পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলিম বসতির ইতিবৃত্ত এবং নগ্ন সম্প্রসারণবাদ

                                                           সত্যবীর দেওয়ান                                                                
     মানব সমাজের সভ্যতার ক্রমবিকাশের এক পর্যায়ে মানুষ জীবন জীবিকার তাগিদে অথবা আরও উন্নত জীবন জীবিকার জন্য পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, এক অঞ্চল হতে অন্য অঞ্চলে, এক দেশ হতে অন্য দেশে, এমনকি এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে অভিবাসিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। শুধু অভিবাসন নয়, মধ্য যুগে রাজা-বাদশারা দ্বিগ-বিজয় অভিযানের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজ্য জয় করেও অনেকে বীর, মহাবীর, এমনকি নিজেকে সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পররাজ্য জয় করেছেন, গ্রাস করেছেন উপনিবেশ স্থাপন করে পরাজিত জাতি ও জনগণকে শোষণ শাসন করেছেন। বিশেষ করে মধ্যযুগে এসব দ্বিগবিজয় অভিযান যেমনি হয়েছে তেমনি অভিবাসনও হয়েছে। বিশেষ করে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের পূর্বে এসব হয়েছে।

অভিবাসন এক জিনিষ, পর রাজ্য জয় করে উপনিবেশ স্থাপন আর এক জিনিষ। আবার আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার যুগে একই স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র জাতি সত্তা ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর পশ্চাৎপদতার সুগোগে বৃহৎ জাতি গোষ্ঠী কর্তৃক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অপব্যবহার করে নানা প্রকার ভিত্তিহীন অজুহাত দেখিয়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে শত বছরের বসতি থেকে উচ্ছেদ করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জনগণের মাধ্যমে জায়গাজমি বেদখল করার মত জঘন্য কার্যক্রম আজ একবিংশ শতাব্দিতেও চলে আসছে। যা বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এদেশের শাসকগোষ্ঠী উপনিবেশিক কায়দায় চালিয়ে যাচ্ছে। অতীতে বৃটিশ উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী তৎকালীন পাক ভারত উপমহাদেশের জনগণকে “ভাগ কর শাসন কর” এই নীতি পদ্ধতির মাধ্যমে দীর্ঘ দু’শো বছর শাসন করেছিল; ঠিক একই পদ্ধতিতে এখন এদেশের শাসকগোষ্ঠী কেবল মাত্র জাতিগত সংখ্যাগরিষ্টতার জোড়ে রাষ্ট্রীয় প্রজা পালনের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে, মানবিকতার বিচার নীতি বিসর্জন দিয়ে একই দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও জুম্ম জনগণকে নিজস্ব শতবছরের বাস্তুভিটা হতে উচ্ছেদ করে সেটেলার বাঙালি পুনর্বাসন করে আসছে। অথচ বহিবিশ্বে সরকার প্রচার করে আসছে এদেশের সকল জাতিগোষ্ঠী সমান অধিকারও মর্যাদা নিয়ে স্বাধীনভাবে বসবাস করে আসছে। সরকার বাস্তব কার্যক্রমে এক আর প্রচার করছে অন্যরূপ। শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখার প্রক্রিয়া আর কতদিন? অতি সম্প্রতি এদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জনাব শাহরিয়ার আলম জেনেভায় জাতিসংঘ কমিটিতে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনায় বিভিন্ন অস্বস্তিকর প্রশ্নের সম্মখীন হলে শেষ পর্যন্ত বলে আসলেন, “বাংলাদেশের সকল নাগরিকই আদিবাসী” (সূত্র: প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০১৮)। যথার্থ শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কৌশলই অবলম্বন করলেন; কি, অভিনব অভিনয়!

