হিল ভয়েস, ২২ নভেম্বর ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ষড়যন্ত্র এবং বমপার্টি খ্যাত কেএনএফের সুবিধাবাদী ও তাবেদারী কর্মকান্ডের কারণে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় বম জনগোষ্ঠীর লোকজন চরম দুর্ভোগে ও নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ফলে চরম নিরাপত্তাহীনতার কারণে গতকাল সোমবার (২১ নভেম্বর) বান্দরবান জেলার রুমা উপেজলার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়ন থেকে বম জনগোষ্ঠীর অনেক নারী-পুরুষ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী মিজোরাম প্রদেশের লংতড়াই জেলার চংতে মহকুমার সিমেনাছড়ায় আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে, আশ্রয়প্রার্থী বম গ্রামবাসীরা নারী ও শিশু সহ ৬৯ পরিবারের ২৭৮ জন বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে শিশুসহ ১৪৯ জন পুরুষ ও ১২৯ জন নারী। ৬৯ পরিবারের মধ্যে রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের থিংদলতে পাড়া থেকে ৩৪ পরিবার, চৈক্ষ্যং পাড়া থেকে ১২ পরিবার, সালৌপি পাড়া থেকে ১২ পরিবার, থেইখিয়াং পাড়া থেকে ২ পরিবার, সুনসং পাড়া থেকে ৫ পরিবার, প্হাই নোয়াম পাড়া থেকে এক পরিবার এবং রুমানা পাড়া থেকে ৩ পরিবার রয়েছে বলে জানা গেছে। স্থানীয় অধিবাসীরা আশ্রয়প্রার্থীদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করছে বলে জানা গেছে।
গতকাল সোমবার আশ্রয়প্রার্থী বম জনগোষ্ঠীর নারী ও শিশুদেরকে সিমেনাছড়া ব্যাপটিস্ট চার্চে এবং পুরুষদেরকে সিমেনাছড়া অঙ্গনওয়াড়ী স্কুলে আলাদা আলাদাভাবে রাখা হয়েছিল বলে জানা গেছে। সন্ধ্যার দিকে বিএসএফের হেফাজত থেকে মিজোরামের বিভিন্ন এনজিও ও স্থানীয় অধিবাসীদের পক্ষ থেকে আশ্রিত বম পরিবারসমূহকে বুঝে নিয়েছে বলে জানা যায়।
রুমার অনেক জনপ্রতিনিধি ও মুরুব্বী মিজোরামে আশ্রয় নেয়া বম জনগোষ্ঠীর লোকজনকে অচিরেই সসম্মানে স্ব স্ব গ্রামে ফিরিয়ে আনা এবং নিরপরাধ ও নিরীহ বম গ্রামবাসীর উপর কোন ধরনের হয়রানি না করার দাবি জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ফাঁদে কেএনএফ:
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বম জনগোষ্ঠীর একজন অধিকার কর্মী বলেন যে, “রাষ্ট্রীয় বাহিনী তথা বাংলাদেশ সরকারের পাতা ফাঁদে পড়ে এখন বম জনগোষ্ঠীর নিরীহ গ্রামবাসীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ২০০৮ সালে সেনাবাহিনীর তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইকবাল সুকৌশলে ভুলিয়ে নাথান বম ও ভাঙচুংলিয়ান বমের নেতৃত্বে বম জনগোষ্ঠীর কতিপয় ব্যক্তিদের নিয়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে একটি সংগঠন সৃষ্টি করে দেয়।”
তিনি আরো বলেন, “পরে কেএনডিও থেকে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামকরণ করে এই সংগঠনটি ৬টি জৌ জনগোষ্ঠীর জন্য বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির ৯টি উপজেলাকে নিয়ে কুকি-চিন রাজ্যের দাবি তুলে ধরে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উস্কানীতে সেই দাবি আদায়ের জন্য কেএনএফ ১৯৯৭ সালে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে।”
তিনি আরো যোগ করেন, “২০০৮ সালে কেএনডিও প্রতিষ্ঠার একদিন পর রুমা হাই স্কুল মাঠে সেনাবাহিনীর সহায়তায় “বম সম্প্রীতি সম্মেলন” নামে একটি সম্মেলন আয়োজন করা হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেই সম্মেলনে শুধু বম জনগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করা হয়। কেএনডিও যদিও ছয় জাতিগোষ্ঠীদের উন্নয়ন স্বার্থে গঠন করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও বাকি পাঁচ জনগোষ্ঠী (ম্রো, খুমি, খিয়াং, পাংখো ও লুসাই) প্রতিনিধিদেরকে সেই সম্মলনে আমন্ত্রণ করা হয়নি। তখন থেকেই কেএনডিও/কেএনএফ বম পার্টি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।”
