হিল ভয়েস, ১০ জুলাই ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদন: গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্ম এলাকায় ইপিজেড স্থাপনের নামে সাঁওতাল কৃষকদের উচ্ছেদ চেষ্টার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ৩২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। একই সঙ্গে বিগত দেড়-দুই দশকে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) স্থাপন নিয়ে সংঘটিত দুর্নীতি ও অনিয়মের নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিও জানিয়েছেন তাঁরা।
গত বুধবার (৯ জুলাই) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই দাবি জানান তারা।
বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, আমরা গভীর উৎকন্ঠা ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করছি, বিগত স্বৈরশাসনের অনুগতদের পথ অনুসরণ করে এক শ্রেণির দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা এবং একটি দুষ্টচক্র দেশের যত্রতত্র বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কিংবা ইপিজেড-এর নামে দেশের অনেক উর্বর কৃষি জমি অধিগ্রহণ এবং আবাদী দরিদ্র কৃষক এবং বিশেষভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা চালিয়ে যাচ্ছে। এই মূহূর্তে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্ম এলাকার সাঁওতাল কৃষকদের উচ্ছেদ করতে সেখানে ইপিজেড করার ঘোষণা দিয়ে একটি সংঘবদ্ধ দুর্নীতিবাজ চক্র অতি তৎপর হয়ে উঠেছে।
অথচ ঐ ধরনের ইপিজেড অথবা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে হলে তার জন্য প্রকল্প গ্রহণের আগেই স্বাধীন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা যে পরিবেশ-এর উপর প্রভাব নিরূপণের জন্য ইআইএ এবং সামাজিক প্রভাব পরিমাপের জন্য এসআইএ করার বাধ্যতামূলক বিধান রয়েছে তার কোনটাই ওখানে করা হয়নি। শুধু গোবিন্দগঞ্জ নয়, বিগত সময়ে ঘোষিত বেশির ভাগ ইপিজেডের ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়াগুলো মানা হয়নি।
তাঁরা বলেন, পেশাগত ও সম্মিলিত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিগত দেড়-দুই দশকে ইপিজেড (এক্সপোর্ট প্রোসেসিং জোন) স্থাপন কেন্দ্রিক যে সকল প্রকল্প বাস্তবাযন করা হয়েছে তাতে প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে অনেক ক্ষেত্রে জনদুর্ভোগ, জন হয়রানি, প্রান্তিক কৃষক, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদ ইত্যাদি যে শুধু বেড়েছে তা নয়, বরং ঐ সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতিরও অনেক অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও ইপিজেড-এর নামে যে সকল কৃষি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তার একটি বড় অংশ দুই ফসলা/তিন ফসলা উর্বর কৃষি জমি। অনেক জমি অধিগ্রহণ করার পরে অনেক বছর অতিবাহিত হলেও সেখানে কোন ইপিজেড-এর কার্যক্রম চালুই হয়নি। যে সকল কৃষকদের কাছ থেকে ঐ সব উর্বর কৃষি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি বলেও অভিযোগ আছে। এই সকল প্রকল্পে শত শত কোটি টাকা বিগত বছরগুলিতে লুটপাট ও আত্মসাতেরও অনেক অভিযোগ রযেছে।বিগত ১৬ বছরের স্বৈরশাসনামলে ১০০টি ইপিজেড বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের ঘোষণা দিলেও বাস্তবে প্রায় ৩৩ হাজার একর অধিগ্রহণকৃত জমিতে মাত্র ১০টি ইপিজেড বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করা হয়েছিল। যার ৮টি সরকারি উদ্যোগে, বাকী ২টি বেসরকারি উদ্যোগে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল বেজার কর্তৃপক্ষের অভিমত অনুসারে এই সব ইপিজেড খাস জমি, পুনরুদ্ধার হওয়া ভূমি ও অকৃষি জমিতে স্থাপিত হওযার কথা থাকলেও, বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেশির ভাগ ইপিজেড-এর অধিকাংশ জমি ২/৩ ফসলা উর্বর কৃষি জমি।
এছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে যে কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হয়েছে, সেই ক্ষেত্রেও সরকারের অধিগ্রহণকৃত জমি কিংবা বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের বৈধ/ অবৈধভাবে দখলকৃত ভূমিরও বড় অংশই উর্বর কৃষি জমি অথবা ভরাট করা জলাধার। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের একটি অংশ অবৈধ উপায়ে উর্বর কৃষি জমিতে বালু ফেলে তাকে প্রথমে অনুর্বর করে, তারপর তাকে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে- নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁওসহ এ রকম দুর্বৃত্তপনার একাধিক নজির রয়েছে। যদিও সম্প্রতি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা)-এর চেয়ারম্যান তাদের অধীনে থাকা ১০টা অর্থনৈতিক অঞ্চল বাতিল ঘোষণা করেছেন এবং তিনি বলেছেন, বর্তমান বাস্তবতায় আগামী ১০ বছরে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করা গেলেই তা যথেষ্ট হবে।
এই প্রেক্ষাপটে নাগরিকেরা সরকারের কাছে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেছেন। দাবিগুলো হল-
১. গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ -এর বাগদা ফার্ম এলাকায় কৃষি কাজে নিয়োজিত ও বসবাসরত সাঁওতাল আদিবাসীদের উচ্ছেদের অসৎ উদ্দেশ্যে ইপিজেড স্থাপনের যে প্রচেষ্টা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং জেলা প্রশাসনের কোন কোন কর্মকর্তার প্রচ্ছন্ন সমর্থনে একটি সংঘবদ্ধ চক্র চালিয়ে যাচ্ছে বলে যে অভিযোগ আছে, তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
২. এ পর্যন্ত যে সকল ইপিজেড স্থাপিত বা প্রস্তাবিত হয়েছে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে সেগুলির ভূমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে তার সার্বিক বাস্তবায়নে কোন ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম, আইনের লংঘন হয়েছে কি না, সাধারণ দরিদ্র কৃষক, আদিবাসী কিংবা অন্য কোন জনগোষ্ঠী ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন কিংবা অন্য কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কি না তা তদন্ত করে দেখার জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।
৩. ইপিজেড, এসইজেড করতে গিয়ে কী পরিমাণ উর্বর কৃষি জমি বিনষ্ট হয়েছে কিংবা এখনো অব্যবহৃত পড়ে আছে তা নিরূপণ করতে হবে। ইপিজেড অথবা এসইজেড বাস্তবায়নের নামে পরিবেশ ও কৃষির কী পরিমাণ ক্ষতি করা হয়েছে তা জানা জরুরি। অবশ্যই তা নিরূপণ করতে হবে।
৪. যারা দুর্নীতি, অনিয়ম, অনাচার বা কৃষকদের সাথে প্রতারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে জবাবদিহি ও শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. যে সকল ইপিজেড বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এখনো অব্যবহৃত রয়েছে ঐ সকল অঞ্চলকে অধিগ্রহণ থেকে অবমুক্ত করে যে সকল কৃষকদের জমি হুকুম দখল করা হয়েছিল, প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে বিশেষ ব্যবস্থায় তা কৃষিতে ফেরৎ দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকৃত ৩২ বিশিষ্ট নাগরিকরা হলেন-
ড. হামিদা হোসেন, সুলতানা কামাল, খুশী কবির, ড. ইফতেখারুজ্জামান, রাশেদা কে. চৌধুরী, শিরীন পারভীন হক, শাহীন আনাম, ড. সুমাইয়া খায়ের, অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, এড. তাসলিমা ইসলাম, সামিনা লুৎফা, শামসুল হুদা, রোবায়েত ফেরদৌস, ড. জোবাইদা নাসরীন, ড. স্বপন আদনান, অ্যাডভোকেট সালমা আলী, এড. সুব্রত চৌধুরী, তাসনীম সিরাজ মাহবুব, ড. খায়রুল চৌধুরী, পাভেল পার্থ, অ্যাড. মিনহাজুল হক চৌধুরী, মনীন্দ্র কুমার নাথ, রোজিনা বেগম, মাইদুল ইসলাম, ড. সাদাফ নূর, অধ্যাপক, রেজাউল করিম চৌধুরী, জাকির হোসেন, দীপায়ন খীসা, অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান, রেজাউর রহমান লেলিন, সাঈদ আহমেদ, হানা শামস আহমেদ।