লেখার প্রসঙ্গ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাঙালি বসতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে। প্রকৃত পক্ষে ১৮১২ খ্রি: এর পূর্বে তৎকালীন “কার্পাস মহল” নামক চাকমা রাজ্যে কোন প্রকার বাঙালির বসতি ছিলো না। তৎসময়ে পার্বত্য এলাকার জুম্ম জনগণের প্রধান উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল জুম চাষ। কারণ জুম চাষে শুধু ধান নয়, কার্পাসসহ নানা প্রকার সবজি, মরিচ, মশলা ফলমূলের চাষ একই সাথে হতো। জুম্ম তখন একটা বাজারের মত। তৎসময়ে জুম্ম জনগণের সমতল ভূমিতে চাষাবাদের অভিজ্ঞতা ছিলো না। সে কারণে তৎকালীন চাকমা রাজা ধর্মবক্স খাঁ চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়া হতে ১২ পরিবার বাঙালি মুসলমান বসতির অনুমোদন করেন ১৮১২ খ্রি। উদ্দেশ্য রাজার রাঙ্গামাটির নিকটবর্র্তী ধর্মখীল নামক বিস্তীর্ণ সমভূমির আবাদ করেছিলেন। একদিকে নিজের বিশাল সমতল ভূমির চাষাবাদ হবে, পাশাপাশি জুম্মদের সমতল ভূমিতে কিভাবে ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন করা যায় তারও প্রশিক্ষণ হয়ে যাবে। ঐ ১২(বার) পরিবার বাঙালি যদি প্রতি পরিবারে ৬ জন ধরা হলে ১২×৬= ৭২ জনের মত হতে পারে। এরাই সর্বপ্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি প্রাপ্ত বাঙালি মুসলমান। ইহার পর ১৮৭১ সালে রাণী কালিন্দির রাজত্বকালে যে প্রথম আদমশুমারী হয় তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মোট লোকসংখ্যা ছিল ৬৯৬০৭ জন। তন্মধ্যে বাঙালি সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৭১ জন। এরাই ছিল প্রকৃত পক্ষে পুরাতন বসতি বাঙালি মুসলমান। পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম আদম শুমারী হয় উপরোক্ত সালে। এরপর ১৮৮১ এবং ১৮৯১ আদমশুমারীর বিস্তারিত রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। তবে ব্রিটিশ শাসনামলের ১৯০১ সালে রাজাভূবন মোহন রায় এর সময় হতে বর্তমান অবধি ধারাবাহিক আদমশুমারীর প্রাপ্ত তালিকা এখানে উপস্থাপন করা গেল-

This image has an empty alt attribute; its file name is Hill-Voice-1.jpg

এখানে স্পষ্ট যে ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে তৎকালীন “কার্পাস মহল” নামক চাকমা রাজ্যে কোন প্রকার মুসলমান বাঙালির অস্তিত্ব ছিলো না। এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত, সত্য। সেই হিসেবে অধুনা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলমান বাঙালি বসতি সূচনা হয় আজ হতে ২০৬ বৎসর পূর্বে। এটাই  হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাঙালি মুসলমান বসতির ইতিহাস। এ ব্যাপারে বৃট্রিশ নাগরিক এবং বৃট্রিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একজন কর্মকর্তা ফান্সিসবুকানন ২৬ এপ্রিল ১৭৯৮ খ্রি: হইতে ৩ মে ১৭৯৮ তারিখ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন এলাকা ভ্রমণ করেন। তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, নোপতং এর উজানে স্বাধীন জাতি বনযোগীরা বসবাস করে। এতে প্রমাণিত হয় তখনকার সময় শঙ্খ নদীর অববাহিকায় উজানে পাহাড়ি জাতির লোক ছাড়া বাঙালিদের কোন বসতি ছিলনা।

