পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পার্বত্যাঞ্চলের টেকসই উন্নয়ন করতে হবে

0
457

হিল ভয়েস, ৫ ডিসেম্বর ২০২২, ঢাকা: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের টেকসই উন্নয়ন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের টেকসই উন্নয়ন করতে হলে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের সাথে সাথে সুস্থ প্রশাসন, সুস্থ আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা খুব জরুরী।

আজ ৫ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে কাপেং ফাউন্ডেশন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এন্ড ডেভেলভমেন্ট (এএলআরডি) ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের আয়োজনে “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছর: পার্বত্য চট্টগ্রামের টেকসই উন্নয়ন, সংকট ও সম্ভাবনা” শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এই অভিমত তুলে ধরেন।

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এবং সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। আলোচনায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এন্ড ডেভেলভমেন্ট (এএলআরডি)-এর নির্বাহী প্রধান শামছুল হুদা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম এবং বাংলাদেশের এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এর আহ্বায়ক ও অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রমুখ।

আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য দেন কাপেং ফাউন্ডেনের চেয়ারপারসন ও জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা।

জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, উন্নয়নের দু’টি পূর্বশর্ত হল সুস্থ প্রশাসন ও সুস্থ আইন-শৃঙ্খলা। কিন্তু পার্বত্য চট্ট্রগামের উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই দুটি বিষয়ই অনুপস্থিত রয়েছে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে বাঘাইছড়ি হয়ে সাজেক পর্যন্ত রাস্তার নির্মাণে সমালোচনা করে তিনি বলেন, সরকার উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে, জুমের ক্ষেত নষ্ট করে, মানুষের জীবনধারা বিনষ্ট করে, প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট  করেছে।

শ্রী লারমা আরো বলেন, যে উন্নয়ন হচ্ছে, সেই উন্নয়ন স্থানীয় অধিবাসীদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের টেকসই উন্নয়ন করতে হলে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের সাথে সাথে সুস্থ প্রশাসন, সুস্থ আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা খুব জরুরী বলে মন্তব্য করেন। শেষে তরুণ সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, হতাশ না হয়ে সংগ্রামের দিক চিহ্নিত করে পাহাড়ের সমাজব্যবস্থাকে গভীরভাবে বুঝতে হবে।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বর্তমান সরকারের একটি উজ্জ্বলতম ঐতিহাসিক চুক্তি। অস্ত্র সমর্পনের দিন তার থাকার সৌভাগ্য হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন, পার্বত্য চুক্তির সময় যে আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল এখন তা তিরোহিত হয়েছে বলে তিনি মতামত প্রদান করেন। পার্বত্য চুক্তির সময় যে দু’পক্ষ ছিল ২৫ বছর পূর্তি উদযাপনে সেই দুই পক্ষের উপস্থিতি দৃশ্যমান নয়।

তিনি আরও বলেন, ভূমিই পার্বত্য চট্টগামের মূল সমস্যা। এখানে ভূমি কমিশনের কার্যকারিতা নিয়ে  তিনি বলেন, ভূমি কমিশন কাজ করতে পারছে না, মিটিং করতে পারছে না। তাহলে কি সরকার অকার্যকর হয়েছে কিনা তিনি প্রশ্ন তোলেন। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীল আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্র আদিবাসীদের ভাগ কর, শাসন করো পরিস্থিতি তৈরি করে সেখানে দুর্যোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। কিন্তু এটা জাতীয় রাজনীতিকেও মূলত দুর্বল করে তোলে।

শামছুল হুদা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু জনগনের জন্য উন্নয়ন হয়নি। কারণ যাদের জন্য উন্নয়ন গ্রহণ করা হয়েছে তাদের অংশগ্রহণ বা সম্পৃক্ততা নেই। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি কোন ব্যক্তির সাথে চুক্তি নয়। এ চুক্তি রাষ্ট্রের সাথে হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র তার জনগনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। চুক্তি বিরোধী কার্যকলাপকে সমর্থন করেছে। আমাদেরকে হতাশ করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা হতাশার কাছে মাথানত করব না। সেটলারদেরকে স্ব স্ব জেলায় পুনর্বাসন করার দাবী জানান তিনি। আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার নিশ্চিত করার উপর জোর দিয়ে বলেন, সরকারকেই এই চুক্তি বাস্তবায়নের একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে।

অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, আমরা গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র চাই। আর গণতান্ত্রিক পন্থার সব পথ যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন মানুষকে অস্ত্র তুলে নিতে হয়। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। পার্বত্য চুক্তি যেহেতু বর্তমান সরকারের মাধ্যমে হয়েছে তাই এই সরকারকেই এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সাথে তিনি সরকারকে রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানান।

তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে যে চুক্তি হয়েছে সেই পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের জন্ম হয়েছে সেই মন্ত্রণালয়ে আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে কম বাজেট বরাদ্দ প্রদান করা হয়। সংবিধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নি:সন্দেহে ১৯৭২ সালের সংবিধান ভাল একটি সংবিধান কিন্তু ১৯৭২ সালের সংবিধানে বহুজাতিকতার স্বীকৃতি নেই।

শাহীন আনাম বলেন, বর্তমান সরকার ঐতিহাসিক কাজ করার পরও সরকার কেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন করেনি? কনফিডেন্স বিল্ডিংএর কার্যক্রম হাতে নেয়া হলেও কনফিডেন্স বাড়েনি বরং কমেছে। আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে তিনি বলেন, আদিবাসী নারী সহিংসতার শিকার হওয়ার পিছনে ভূমির সম্পর্ক রয়েছে। মূলত ভূমি বেদখলের উদ্দেশ্যেই আদিবাসী নারীরা সহিংসতার শিকার হয়। বাক-স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উন্নয়ন সংগঠনগুলো যখন মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে তখন তাদেরকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে আখ্যায়িত করা হয়।

ভূমি বিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে ভূমির সমস্যা সমাধানের জন্য। তাই পাহাড়ে উন্নয়ন করতে হলে শান্তি ও নিরাপত্তার দরকার সেখানকার আদিবাসীদের। শিক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুগর্ম এলাকায় স্কুলের অপ্রতুলতা ও শিক্ষক সংকট রয়েছে। এত সংকটের মধ্যেও আদিবাসীদের সংস্কৃতির চর্চার আহ্বান জানিয়ে বলেন যে, সংস্কৃতি হারিয়ে গেলে বাংলাদেশের বৈচিত্র্যতা আর থাকবে না।

কাজল দেবনাথ পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীল রাজনীতি প্রসঙ্গে বলেন, রাষ্ট্র চাইলে ও আন্তরিক হলে এখানে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

হতাশ না হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য সকলকে কাজ করার আহ্বান জানান সভার সভাপতি সঞ্জীব দ্রং। মুক্ত আলোচনায় জুমলিয়ান আমলাই, সন্তোষিত চাকমা বকুল, এ্যাডভোকেট চঞ্চু চাকমা প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।