উক্ত বম অধিকার কর্মী আরো বলেন, “যখন জনসংহতি সমিতির সাথে কেএনএফের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছলো, সেই মুহূর্তে সেনাবাহিনী কেএনএফ’কে ইসলামী জঙ্গি আশ্রয়দাতার প্রলেপ দিয়ে তাদের উপর হামলা শুরু করে দিল। এই সকল নষ্টের মূলে হচ্ছে কেএনএফ। এভাবেই আজ বাংলাদেশের বম জনগোষ্ঠী চরম দুর্ভোগে পড়েছে।”
ইসলামী জঙ্গীদের খপ্পড়ে বমপার্টি:
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর স্থানীয় কর্তৃপক্ষও বমপার্টি খ্যাত কেএনএফ কর্তৃক তাদের আস্তানায় ‘জামায়াত আরাকান’ বা ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দা শারক্বীয়’ (পূর্ববর্তী হিন্দের সাহায্যকারী দল) নামক ইসলামী জঙ্গী সংগঠনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়টি জেনেও না জানার ভান করে প্রকারান্তরে মদদ দিয়ে এসেছিল।
কেএনএফের আস্তানায় অর্থের বিনিময়ে ইসলামী জঙ্গীদের আশ্রয় প্রদান এবং প্রশিক্ষণ প্রদানের খবর প্রচারিত হলে সেনাবাহিনী, র্যাব ও এসএসএফ গত ৩ অক্টোবর থেকে বান্দরবানের রুমা ও রোয়াংছড়ি এবং রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলা অন্তর্গত রেইংক্ষ্যং উপত্যকায় কম্বিং অপারেশন চালায়।
উক্ত অভিযান পরিচালনার সময় সেনাবাহিনী এবং কেএনএফ ও ইসলামী জঙ্গীদের মধ্যে বন্দুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে কেএনএফ ও ইসলামী জঙ্গীরা সেনাবাহিনীর ৪ জন সদস্যকে হত্যা করে এবং ২টি অস্ত্র ও অনেক গোলাবারূদ ছিনিয়ে নেয় বলে জানা যায়। এতে সমস্যা আরো জটিল হয়ে উঠে।
সমস্যা সমাধানে বম মুরুব্বীদের সাথে সেনাবাহিনীর বৈঠক:
এমনিতর পরিস্থিতিতে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে গত ৩ নভেম্বর রুমার বেথেল পাড়া কমিউনিটি হলে রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি ও বান্দরবান সদর উপজেলার বম পাড়াসমূহের মুরব্বীদের সাথে বান্দরবান ৬৯ পদাতিক ব্রিগেড কমান্ডার ও রুমা জোন কমান্ডারের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত বৈঠকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বম জনগোষ্ঠীর মুরুব্বীদেরকে বলা হয় যে, পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে সেনাবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পন করতে, সেনাবাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্রগুলো ফেরত দিতে এবং ইসলামী জঙ্গীদেরকে সেনাবাহিনীর নিকট হস্তান্তর করতে নতুবা তাদের লোকেশন দেখিয়ে দিতে কেএনএফকে রাজী করানো।
সেনাবাহিনীর এই প্রস্তাবগুলো বম মুরুব্বীরা কেএনএফের নিকট পৌঁছে দিলেও নাথান বমরা রাজী না হয়ে আরো ক্ষুব্ধ হয় বলে জানা যায়। ফলে সেনাবাহিনী রুমা বাজারে বম জনগোষ্ঠীর সকল দোকানপাট বন্ধ করে দেয়। বম গ্রামবাসীদের উৎপাদিত কৃষিপন্য বিক্রি এবং বাজার থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনতে নানা ধরনের নিধিনিষেধ আরোপ করে। হাটে-বাজারে আসলে বম গ্রামবাসীদেরকে তল্লাসী ও জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। এতে বম গ্রামবাসীরা চরম দুর্ভোগে পড়ে।
কেএনএফ ও আরাকান আর্মীর মধ্যে সংঘাত:
সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেএনএফের সাথে বোঝাপাড়া করে দেয়ার জন্য আরাকান আর্মীকে কেএনএফের ঘাঁটি এলাকার দিকে পাঠিয়ে দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। আরাকান আর্মীরা রুমার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের চৈক্ষ্যং পাড়ায় গিয়ে স্থানীয় বম মুরুব্বীদের মাধ্যমে সেনাবাহিনী থেকে হাতিয়ে নেয়া অস্ত্রগুলো ফেরত দেয়া এবং ইসলামী জঙ্গীদেরকে সেনাবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করানোর প্রস্তাব দেয়। অন্যথায় কেএনএফ সাথে সাথে বম জনগোষ্ঠীর সাধারণ জনগণকে নানা ধরনের সমস্যার পড়তে পারে বলে আরাকান আর্মী জানায়।