সে সময়ে মাতামূহুরী নদীর উভয় তীরে মুরং, টিপেরা ইত্যাদি পাহাড়ি জাতির লোক বাস করে। বুকানন ২৮ এপ্রিল ১৭৯৮ খ্রি: হতে পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরের উদ্দেশ্যে চিৎমরম, সীতাপাহাড়, কাপ্তাই, রাইংখ্যং, ধুল্যাছড়ি, বুকুরিয়াবিল, মানিকছড়িমুখ, মগবান, চেঙ্গী নদীর মোহনা, কাইন্দ্যা চিলাকধাক সুবলং ও কাচালং নদীর মোহনা হয়ে ১ মে ১৭৯৮ খ্রি: তারিখ নাগাদ তিনি বরকল পৌঁছান। সেখানে থেকে বরকল উজানে কর্ণফুলী নদীতে উথানচাদারা, হরিন দুবার এবং হাতিরমুখ নামে তিনটি জলপ্রপাত আছে। হাতিমুখ এর মইনমুরা এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে তাইবিয়াক নাম এক সর্দারের অধীনে কুকি এবং বনযোগীরা বাস করে। বুকানন হিসাব করে বলেন যে, চিৎমরম সীতা ঘাট থেকে নদীপথে বরকলের দুরত্ব ৮০ মাইল, তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে জানা যায়। তিনি তার ভ্রমণ কাহিনীতে যে সব স্থানের নাম উল্লেখ করেছেন সে সব স্থানে চাকমাদের বসবাস দেখেছেন। তার বিরবণে কোথাও বাঙালি বসতির অস্তিত্ব দেখেননি। দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার পাহাড়গুলোতেও মার্মা, মুরুং, কুকি এবং আরাকানীদের বসতি দেখেছেন, যা তিনি তার ভ্রমন বিবরনীতে বিশদ আলোচনা করেছেন।(সূত্র: স্মারক সংকলন) বস্তুত: পার্বত্য অঞ্চল সম্পর্কে উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা (১৯৮৪ ইং প্রকাশিত) ২ পৃষ্ঠায় বর্ণিত একটি অংশ এখানে হুবহু তলে ধরা হলো। “অতীতে এ অঞ্চল অনুপজাতীয়দের কাছে অজ্ঞতা ছিল। এখানকার গভীর অরণ্য হিংস্র প্রাণীকুলের এবং দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল জন চলাচলে যে তীব্র প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। যার ফলে অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত এ অঞ্চল সম্পর্কে ইংরেজরা কেন, আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী বাঙালিরাও কিছুই জানতো না। এমনকি আজও পর্যন্ত এ অঞ্চলের ইতিহাস সবার কাছে অনুৎঘাটিত রয়ে গেছে।” (সূত্র: উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা, ১৯৮৪)

বস্তুত: এই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল জুম্ম জনগণের বসতির পূর্বে সম্পূর্ণ ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ জনমানব শূন্য শাপদসংকুল হিংস্র জন্তুদের বসবাস ছিল। এটা অতীব বাস্তব সত্য যে, জুম্ম জনগণই এই অঞ্চল সর্বপ্রথম আবাদ করেছিল। হিংস্র জীব জন্তুদের সাথে লড়াই সংগ্রাম কওে জুম্ম জনগণই আবাদ করে মানুষের বসবাসযোগ্য করেছিল। আর তার অকাট্য প্রমাণ আজ থেকে ১৫১৮ বছর আগে চট্টগ্রাম ও তার নিকটবর্তী এলাকার জুম্ম জনগণ তথা চাকমা রাজাদের রাজত্বের কথা ড. আব্দুল কাদের তার লিখিত গ্রন্থ “চট্টগ্রামের ইতিহাস” নামক গ্রন্থের ৫ ও ৬ পৃষ্ঠায় যা উল্লেখ করেছেন তাহা প্রণিধানযোগ্য- “খ্রিষ্টীয় ৪র্থ ও ৫ম শতকের গোড়ার দিকে চাকমা রাজারা স্বাধীনভাবে অবস্থান করতো। চট্টগ্রামের পূর্বের পার্বত্য অঞ্চলের অবস্থান ও স্থিতিকাল নিশ্চিত জানা না গেলেও ত্রিপুরা ও চট্টগ্রামের মাঝামাঝি অঞ্চলে ছোট ছোটদেশ যেমন চম্পকনগর, কালাবাঘা, কাঞ্চননগর ও অক্সাদেশ প্রকৃতির খবর পাওয়া যায়। হাট হাজারীর উত্তরে নিকটস্থ পাহাড়ি অঞ্চলে কাঞ্চননগর বলে এক অঞ্চল ছিল। শোনা যায় উদয়গিরি নামক এক রাজা চম্পক নগরে রাজত্ব করছিলেন। তার দুই পুত্র বিজয়গিরি ও সমরগিরি। বড়ভাই বিজয়গিরি এক মগরাজার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন এবং শেষমেশ বর্মার পার্বত্য অঞ্চলে নিখোঁজ হয়ে যান। পিতার মৃত্যুর পরে সমরগিরি সিংহাসনে বসেন। (সূত্র: চট্টগ্রামের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-৫, ৬, ড. আব্দুল কাদের)

