পুনর্বাসন ছাড়া বসতি উচ্ছেদ মানবাধিকার পরিপন্থী: ঐক্য পরিষদ ও পূজা পরিষদ

হিল ভয়েস, ২৮ এপ্রিল ২০২৩, ঢাকা: সম্প্রতি পদ্মাসেতু রেলওয়ে প্রকল্পের আওতায় ঢাকার গোপীবাগ টিটিপাড়া রেলওয়ে হরিজন ও তেলেগু সুইপার কলোনীর শতাধিক পরিবারকে পুনর্বাসন ছাড়াই উচ্ছেদের উদ্যোগকে মানবাধিকার পরিপন্থী বলে আখ্যায়িত করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ এবং মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির নেতৃবৃন্দ।

আজ ২৮ এপ্রিল শুক্রবার সকালে গোপীবাগ টিটিপাড়া রেলওয়ে হরিজন ও তেলেগু সুইপার কলোনীর উচ্ছেদ পরিস্থিতি পরিদর্শনে যান বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ এবং মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির নেতৃবৃন্দ। এ সময় কলোনীর দুর্গামন্দির চত্বরে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, পদ্মা সেতু রেলওয়ে প্রকল্পের আওতায় কমলাপুর থেকে যশোর অব্দি পুরো পথের সবখানেই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ কিংবা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেবলমাত্র এই কলোনীর বাসিন্দাদের কোনো ধরনের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি। চার বছর আগে উচ্ছেদকৃত ১১২ পরিবারের তালিকা করা হলেও এই দীর্ঘ সময়ে তাদের পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ না নেওয়া দুঃখজনক। পুনর্বাসন ছাড়া মানুষের বসতি উচ্ছেদ মানবাধিকারের সুস্পষ্ট পরিপন্থী।

আজ ঐক্য পরিষদের দপ্তর সম্পাদক মিহির রঞ্জন হাওলাদার স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেতৃবৃন্দ বলেন, নগরী পরিচ্ছন্ন রাখতে যে মানুষেরা কাজ করেন, তাদেরকে ব্রাত্য করে রেখে কোনো উন্নয়নই সুফল আনতে পারবে না। বর্তমান সরকার দেশে ভূমিহীনদের সংখ্যা শূন্যতে নামিয়ে আনতে আশ্রায়ণ ও গৃহায়ণ প্রকল্পসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, এমনকি মায়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ মানবতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু দুইশ বছর ধরে এই দেশে বসবাস করে আসা হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষদের সাথে এই অমানবিক আচরণ অপ্রত্যাশিত। তারা এই দেশের ভোটার, এই দেশের নাগরিক, তাদের উপেক্ষা করে উন্নয়ন কর্মকা- প্রত্যাশিত নয়।

সমাবেশে নেতৃবৃন্দ কমলাপুর স্টেডিয়ামের পার্শ্ববর্তী মানিকনগর কালভার্ট এরিয়ার মাঠে উচ্ছেদকৃত হরিজন ও তেলেগু সুইপার পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের জন্য সুপারিশ করেন।

মহানগর পূজা কমিটির সভাপতি মনীন্দ্র কুমার নাথের সভাপতিত্বে এ প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. শ্যামল কুমার রায়, সাংগঠনিক সম্পাদক পদ্মাবতী দেবী, সমবায় বিষয়ক সম্পাদক তপন চক্রবর্ত্তী, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক বাপ্পাদিত্য বসু, লক্ষ্মীকান্ত রায়, সহ আন্তর্জাতিক সম্পাদক অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য, যুব ঐক্য পরিষদের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি অমিতাভ বসাক বাপ্পী, ঐক্য পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির নেতা দিলীপ কুমার কর দীপু, গণেশ ঘোষ, গুরুদাস রায়, জহরলাল দেবনাথ, গোপাল রাজবংশী, একলব্য সরকার পলাশ, উৎপল ম-ল, অরূপ কুমার কু-ু, হিন্দু লীগের মহাসচিব শংকর সরকার, সনাতন সংগঠনের প্রতিনিধি দেবাঙ্গনা চৌধুরী নদী প্রমুখ। কলোনীর বাসিন্দাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন রাজেন লাল, পারদ লাল, রাজীব দাস প্রমুখ।

প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, “রাজধানীর গোপীবাগ টিটিপাড়া রেলওয়ে হরিজন ও তেলেগু সুইপার কলোনীর শতাধিক পরিবারকে কোনো ধরনের পুনর্বাসন ছাড়াই অমানবিকভাবে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে গত চার বছরের মধ্যে প্রথম দফায় ১১২ পরিবার এবং পরে আরো ২৭ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আরো ৪০ পরিবারকে শিগগিরই উচ্ছেদ করা হবে বলে মৌখিক নোটিশে জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

প্রায় দুইশ বছর আগে ১৮৩৫ সালে ভারতের মাদ্রাজ, তেলেগুসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসব পরিচ্ছন্নতাকর্মিদের জাত মেথর হিসেবে বাংলাদেশে আনা হয়। সেই থেকে তারা বংশ পরম্পরায় রাজধানী ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলায় পরিচ্ছন্নতাকর্মির কাজ করে আসছে। রেলওয়ের অধীনে কর্মরত হরিজন সম্প্রদায়ের বাস ছিলো ফুলবাড়িয়া পুরাতন রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকায়। ৪২ বছর আগে সেখান থেকে তাদেরকে টিটিপাড়া রেলওয়ে হরিজন কলোনীতে স্থানান্তর করা হয়। এখানেও তাদের বসবাস কার্যত মানবেতর।

সম্প্রতি পদ্মাসেতু রেলওয়ে প্রকল্পের আওতায় কমলাপুর থেকে যশোর পর্যন্ত রেললাইন এবং তৎসংশ্লিষ্ট আন্ডারপাস, ওভারপাস, ডিপো ইত্যাদি নির্মাণকাজের জন্য টিটিপাড়া রেলওয়ে হরিজন ও তেলেগু সুইপার কলোনীর বাসিন্দাদের দফায় দফায় উচ্ছেদ করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে প্রথম দফায় ১১২টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। সে সময় ওই পরিবারগুলোর তালিকা তৈরি করে তাদের পুনর্বাসনের আশ্বাস দেয় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আজ অব্দি তাদেরকে কোনো ধরনের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ওই সময় সেখানে অবস্থিত পুরাতন শীতলা মন্দিরটিও ভেঙ্গে ফেলা হয়। পরবর্তীতে আরো ২৭টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদের সময় বাধা দিতে গেলে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে তাদেরকে লাঠিপেটাও করা হয়। উচ্ছেদকৃত এই ১৩৯টি পরিবারের মানুষেরা বর্তমানে বাকি অন্যান্য পরিবারের ঘরগুলোতে গাদাগাদি করে থাকছে। ছোট্ট একেকটা ঘরে দুই থেকে তিন পরিবারের লোকজন নিতান্তই মানবেতর জীবনযাপন করছে। অতি সম্প্রতি আরো ৪০টি পরিবারকে যে কোনো সময় উচ্ছেদ করা হবে বলে মৌখিকভাবে প্রকল্প কর্মকর্তারা তাদের জানিয়েছেন।”

More From Author