হিল ভয়েস, ২৪ মে ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদক: বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কয়েকটি দল যৌথভাবে বান্দরবান পার্বত্য জেলার বান্দরবান সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক সেনা অভিযান চালাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এপর্যন্ত সেনা অভিযানে সেনাবাহিনী কর্তৃক অন্তত ৯ জন আদিবাসী জুম্ম বেধড়ক মারধরের শিকার এবং গ্রামবাসীদের দেশান্তরিত করার হুমকি, গালিগালাজ ও বাড়িতে তল্লাশি চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ১৯ মে ও ২০ মে ২০২৫ থেকে এই সেনা অভিযান শুরু হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। এরপর থেকে অনেকেই ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এবং নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে অনেক তথ্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৯ মে ২০২৫, ৩১বীর আলীকদম সেনা জোনের অধীন আলীকদম সেনা ক্যাম্পের সহকারী কমান্ডার মেজর মনজুর মোর্শেদ এবং লামা সেনা ক্যাম্পের জনৈক ক্যাপ্টেন ও ওয়ারেন্ট অফিসারের নেতৃত্বে ২৪০/২৫০ জনের একটি যৌথ সেনাদল বিকাল ৪টার দিকে বান্দরবান সদরের টংকাবতী ইউনিয়নে সেনা অভিযান শুরু করে। এইসময় সেনা সদস্যরা টংকাবতী ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের পুনর্বাসন চাকমা পাড়া ও ত্রিপুরা পাড়ার দুই জুম্ম গ্রামবাসীকে বিদ্যুতের খুঁটির সাথে বেঁধে ব্যাপকভাবে মারধর করে এবং গ্রামবাসীদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে।

মারধরের শিকার উক্ত গ্রামবাসীরা হলেন- ১. নয়ন চাকমা (১৪), পীং-অমরসেন চাকমা, গ্রাম-চাকমা পাড়া এবং ২. জুমারাং ত্রিপুরা (৪৫), পীং-মৃত জপুরাম ত্রিপুরা, গ্রাম-ত্রিপুরা পাড়া। নয়ন চাকমা একজন ছাত্র।
এই সময় সেনা সদস্যরা রুমা ও থানচি উপজেলার বম জনগোষ্ঠীকে যেভাবে উচ্ছেদ করে দেশান্তরিত করা হয়েছে, ঠিক সেইভাবে চাকমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীদেরকেও দেশান্তরিত করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সেনা সদস্যরা এখনো সেই এলাকায় অবস্থান করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

অপরদিকে, ২০ মে ২০২৫ থেকে বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক আমতলী সেনা ক্যাম্প কমান্ডার মোবারক এর নেতৃত্বে শতাধিক সদস্যের আরেকটি সেনাদলও সুয়ালক, টংকাবতী ও চিম্বুক এলাকায় সেনা অভিযান শুরু করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ঐদিনই অভিযান পরিচালনাকারী সেনা সদস্যরা টংকাবতীর চিনি পাড়া গ্রামে গিয়ে এক বাঙালি সহ ৭ জুম্ম গ্রামবাসীকে ব্রীকফিল সেনা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে ব্যাপক মারধর করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
মারধরের শিকার উক্ত গ্রামবাসীরা হলেন- ১. মেনচ্যং ম্রো (৩৫), ২. মেনপা ম্রো (৩৮), ৩. কার্বারি সাকরুই ম্রো (৪৫), ৪. সাকসিং ম্রো (৩০), ৫. মেনদুই ম্রো (৩৫), ৬. ক্লংলাই ম্রো (২৫) ও ৭. বেলাল হোসেন (২৫)। এই গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অভিযোগ, তাদের গ্রামে নাকি শান্তিবাহিনী আসে।
আরও জানা যায়, সেনা সদস্যরা উক্ত গ্রামবাসীদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়ে, কারা কারা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন চায় তা জানতে চায় এবং মারধর করে। এছাড়া, চুক্তি বাস্তবায়ন চায় এমন দলের সাথে যোগাযোগ করার অভিযোগ প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও সেনা সদস্যরা হুমকি দেয়।
এখনো চিনি পাড়া, ব্রীকফিল পাড়া, লাকুরী পাড়া, টংকাবতী চাকমা পুনর্বাসন পাড়া এবং ষোল মাইল (চিম্বুক) এলাকায় সেনা অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানা যায়। এতে বাড়িতে বাড়িতে হয়রানিমূলক তল্লাসি এবং বাড়ির জিনিসপত্র তছনছ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

বর্তমানে টংকাবতী ব্রীকফিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪৫ জনের একটি সেনাদল অবস্থান করছে বলে জানা যায়। অভিযোগ এসেছে, সেনাবাহিনী ঐ স্কুলে অবস্থান করায় শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের ক্লাশে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। শিক্ষকবৃন্দ বিদ্যালয়ে গেলে তারাও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে। বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অবগত করা হলে তারাও ভয়ে মুখ খুলছে না। হেডম্যানকে জানানো হলে তিনিও বিষয়টি কাউকে জানাতে পারছেন না ভয়ে।
এছাড়া, ষোল মাইল এলাকায় প্রায় ৩০ জন এবং লোহাগাড়া উপজেলায় ক্যরম্বা ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী আনন্দ মোহন চাকমা কার্বারী পাড়ায় প্রায় ৪৫ জন সেনাসদস্য অবস্থান করছেন বলে জানা যায়।
এদিকে, সেনা অভিযানে নির্যাতন-নিপীড়নের ভয়ে এলাকার পুরুষরা প্রায় আত্মগোপনে রয়েছে বলে জানা যায়। হাট-বাজার কিংবা দৈনন্দিন কোনো কাজেই যেতে পারছে না স্থানীয়রা। তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
একাধিক গ্রামবাসী জানান, হঠাৎ কার বা কাদের ইশারায় এধরনের সেনা অভিযান চলছে তাদের বোধগম্য নয়। আমরা আতঙ্কে আছি। আমরা কাজ করে খাই। এখন ঘর থেকেও বের হতে পারছি না।
+ There are no comments
Add yours