া ঘাগ্রা।
আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এএলআরডি এর ব্যবস্থাপক সানজিদা খান রিপা, ইন্টারন্যাশাল ল্যান্ড কোয়ালিশন এর এশিয়া রিজিওনাল কো-অর্ডিটর মিস মিরগুল আমানালিভা, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপ-পরিচালক শাহনাজ সুমী, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক সংসদীয় ককাসের যুগ্ম সমন্বয়ক এবং গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ-এর সাধারণ সম্পাদক জান্নাত-এ ফেরদৌসী এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং প্রমুখ।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে সুজয়া ঘাগ্রা বলেন, বাংলাদেশে আদিবাসী নারীর উপর বিভিন্ন সহিংসতা, নিপীড়ন নির্যাতন যেমন ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা ধর্ষনের পর হত্যা ইত্যাদি ঘটনা প্রায় দেখি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাসহ আদিবাসীদের ভূমির সমস্যা, বিচারহীনতা সংস্কৃতি, আদিবাসী নারী ও মেয়ে শিশুর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা বিভিন্ন ধরনের যৌন, শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার হয়।
তিনি আরো বলেন, শুধু তাই নয় আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও লিঙ্গের কারণে প্রায়শই তারা বিভিন্ন বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছে। এসব বৈষম্যের প্রতিরোধ শুধু আদিবাসী সমাজ করলেই হবে না। সবাইকে নিয়ে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়তে হবে। সকলে মিলে পরিবার, সমাজ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, সরকারী বেসরকারী সংস্থা, বিভিন্ন গনমাধ্যমকে নিয়ে আদিবাসী নারীসহ বাংলাদেশের নারীর উপর সহিংসতা নির্যাতন, নিপীড়ন বন্ধে কাজ করার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, আদিবাসী নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। তিনি আরো বলেন, মেঘালয়ের খাসি মেয়ে, গারো মেয়ে আর বাংলাদেশের খাসি মেয়েরা একই অধিকার নিয়ে জন্মায় না। তিনি আদিবাসী নারী সংগঠনগুলোর আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে তাদের সহযোগিতা করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আদিবাসী নারীদের সহায়তা করতে হবে, তাদের উৎসাহ দিতে হবে। আর আদিবাসী নারীদের সহযোগিতার মাধ্যমেই আমরা সমাজকে পরিবর্তন করতে পারব।
সানজিদা খান রিপা বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করার ব্যাপক প্রচারাভিযান চালাতে হবে। নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে তিনি মনে করেন। সিভিল সোসাইটির ভুমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আদিবাসী নারীদের ওপর সহিংসতা বন্ধের জন্য সিভিল সোসাইটিকে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল ল্যান্ড কোয়ালিশনের প্রতিনিধি মিরগুল আমানিলাভা বলেন, নারী শুধু পুরুষকে বাঁচায় না, তারা বিশ্বকেই বাঁচাতে পারে। তিনি আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধের লক্ষ্যে তারা ৩০ বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি দিয়ে আসছে। বিশ্ব শান্তিতে নারীদের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নারীরাই এই পৃথিবীকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারে। তার আগে নারীদের প্রতি সকল ধরনের নির্যাতন বন্ধ করার জন্য তিনি সবাইকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান।
শাহনাজ সুমী বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সবার সাথে মিলে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে হবে। পাড়ার তরুণদের সহিংসতা বন্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি বলেন নারীরা শুধু বাইরে নয়, ঘরের ভিতরেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আত্মীয়-স্বজন দ্বারাও নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়। নির্যাতনের শিকার নারীরা মুখ খুলেও কথা বলতে পারেননা সামাজিকতার ভয়ে। তিনি নারীর প্রতি সহিংসতার বন্ধে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
পল্লব চাকমা বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে শুধু নারী নয়, পুরুষদেরও এগিয়ে আসতে হবে, তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমাদের নারীরা আমাদের মায়েরা যে সংগ্রাম করেন তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আমরা যদি আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে জেনে নিজেকে বদলাতে পারি আলো জ্বেলে জীবনকে সুন্দর করতে পারি তাহলে সমাজ একটি অবশ্যই পরিবর্তন হতে বাধ্য।
জান্নাতুল-এ ফেরদৌসি বলেন, তিনি বলেন মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী নারীদের অবদান আছে। তিনি বলেন তিনি মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী নারীদের অংশগ্রহনের ওপর গবেষনা করতে গিয়ে দেখেন যে ত্রিপুরা আদিবাসী নারী লাকড়ির ভিতর অস্ত্র লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন কিন্তু কেউ জানতে চায়নি তার নাম। এভাবেই অনেক নারী আদিবাসীর নাম কোন তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়নি।
সভাপতির বক্তব্যে চৈতালি ত্রিপুরা বলেন, যে সুপারিশমালা এসেছে সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে আদিবাসীরা দাবি জানিয়ে এসেছে। কিন্তু এই দাবিনামাগুলো সরকারের নীতি-নির্ধারকদের কাছে পৌঁছে না। হয়ত আমরা সরকারকে বুঝাতে পারছি না বা সরকার আমাদের দাবিগুলো এড়িয়ে চলছে। তাই আমাদের হয়ত সংগ্রামের কৌশল বদলাতে হবে।