হিল ভয়েস, ২৪ নভেম্বর ২০২২, ঢাকা: আজ ২৪ নভেম্বর ২০২২ ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর উপলক্ষে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল আলোচনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, “সিকি শতক অতিবাহিত হলেও চুক্তি বাস্তবায়নে রাষ্ট্র কথা রাখেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে গেলেই বুঝা যায় যে, পার্বত্য চুক্তি সঠিক পথে হাঁটেনি।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন, এএলআরডি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও কাপেং ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে ঢাকায় ডেইলি স্টার সেন্টারের আজিমুর রহমান কনফারেন্স হলে “চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের উদাসীনতা: পাহাড়ি আদিবাসী ও নারীর নিরাপত্তা সংকট” শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
গোলটেবিল আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের সদস্য ও ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনায় প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, সাবেক তথ্য কমিশনার ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা প্রমুখ। বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চাকমা সার্কেল চীফ-এর উপদেষ্টা য়েন য়েন ও রিইব-এর নির্বাহী পরিচালক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা।
আলোচনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, সিকি শতক অতিবাহিত হলেও চুক্তি বাস্তবায়নে রাষ্ট্র কথা রাখেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে গেলেই বুঝা যায় যে, পার্বত্য চুক্তি সঠিক পথে হাঁটেনি। চুক্তি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে না পারা। তিনি আরও বলেন, এদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে দুষ্কর্ম, অপকর্ম যতটা দ্রুত ও সাহসের সাথে করা যায়, ভালো কাজের বেলায় রাষ্ট্র ততটাই দ্বিধায় ভোগে। সম্মিলিত নাগরিক জোট গঠনের মাধ্যমে আদিবাসী-বাঙালি ও প্রশাসনের মধ্যে আস্থা নির্মাণের কাজ শুরু করার আহবান জানান তিনি।
ড. সাদেকা হালিম বলেন, ভূমি সমস্যা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। পর্যটনের নামে ভূমি বেদখল চলছে। পাহাড়িদের মধ্যে ঐক্য না থাকলে ভূমি বেদখল আরও বাড়বে। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা থেকে একটি নাগরিক প্রতিনিধি দল বান্দরবানের লামার সরই ইউনিয়নে সদ্য নির্মিত একটি স্কুল পরিদর্শন করার জন্য যেতে চাইলে তাদের লামা রাবার কোম্পানির লোকজন বাধা প্রদান করে। আর এই লামা রাবার কোম্পানির মালিকানায় রয়েছে সাবেক আমলা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা।
শামসুল হুদা বলেন, সেটেলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের কাজটি জেনারেল জিয়াউর রহমান শুরু করেছিলেন। বর্তমান সরকার বিরোধীদল বিএনপির বিভিন্ন পলিসি/কাজের বিরোধীতা করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে জিয়ার শাসনামলের বিভিন্ন পন্থা এখনও কেন অনুসরণ করে চলছে সেটা আমরা এখান থেকে প্রশ্ন তুলতে পারি। সেটেলারদের বাধার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের পর পর দুটি গুরুত্বপূর্ণ সভা আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। তিনি আরও প্রশ্ন রাখেন যে, সেটেলারদের ইন্ধন কারা দেয়।
কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলেন, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু চুক্তির ফলে গঠিত মন্ত্রণালয়ে একজন মন্ত্রী বাদে বাকী সকল কর্মকর্তা কর্মচারী অ-আদিবাসী। পল্লব চাকমা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, সাম্প্রদায়িক হামলার কারণে তিনি নিজেই তিন তিনবার নিজ ভিটেমাটি থেকে উদ্বাস্তু হয়েছেন। অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন বিষয়ে তিনি বলেন, নব্বই দশক থেকে আশি হাজারের অধিক পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে সরকারিভাবে আজ অবধি কোনো সহায়তা প্রদান করা হয়নি। তিনি আরও প্রশ্ন রাখেন, যারা শান্তি স্থাপনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন আজ কেন তাদের সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে?
প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর অতিবাহিত হলেও চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন আজও হয়নি। তিনি বলেন, সরকারি ভাষ্যমতে, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং অপর ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরকারী অপরপক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মতে, ৭২টির মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, অবশিষ্ট ১৮টি ধারার আংশিক এবং বাকি ২৯টি ধারা সম্পূর্ণভাবে অবাস্তবায়িত হয়েছে বলে জেএসএস এর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বিধিমালা আজও প্রণীত না হওয়ায় কমিশনটি অকার্যকর হয়ে রয়েছ। ফলে এ যাবত কমিশনের কাছে ২২ হাজারের অধিক ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির আবেদন জমা পড়লেও একটি আবেদনই আজ অবধি নিষ্পত্তি হয়নি।
তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লংঘন, বাক স্বাধীনতা ও চলাফেরা এবং সমাবেশের অধিকার হরণের ঘটনা ঘটছে। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে গ্রেপ্তার, জেল গেট থেকে পুনরায় আটক, এমনকি গুম, হত্যার ঘটনাও ঘটছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অপরদিকে য়েন য়েন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নারীদের প্রতি সহিংসতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তিনি এও উল্লেখ করেন যে, সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতাও বাড়ছে। তবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নারীদের প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রা রয়েছে বিশেষত সেখানকার ভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস, নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো, সামরিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় আধিপত্য ও সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন। আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতার ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির মধ্যে রয়েছে, ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা, ধর্ষণের পর হত্যা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, পাচারের জন্য বিয়ে ও অপহরণ ইত্যাদি।
তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তা বাহিনী যখন এ ধরনের অপরাধ সংঘটনের সাথে সম্পৃক্ত থাকে, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনী নির্যাতিতার পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে যেমন বাধাগ্রস্ত করে তেমনি অনেক ক্ষেত্রে যারা এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ ও বিচার দাবি করে তাদেরও বিভিন্ন ধরনের হয়রানি ও হামলার শিকার হতে হয়।
সভাপতির বক্তব্যে খুশী কবির বলেন, এদেশের নাগরিক হিসেবে সবার জানা দরকার, চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পরও কেন চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অনেক আলাপ-আলোচনার পর ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পরও যদি তা বাস্তবায়নের এই অবস্থা হয় তাহলে সেটা পাহাড়ের আদিবাসীদের সাথে প্রতারণার সামিল। প্রগতিশীল নাগরিক যারা চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলেন তাদের ওপর আক্রমণ করা হয়। উদারহণ হিসেবে তিনি ২০১৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের ওপর সহিংস হামলার কথা উল্লেখ করে বলেন, প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতেই কিভাবে এ ধরনের সহিংস হামলা করা সম্ভব? আমরা চেয়েছিলাম একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ যেখানে ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকল নাগরিক সমঅধিকার, সমান মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে সেটা নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
এছাড়া আলোচনা সভায় আরো বক্তব্য রাখেন আফজাল হোসেন, রেঙয়াং ম্রো, প্রভারানী বাড়াইক প্রমুখ।