এতে কেএনএফ সদস্যরা আরাকান আর্মীর উপর ক্ষেপে যায় এবং সাথে সাথে ১৬ নভেম্বর চৈক্ষ্যং পাড়ার সন্নিকটে আরাকান আর্মীদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ হামলায় আরাকান আর্মীর একজন সদস্য এবং একটি চাইনিজ এলএমজিসহ ২টি অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় বমপার্টি সশস্ত্র সদস্যরা। অপরদিকে প্হাইনোয়াম বম পাড়া ও দুলুচান পাড়ার মাঝখানে সেনাবাহিনীর সাথে কেএনএফেরও এক দফা গুলিবিনিময় হয়েছে বলে জানা যায়। ফলে আরাকান আর্মী ও কেএনএফের মধ্যকার বিরোধ এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে।
গোলাগুলির শব্দ শুনে ভয়ে ও জানমালের নিরাপত্তার জন্য গতকাল সোমবার (২১ নভেম্বর) চৈক্ষ্যং পাড়া, সুনসং পাড়া, সালৌপি পাড়া, থিংদলতে পাড়া ও প্হাইনোয়াম পাড়াসহ কয়েকটি গ্রামের বম জনগোষ্ঠীর অনেক বাসিন্দা মিজোরামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
সকল দুর্ভোগের মূলে কেএনএফ:
বস্তুত বমপার্টির প্রতিষ্ঠাতা নাথান বম ও ভাঙচুংলিয়ান বম কর্তৃক পার্বত্য চুক্তি ও চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতি, সর্বোপরি জুম্ম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যাগুরু চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমা জনগোষ্ঠী বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত হতে সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রের খপ্পড়ে পড়া এবং মাসিক অর্থ সহায়তার বিনিময়ে ইসলামী জঙ্গীদেরকে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দেয়ার মতো আত্মঘাতি কর্মকান্ডে জড়িত হওয়ার ফলেই বম জনগোষ্ঠীর নিরপরাধ গ্রামবাসী এমনতর দিশাহীন দুর্ভোগে পড়েছে বলে বম জনগোষ্ঠীর অনেক প্রবীন ব্যক্তি অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
বমপার্টি খ্যাত কেএনএফ এখন সেসব দুদর্শা কবলিত বম গ্রামবাসীদের মিজোরাম সীমান্তে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণের সুযোগে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের জৌ জনগোষ্ঠী থেকে সহানুভূতি ও সমর্থন লাভের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
হয়রানি বন্ধ ও সসম্মানে স্বদেশে ফিরিয়ে আনার দাবি:
মিজোরামে আশ্রিত বম জনগোষ্ঠীর নিরীহ ও নিরপরাধ গ্রামবাসীদেরকে উপযুক্ত পুনর্বাসন সহকারে অচিরেই স্ব স্ব গ্রামে ও এলাকায় ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসন তথা সরকারের নিকট দাবি জানিয়েছেন রুমা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অংথোয়াইচিং মারমা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও মুরুব্বী বলেছেন, বম জনগোষ্ঠীর কতিপয় সুবিধাবাদী ও তাবেদার ব্যক্তি ইসলামী জঙ্গীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় প্রদানে এবং অস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদানের মতো অপতৎপরতার সাথে জড়িত থাকলেও বম জনগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষ তাতে দায়ী হতে পারে না। কাজেই নিরপরাধ সাধারণ বম জনগণের উপর হাট-বাজার অবরোধ, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ক্রয়ে বিধি-নিষেধ, উৎপাদিত কৃষিপন্য বিক্রয়ে বাধা, যত্রযত্র তল্লাসী ও অহেতুক জিজ্ঞাসাবাদ, জুম ও ক্ষেত-খামারে যেতে বাধা ইত্যাদি হয়রানি ও নিপীড়ন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
এটা দেশের সংবিধান ও বাংলাদেশ কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত জাতিসংঘের মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি চরম লঙ্ঘন বলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। কাজেই নিরস্ত্র ও নিরীহ বম জনগোষ্ঠীর উপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হয়রানিমূলক কার্যক্রম বন্ধ করারও দাবি জানিয়েছেন উক্ত জনপ্রতিনিধি ও মুরুব্বীরা।