হিল ভয়েস, ৯ আগস্ট ২০২৩, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটিতে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও ২৯৯ পার্বত্য রাঙ্গামাটি আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার বলেছেন, ‘আদিবাসী বিষয় নিয়ে অনেকের ভুল ধারণা রয়েছে। যারা আদিবাসী বলছে তাদেরকে সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে। আদিবাসী বললে সবাইকে সন্ত্রাসী বলতে হবে এটা কিন্তু সঠিক নয়, এটা বলা উচিত নয়, এটা বরঞ্চ উস্কে দিয়ে অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা।’
আজ ৯ আগস্ট ২০২৩, সকাল ৯:৩০ টায় রাঙ্গামাটি জেলা সদরের পৌরসভা প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল শাখার উদ্যোগে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উদ্বোধক ও প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রী ঊষাতন তালুকদার এবং সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল শাখার সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা (অব: উপ-সচিব)। এতে আরও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট চঞ্চু চাকমা, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সহ-সভাপতি তপন কান্তি বড়ুয়া, এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি সমির কান্তি দে, বিলাইছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শ্যামা চাকমা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উদ্বোধক ও প্রধান অতিথি ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘আজ আদিবাসী দিবস শুধু এখানে নয়, সারা বিশ্বে প্রতিপালিত হচ্ছে। যারা শাসক-শোষকগোষ্ঠী কর্তৃক নির্যাতিত, নিপীড়িত হয় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হতে হচ্ছে, এদের কেউ কেউ বিলুপ্তির পথে, কেউ কেউ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এমনি অবস্থার মধ্যে রয়েছে, সেসব জনগোষ্ঠীকে জাতিসংঘ কিভাবে এড্রেস করতে পারে বা তাদের বিষয়ে কী ভাবনা থাকতে পারে সেই নিরিখে ভাবনার মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ ১৯৯৪ সালে ২৩ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদে প্রতিবছরের ৯ আগস্টকে আদিবাসী দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। এই আদিবাসী দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো, জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, নাগরিক সমাজ, মিডিয়াসহ সংশ্লিষ্ট সকলে যেন আদিবাসীদের অধিকার সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হন এবং আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন।’
তিনি বলেন, ‘অনেকের ভুল ধারণা রয়েছে আদিবাসী নিয়ে। যারা আদিবাসী বলছে তাদেরকে সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে। সারা বিশ্বে ৭০টি দেশে ৪০ কোটি আদিবাসী রয়েছে। আমরা এদেশে পাহাড়ি ও সমতল মিলে প্রায় ৪০ লক্ষ আদিবাসী আছি। তাহলে এই ৪০ লক্ষ আদিবাসী কি সবাই সন্ত্রাসী? আবেগতাড়িত হয়ে, দায়িত্বশীলতা হারিয়ে যা তা বলা যায়, কিন্তু সেই বলাটা যৌক্তিক নয়, সঠিক নয়। সব জাতিতে, সব সমাজে ভালো মানুষও আছে, খারাপ মানুষও আছে, চাঁদাবাজিও আছে, সন্ত্রাসও আছে। কিন্তু আদিবাসী বললে সবাইকে সন্ত্রাসী বলতে হবে এটা কিন্তু সঠিক নয়, এটা বলা উচিত নয়, এটা বরঞ্চ উস্কে দিয়ে অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা। অশান্তিতে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা শান্তিপূর্ণ জনতা। শান্তিপূর্ণ আদিবাসী। শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চাই।’
ঊষাতন তালুকদার আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে সরকার আদিবাসী নাই কেন বলে? আছে কেন বলে না? আমাদের আজকে আদিবাসী হলে কী লাভ আর কাদের কী ক্ষতি হবে? আদিবাসী আইন অনুযায়ী আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি কেড়ে নেয়া যাবে না। এখন তো ক্ষমতা বলে, বাহু বলে, অর্থ বলে আদিবাসীদের ভূমি কেড়ে নেয়া হচ্ছে। বাঘাইছড়িতে যে রাস্তা হয়েছে, তাতে তো ক্ষতিপূরণও দেয়া হয়নাই, অধিগ্রহণও করা হয়নাই। কিন্তু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শক্তি আছে, জোর আছে, রাস্তা নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে আর এভাবে আদিবাসীদের ভূমি বেদখল করা যাবে না, জোর করে দখল করা যাবে না এবং তাদের উচ্ছেদ করা যাবে না। তাদের সাথে আগেভাগে আলোচনা করতে হবে, তাদের মতামত থাকতে হবে, তাদের সদিচ্ছা থাকতে হবে। এজন্য আদিবাসী স্বীকৃতি মেনে নিলে তাদের ক্ষতি। কী ক্ষতি? ক্ষতি হল জমি বেদখল করা যাবে না। তাদের উচ্ছেদ করা যাবে না। উচ্ছেদ করা না গেলে তো এদেরকে এখান থেকে বিতারণ করা যাবে না।’
তরুণদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আগামী দিনে, আগামী সংগ্রামে, আগামী জীবনে, আমাদের জীবন আমরা কিভাবে পেতে চাই, কিভাবে পাবো, সবকিছু নির্ভর করছে আপনাদের উপরে। তরুণ সমাজকে আজকে নতুন করে ভাবনার জন্য, আমরা আহ্বান জানাচ্ছি, জাতিসংঘ আহ্বান জানিয়েছে, আপনাদেরকে জ্ঞানে-গরিমায় অধিকতরভাবে এগিয়ে আসতে হবে।’
সরকারকে উদ্দেশ্য করে ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের কাছে, বাংলাদেশের যারা পরিকল্পনাকারী, যারা পলিসি লেবেলে আছেন, যারা চিন্তাভাবনা করতে পারেন, তাদের কাছে আহ্বান জানাই- আপনারা আরও উদার মনে, পরিচ্ছন্ন মনে, সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসলে পার্বত্য সমস্যা কোনো সমস্যা নয়। এটা দ্রুত সমাধান করে নেওয়া যাবে। এই সমস্যাকে ঝুলিয়ে রাখা হয় বলে ঝুলে থাকে।’
পরিশেষে, তিনি সরকারি দল, বিরোধী দল ও সবাইকে দেশের মঙ্গলের জন্য, দেশের ভালোর জন্য আদিবাসী বিষয়টা এবং পার্বত্য চুক্তির বিষয়টা আগামী নির্বাচনের মেনিফেস্টোতে সমর্থন দেওয়ার আহ্বান জানান।
বিশেষ অতিথি অ্যাডভোকেট চঞ্চু চাকমা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী প্রেক্ষিত এমনিতে হয়নি। এটা আজকে প্রায় একশ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। সেই ১৯২৩ সাল থেকে এর সূত্রপাত ঘটেছিল। সর্বশেষ আমরা ২০০৭ সালে পেয়েছিলাম জাতিসংঘের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র। এখানে ৪৬টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। সর্বমোট ১২টি অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। এইসব অধিকারের মধ্যে সর্বপ্রথম যে অধিকারটি রয়েছে সেটা হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার। আজকে বাংলাদেশে আমাদের আদিবাসীদের সেই অধিকার কি রয়েছে? বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলো রয়েছি, তাদের অধিকার? একসময় আমরা স্বশাসিত ছিলাম। একটা পর্যায়ে আমাদের অধিকার ছলেবলে কৌশলে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সেই হারানো অধিকার আমরা কি পেতে পারি না?’
তিনি আরও বলেন, ‘সেই এম এন লারমার সময় থেকে আমরা তো চেয়েছিলাম বাংলাদেশে থেকেই আমাদের অধিকার পুনরুদ্ধার করতে। এদেশের আকাশ-বাতাসের মধ্যে এখানেই তো আমরা জন্মেছি। সুতরাং এই মাতৃভূমিতে আমাদের বসবাস করার অধিকার রয়েছে। সেই এম এন লারমার সময় থেকেই তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে বাঁচতে চেয়েছি।’
সরকার ও শাসকগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে অ্যাডভোকেট চঞ্চু চাকমা বলেন, ‘আপনারা আজকে শুধু আদিবাসীদের নয়, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ যারা রয়েছেন, বাঙালি রয়েছেন তাদের অধিকার পর্যন্ত স্পষ্টভাবে স্বীকৃত নয়। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে শোষণ করতে করতে আপনারা আজকে বাংলাদেশকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আপনারা যদি এসব উপলব্ধি না করেন, তাহলে আগামী প্রজন্ম আপনাদেরকে একদিন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত করবে।’
বিশেষ অতিথি বিজয় কেতন চাকমা বলেন, ‘আজ শুধু আপনাদের কছে একটা প্রশ্ন, সেই প্রশ্নটা হচ্ছে, আপনারা কি আদিবাসী না বাঙালি? আমরা আদিবাসী। আমাদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও এ দাবি উঠেছে। আজ আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান স্বাধীন, সার্বভৌম দেশে অনেক বুদ্ধিজীবী, অনেক রাজনীতিবিদ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা আশ্চর্য হবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের আদিবাসীদেরকে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ হতে কম করে হলেও ৫টি বছর আমাদের বার্ষিক স্মরণিকায় সুন্দর সুন্দর বাণী দিয়ে, আমাদের সব দাবি মেনে নিয়ে, আমাদের সবকিছু তিনি বাস্তবায়ন করবেন, এই রকম অঙ্গীকার দিয়েছেন। আপনারা কি আশ্চর্য হবেন তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী দিপু মনি আমাদের র্যালিতে ঝান্ডা উড়িয়েছেন। আর আজ কী হচ্ছে? আজকে ১৫টি বছর সেই আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, কিন্তু এখন তারা অস্বীকার করেন বাংলাদেশে আদিবাসী আছে। আসলে সরকারের মধ্যে আরো এক সরকার আছে, যাদের পদতলে, যাদের বুটের নীচে আমাদের দুর্বিষহ জীবন যাপন।’
উল্লেখ্য, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠীর উদ্যোগে আদিবাসী বিভিন্ন শিল্পীদের অংশগ্রহণে একটি সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীও উপস্থাপন করা হয়। উদ্বোধনী সভা শেষে দুপুর ১২:০০ টার দিকে পৌরসভা প্রাঙ্গণ থেকে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি শুরু করা হয় এবং তা রাজবাড়ির জেলা শিল্পকলা একাডেমিকে এসে সমাপ্ত হয়।