উপরে উল্লিখিত আদমশুমারী রিপোর্টের তালিকা পর্যালোচনা করলে এটা অত্যন্ত পরিস্কার যে ১৮৭১ হতে ১৯৪১ পর্যন্ত মুসলিম বাঙালি বৃদ্ধিও সংখ্যাটি স্বাভাবিক অভিবাসন। কিন্তু তৎপরবর্তী বিশেষ করে পাকিস্তান শাসন আমলে সরকারি উদ্যোগে মুসলিম বাঙালি পুনর্বাসন শুরু হয় ১৯৫০ সালে। আসাম থেকে আসা একহাজার বাঙালি পরিবার তৎকালীন রাঙ্গামাটি থানার অন্তর্গত নানিয়ারচর, লংগদু থানায় লংগদু এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থানার অন্তর্গত এলাকায় পুনর্বাসন করা হয়। তাতে পরিবারে ৬ সদস্য ধরা হলে ১০০০×৬= ৬০০০ বাঙালি পুনর্বাসন করা হয় তৎকালীন ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিকে লঙ্ঘন করে।

এরপর ১৯৬৩ সালে রামগড় মহকুমাধীন তবলছড়ি, বেলছড়ি, মানিকছড়ি ও রামগড় ইউনিয়নে দুই হাজার মুসলমান বাঙালি পুনর্বাসন করা হয়। তাতেও পরিবার পিছু ৬ জন ধরা হলে ২০০০×৬= ১২০০০ বাঙালি পুনর্বাসন করা হয়। ঐ একই বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ অঞ্চল বান্দরবান মহকুমার কয়েকশত বাঙালি পুনর্বাসন করা হয। তাতে ৩০০ পরিবার ধরা হলে প্রতি পরিবারে একইভাবে ছয়জন ধরা হলে ১৮০০ জন পুনর্বাসন করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০ সালকে উপেক্ষা করে। এব্যাপারে তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ তীব্রভাবে প্রতিবাদ করেন। তাতে পরবর্তীতে পুনর্বাসন বন্ধ করা হয়। কিন্তু পূর্বে পুনর্বাসিতদের প্রত্যাহার করা হয়নি। এইভাবে পুনর্বাসিত এলাকাসমূহে নিয়মিত স্বাভাবিক অভিবাসন চলতে থাকে লোক চক্ষুর অন্তরালে। এখান থেকে শুরু হয় অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলকে মুসলমান অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলে পরিণত করার ষড়যন্ত্র। এভাবে পাকিস্তান আমলে ৬৬,০০০ হাজার বাঙালি মুসলমান পুনর্বাসন করা হয়। তৎকালীণ বৃটিশ প্রদত্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিকে লঙ্ঘন করে। (সূত্র: ১০ নভেম্বর ’৮৩ স্মরণে ১৯৮৫)

পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলিম বাঙালি পুনর্বাসন করেই ক্ষান্ত হয়নি। উপরন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের নামে পাহাড়ি তথা জুম্মদের তাড়ানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে ষাটদশকে ১২৫টি মৌজায় ১৭,৩৮৬ পরিবারের প্রায় লক্ষাধিক জুম্মকে নিজ ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করে এবং ১,৬৪,৮৪০ একর জমি তন্মধ্যে ৫৪ হাজার একর ১ম শ্রেণির ধান্য জমি জলমগ্ন করে দেয়। জুম্ম জনগণের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে পঙ্গু করে দেয়। বাঁধের জলে ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসনের জন্য ৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্ধ করা হয়। কিন্তু জুম্ম জনগণের পশ্চাৎপদতার সুযোগে মাত্র ২.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তৎকালীন সরকারি কর্মকর্তারা বিতরণ করে বাকী ৪৮.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আত্মসাৎ করেন। (সূত্র: পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ইতিকথা ও স্বায়ত্ত্বশাসনের আন্দোলন- ২৯ পৃষ্ঠা, শরবিন্দু শেখর চাকমা, সাবেক সচিব)

পুনর্বাসন করার ক্ষেত্রে তৎকালীন সরকারি কর্মকর্তাদের বিমাতা সুলভ আচরণের কারণে ১৭,৩৮৬ পরিবার উদ্বাস্তু হতে মাত্র ১১,৭৬১ পরিবারকে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয় কাচালং সংরক্ষিত বনাঞ্চল খুলে দিয়ে। ৪,৬২৫ পরিবারকে প্রয়োজনীয় জমির অভাবে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয় নাই। ফলে হাজার হাজার জুম্ম নরনারী ভারতে ও বার্মায় চলে যায়। যারা আজ পার্বত্য জুম্ম জনগণকে থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এভাবে একদিকে জুম্ম জনগণকে নিজ জন্ম ভূমি তথা মাতৃভূমি হতে একেবারে তাড়ানোর বিমাতা সূলভ তথা বৈষম্যমূলক আচরণ পাকিস্তান সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিরা করতে থাকে। অন্যদিকে, অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলকে মুসলমান অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলে পরিণত করার ক্ষেত্রে পার্বত্য অঞ্চলের মুসলমান বাঙালি পুনর্বাসন চলতে থাকে। এভাবে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত ৬৬০০০ বাঙালি মুসলমান পুনর্বাসন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গী: ১৯৭১ ইংরেজী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু হলে তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক জনাব এইচটি ইমাম সাহেবের(বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা) উদ্যোগে রাঙ্গামাটির মিশন বোডিং এর নিকটবর্তী অফিসার্স ক্লাবের টেনিস মাঠে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য সেই সময়ের রাঙ্গামাটি কলেজের ছাত্রসহ রাঙ্গামাটির যুব সম্প্রদায়কে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেই সময়ে আমরা রাঙ্গামাটি কলেজের প্রায় সকল ছাত্র যুবকরা ঐ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। পুলিশ লাইন থেকে জনৈক সুবেদার কর্তৃক ঐ অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তখন সকল পাহাড়ি বাঙালি ছাত্র যুবকদের এক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ দেয়ার পর প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে প্রস্তুত ছাত্র-যুবকদের বিশেষ করে জুম্মদের যোগদান থেকে কৌশলে বঞ্চিত করা হয়। বিশেষ করে সেই সময়ের আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমানের চক্রান্তে এইরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় বলে আমরা জানতে পারি। শেষ পর্যন্ত প্রায় অন্যান্য ছাত্র ও যুবকদের মত আমিও গ্রামের বাড়িতে গিয়ে নিজের জায়গা জমিতে চাষাবাদের কাজে নিয়োজিত হই।

