হিল ভয়েস, ৯ আগস্ট ২০২৩, ঢাকা: আজ ৯ আগস্ট ২০২৩, সকাল ১০.০০টায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের উদ্যোগে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২৩’ উপলক্ষ্যে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সমাবেশ, র্যালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সমাবেশে সভা প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি এবং উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। এছাড়াও সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, ড. খায়রুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিণ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি শাহ আলম, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন প্রমুখ। উক্ত অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।
সমাবেশে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা বলেন, জাতিসংঘ আজকে যে স্লোগান নির্ধারণ করেছে তাতে তারুণ্যের শক্তিকে গুরুত্ব দেয়া হযেছে। যুগে যুগে যুবশক্তি সমাজের সংকটে পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি মনে করি এখনো পর্যন্ত আদিবাসী যুব সমাজের নেতৃত্বের মধ্যে প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। পুঁজিবাদী ও আদিপত্যবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে ও আদিবাসী সমাজের যে শোষণ বঞ্চনা তার প্রতিবিধানে আদিবাসী যুবদেরকে অধিকতরভাবে একাত্ম হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীরা আজ বিলুপ্ত প্রায়। এই বিলুপ্ত প্রায় আদিবাসীদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ও আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার নিয়ে বিকশিত হওয়ার অধিকার অর্জনের লড়াইয়ে আদিবাসী তরুণদেরকেই আরো অধিকতর ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি বলেন, জাতিসংঘ এবার স্লোগান নির্ধারণ করেছে যার একটি আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং আরেকটি তারুণ্যের এগিয়ে যাওয়া। যে আদিবাসী তরুণরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তাদের অধিকার, পরিচয়ের স্বীকৃতি ভুলুন্ঠিত করা হল সংবিধানে। যার কারণে আদিবাসীদের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে সংগ্রাম হয়েছে পাহাড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগ্রাম হয়েছে। পরে আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে এখনও গড়িমসি করা হচ্ছে। ১৯৫৬ সালে যেমন সংবিধানে স্বীকৃতি দিয়েও আমাদের রাষ্ট্রভাষা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জিত হয় নি, পাকিস্তানিরা গড়িমসি করেছে, আজও পাহাড়ে পার্বত্য চুক্তি করে তার বাস্তবায়ন নিয়ে গড়িমসি করা হচ্ছে। সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু সেটাও গঠন করা হয়নি। বাঙালি-আদিবাসী মিলে সামষ্টিক লড়াইয়ের মাধ্যমে এসব দাবি আদায় করতে হবে। আদিবাসী যুবদের পাশাপাশি বাঙালি যুবদেরকে তারুণ্য শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে আনতে পারবো।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি শাহ আলম বলেন, সরকার পার্বত্য চুক্তি করেছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করছে না। বিভিন্ন সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার কথা বলে বিভিন্ন বাহিনীকে বছরের পর বছর সেখানে রাখছেন। জাতীয় বাজেট থেকে বহু খরচ সেখানে চলে যাচ্ছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হলে এসবের দরকার পড়তো না। আমাদের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। সমতলের আদিবাসীরা অনেক নিপীড়নের মধ্যে জীবন যাপন করছে। অহরহ ভূমি দখল হচ্ছে, সেসব ঠেকানো যাচ্ছে না। সমতলের আদিবাসীদের ভূমি অধিকার রক্ষায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে এবং অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করে সেখানে সেনাশাসনের অবসান ঘটাতে হবে। তার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান এই নেতা ।
আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জীবন দেয়া আদিবাসী যুবকদের প্রতি লাল সালাম জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, সংবিধান, রাষ্ট্রপরিচালনার সকল নীতির মধ্যে আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করে স্বীকৃতি দিতে হবে। অসত্য তথ্য দিয়ে আমাদের সংবিধান শুরু হয়েছে, তাঁদের উপজাতি বলা হয়েছে, নীতিভিত্তিকভাবে তৈরি হয়নি আমাদের সংবিধান। তার মাধ্যমে তাঁদের অপমান করা হয়েছে, অর্থের দ্বৈত্ববোধ সৃষ্টি করা হয়েছে, স্বীকৃতির নামে অপমান করা হয়েছে। আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে না পারলে শ্রদ্ধা করবেন কিন্তু অসম্মান করবেন না। চুক্তি করার মধ্যে গৌরব নেই, সাফল্য, গৌরব চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে। চুক্তি বাস্তবায়ন না করে ১৯৯৭ এর চুক্তিকে চরম অপমান করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী শূন্যকরণের প্রক্রিয়া চলমান। সামাজিক, রাজনৈতিক সর্বত্রই তাঁদের সংখ্যালঘু বানানো হচ্ছে। যে বাঙালি ২৫ বছর জাতিগত, ভাষাগত নিপীড়নের শিকার, সে বাঙালি জাতি আজ জাতিগত ও ভাষাগত নিপীড়নের ভূমিকায়। আমরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে না কিন্তু শাসনের বিরুদ্ধে। বহুত্ববাদের পরিবর্তে আজ উগ্রবাদ ছড়াচ্ছে। রাষ্ট্রকে কেবল ধর্মনিরপেক্ষ হলে চলবে না। জাতিগত, ভাষাগত, লিঙ্গ, যৌনতা নিরপেক্ষ হতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, জাতিসংঘ বলছে আদিবাসীদেরকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতে হবে। অর্থাৎ তাদের ফ্রি অব চয়েস দিতে হবে যেন তারা তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে। আমরা তাদেরকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিচ্ছি কিন্তু ‘আদিবাসী’ বলতে নারাজ। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তাদেরকে বলা হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। তরুণ আদিবাসীদের নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরে সমস্ত কোটা তুলে দেয়া হয়েছে, কিন্তু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তরুণদের জন্য কোটা সুবিধা এখনও প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, একা একা কাজ করে কবিতা লেখা যায় কিন্তু সমাজ পরিবর্তন করা যায় না। তাই তরুণদেরকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। পাহাড়ে চুক্তি বাস্তবায়ন হয় নাই, চা বাগানের আদিবাসীরা, উপকূলের আদিবাসীরা, মধুপুরের আদিবাসীরা নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে আমাদেরকে দাঁড়াতে হবে। আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবেই দাঁড়াতে হবে। সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমাদের লড়াই এগিয়ে নিতে হবে এবং এই তরুণরাই আমাদেরকে পথ দেখাবে। আদিবাসী তরুণদের সাথে মূল ধারার তরুণদেরকে সামিল হওয়ারও আহ্বান জানান এই আদিবাসী গবেষক।
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, আমরা অনেক বেদনার কথা শুনছি, বঞ্চনার কথা শুনছি। রাষ্ট্র আদিবাসীদের পরিচিতিকে বিকৃত করে দিয়েছে। শুধু বিকৃত নয়, হেয় প্রতিপন্ন করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলা হচ্ছে। আমাদের দেশে নানাভাবে আদিবাসীদের প্রান্তিকীকরণ করা হচ্ছে। ধর্ম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রান্তিক করারও চেষ্টা চলছে। কিন্তু ধর্ম পরিবর্তন করাতে পারলেও জাতি ও ভাষারতো পরিবর্তন করা যাবে না। আদিবাসী যুবরা সমস্ত রকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ও বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে এগিয়ে আসবে বলে মনে করেন বাসদের এই নেতা।
ফজলে হাসান বাদশা বলেন, আমাদের সরকার একটা বিভ্রান্তির মধ্যে আছে। তারা চুক্তি করে, বাস্তবায়ন করে না। পাহাড়ে ভূমি কমিশন কার্যকর হচ্ছে না। সমতলেও ভূমি কমিশন গঠন করার কথা, সেটা হচ্ছে না। আমাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এসবের সুরাহা করতে হবে। তার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই চালানোর কোনো বিকল্প নেই।
এছাড়াও বক্তব্য রাখেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক বনশ্রী মিত্র নিয়োগী, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন, এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাংলাদেশ খ্রিষ্টান এসোশিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক হরেন্দ্র নাথ সিং, সহ-সাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্র নাথ মাহাতো, অর্থ সম্পাদক মেইনথিন প্রমিলা, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সহ-সাধারণ সম্পাদক জগদীশ চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য অনন্যা দ্রংসহ নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
এদিকে সমাবেশ শেষে গণসংগীত পরিবেশন করে আদিবাসীদের গানের দল ‘মাদল’, সমগীত ও এফ মাইনর। এছাড়া আদিবাসী কালচারাল ফোরাম ও আন্যান্যদের পরিচালনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। পরে শহীদ মিনার থেকে একটি র্যালি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ও রাজু ভাস্কর্য হয়ে আবার শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। এবারের আদিবাসী দিবসের মূল সুর ছিল ‘আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আদিবাসী তরুণরাই মূল শক্তি’।