বাংলাদেশ শাসনামল: ১৯৭১ ইংরেজীর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে পুনরায় রাঙ্গামাটিতে নিজস্ব বাসায় মাঝেরবস্তীতে ফিরে আসি। বাংলাদেশ স্বাধীনতার প্রথম আদমশুমারী হয় আওয়ামীলীগ শাসন আমলে ১৯৭৪ সালে তাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যা ৫,০৮,০০০ জন। তন্মধ্যে ১,১৬,০০০ জন মুসলমান বাঙালি সংখ্যা পাওয়া যায়। এই সংখ্যাটিতেই স্পষ্ট যে কত দ্রুত মুসলমান অভিবাসন বৃদ্ধি করা হয়েছে। যা আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আওয়ামীলীগের পতন ঘটে। দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর যখন জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ ইং অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে গোপন যুদ্ধ করেন। সমগ্র পার্বত্য এলাকা সামরিকায়ন করেন। প্রায় পাঁচ শতাধীক সেনাক্যাম্প স্থাপন করেন। আর ১৯৭৯ সালে সুপরিকল্পিতভাবে জুম্ম জনগণকে দ্রুত সংখ্যালঘুতে পরিণত করার জন্য এবং জুম্মদের উচ্ছেদ করে ৩০ হাজার পরিবার সেটেলার মুসলমান বাঙালি পুনর্বাসন শুরু করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জেলায় ও উপজেলায়। তাতে প্রতি পরিবার ৬ জন সদস্য ধরা হলে কমপক্ষে ১,৮০,০০০( এক লক্ষ আশি হাজার) সেটেলার পুনর্বাসন করা হয়। শুরু হয় সরকারি তথা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। প্রথমে ২৫ মার্চ ১৯৮০ সালে কাউখালী কলমপতি গণহত্যা প্রকাশ্য দিবালোকে সেনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিহার উন্নয়নের নামে জনসভা ডেকে জুম্মদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো অবস্থায় ব্রাশ ফাইয়ার করে ৩০০ জুম্মকে হত্যা করা হয়, একই সময়ে অসংখ্য জুম্ম আহত হন। এই কলমপতি গণহত্যার মাধ্যমে জুম্মদের নিজ ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে ব্যাপক সেটেলার পুনর্বাসন করা হয় ঐ কাউখালী এলাকায়। এই কলমপতি গণহত্যাসহ পর পর যতগুলো গণহত্যা পার্বত্য চট্টগ্রামে করা হয়েছে। তার প্রত্যেকটির উদ্দেশ্য হচ্ছে জুম্মদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও দাঙ্গার মাধ্যমে নিজ বসতি হতে তাড়িয়ে সেটেলার মুসলমান বাঙালি পুনর্বাসন।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানই জুম্ম জনগণকে শত সহস্র বছরের বসতি হতে উৎখাত করে মুসলমান সেটেলার বাঙালি পুনর্বাসনের মাধ্যমে তার উগ্র-ইসলামী সম্প্রসারণবাদের নগ্নরূপের বহি:প্রকাশ ঘটান। মুখে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ কার্যক্ষেত্রে ইসলামিক বাঙালি সম্প্রসারণবাদ। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পর প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্ষমতায় আসলে একই পদ্ধতিতে সামরিক সন্ত্রাসের মাধ্যমে জুম্মদের উৎখাত করে সেটেলার বাঙালি মুসলমান পুনর্বাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। এরশাদ শাসনামলে ৬টি গণহত্যার মাধ্যমে জুম্মদের উৎখাত করে ২,৪১,২০০ জন মুসলিম সেটেলার পুনর্বাসন করা হয়। আর খালেদা জিয়ার শাসনামলে( ২০/৩/১৯৯১- ৩০/৩/১৯৯৬) ৫টি গণহত্যার মাধ্যমে অগণিত সেটেলার পুনর্বাসন করা হয়। এখানে এটা অত্যন্ত দিবালোকের মত স্পষ্ট যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে নিজ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে নানা প্রকার লোভনীয় উন্নয়নের নামে সেটেলার পুনর্বাসনের তথা অমুসলমান অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলমান অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিণত করার ক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকার হতে বর্তমান বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর সকল দলীয় সরকার সমূহের(আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয়পার্টি) মধ্যে নীতিগত কোন তফাত নেই।

বর্তমান পার্বত্য চুক্তির পরেও সেটেলার পুনর্বাসিত এলাকা সমূহে লোকচক্ষুর আন্তরালে প্রতিনিয়ত অভিবাসিত হচ্ছে। যে কারণে ১৯৫১ই হতে ২০১১ ইং পর্যন্ত আদমশুমারী হিসাব অনুসারে মুসলমান বাঙালি জনসংখ্যার বৃদ্ধি ম্যারাটন গতিতে চলছে। আর পার্বত্য চুক্তি যদি পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন করা না যায়, তবে এই সেটেলার মুসলমান বাঙালির প্লাবন কোনক্রমেই রোধ করা যাবে না। এটাই বর্তমান বাস্তবতা। বর্তমানে শাসকগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দ জানে যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণসহ বাংলাদেশের অন্যান্য সংখ্যালঘু স্বতন্ত্র অবাঙালি জাতিসত্তা রয়েছে তাদের আদিবাসী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হলে আদিবাসীদের ভূ-সম্পত্তিকে ইচ্ছামত বেদখল করা যাবে না। আর তাই এখন নিজেদেরকেই আদিবাসী হিসাবে দাবি করছে। একদিকে বলছে এদেশে আদিবাসী নেই, অন্যদিকে বলছে এদেশের সকলেই আদিবাসী। শাসকগোষ্ঠীর বহুরূপী চরিত্র। একদিকে বলছে দেশের জাতীয়তা হচ্ছে বাঙালি আর নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশী।

মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা ধর্ম নিরপেক্ষতাকে বলি দিয়ে এখন করা হয়েছে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম। ইহাতে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। শাসকগোষ্ঠী নিজ দলীয় স্বার্থ রক্ষার্থে সংবিধানকে অনেক বার সংশোধন করেছে। কিন্তু পার্বত্য জুম্ম জনগণের জাতিগত অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আমরা সাংবিধানিকভাবে চেয়েছি। কিন্তু তা করা হয়নি। অথচ পার্বত্য এলাকার জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পার্বত্য চুক্তি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য। কারণ চুক্তিটা হচ্ছে একেবারে জুম্ম জনগণের জাতিগত অস্তিত্ব রক্ষার নূন্যতম সনদ। এতে কোন কিছু ছাড় দেয়ার নেই। অতএব এই চুক্তি পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন দলমত নির্বিশেষে সকল জুম্মদের অবশ্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া অতীব জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শাসকগোষ্ঠীর ইসলামী সম্প্রসারণবাদী ও উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী অংশটি মনে প্রাণে জুম্ম জাতিগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে মুসলমান অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিণত করতে চাই। তাই আজ যারা অর্থ-ভিত্তের লোভে, চাকরি ও বিভিন্ন ক্ষমতার লোভে লালায়িত হয়ে দালালী করতে বিভিন্ন জাতীয় দলে যোগদান করে শাসকগোষ্ঠীকে চুক্তি ভঙ্গের জন্য নিলর্জ্জভাবে সহাযোগিতা করছেন। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য তাদেরকেই দায়ী থাকতে হবে। কারণ তারা নিজস্ব একান্ত ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, ব্যক্তিগত অর্থ-সম্পত্তি অর্জনের জন্য শাসকগোষ্ঠীর সাথে দালালীর নিলর্জ্জ ভূমিকা পালন করতে পারেন। তারা কোনক্রমেই জুম্ম জনগণের মঙ্গল বয়ে আনতে পারেন না। তাদের সর্বক্ষেত্রে জুম্ম জনগণের বর্জন করা উচিত। অন্যথায় ঐতিহাসিকভাবে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে মুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলে পরিণত করার শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রকে রোধ করা যাবে না। সরকারি প্রতিক্রিয়াশীল সেটেলার মুসলমান বাঙালি পুনর্বাসনের প্লাবন হতে কেউ রক্ষা পাবে না। এটাই বর্তমান জুম্ম জনগণের নির্মম বাস্তবতা। সেই বাস্তবতা অনুযায়ী জুম্ম জনগণকে নিজেদের জাতিগত অস্তিত্ব রক্ষা করতে গেলে চুক্তি বাস্তবায়নের যে কোন কঠোর ও কঠিন বাস্তবমুখী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। অন্যথায় নিজেদের জাতিগত অস্তিত্ব বিলুপ্তির মুখোমুখি হতে হবে।


    

More From Author