*রুমেন চাকমা
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ভিন্ন ভাষাভাষী ১৪টি জুম্ম জাতির প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র প্রগতিশীল রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম পার্বত্য ছাত্র পরিষদ(পিসিপি)।
যুগে যুগে ছাত্র সমাজ দেশ, সমাজ ও জাতির ভবিষ্যৎ কান্ডারি। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পাহাড়ী ছাত্র সমাজ এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে চলেছে।
ষাটের দশকে পাহাড়ী ছাত্র সমিতি এবং আশির দশকের শেষান্তে ও নব্বই দশক জুড়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশেষত বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পাহাড়ী ছাত্র ও যুব সমাজ পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে ছাত্র-যুব সমাজের মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জুম্ম জনগণের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠিত হয়। এই দলের নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে উঠে যা এখনও দুর্বার গতিতে চলমান রয়েছে।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পথ পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদে বসা তৎকালীন সামরিক শাসকগোষ্ঠী পাহাড়ী ছাত্র সমিতিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে সংগঠনের অধিকাংশ দেশপ্রেমিক জুম্ম ছাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে যুক্ত হয়। জুম্ম জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলনকে দমন করতে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক সামরিকীকরণ করে এবং নানা নামে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। যেমন-অপারেশন ডিগ আউট (১৯৭৬-১৯৭৭), অপারেশন ট্রাইডেন্ট (১৯৭৭-১৯৭৯), অপারেশন পাঞ্চিং টাইগার (১৯৭৯-১৯৮৭), অপারেশন দাবানল (১৯৮৮-২০০১) এবং অপারেশন উত্তরণ (২০০১-বর্তমান)।
সেনাবাহিনীর ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়নে হাজার হাজার জুম্ম জনগণ ঘরবাড়ি ছেড়ে গভীর জঙ্গলে এবং পার্শ্বর্বর্তী ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে চার লক্ষাধিক বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের ভূমিতে পুনর্বাসন (সেটেলড) করে। এরপর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা জটিলতর হয়ে যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নিমূর্লীকরণের লক্ষ্যে সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালিরা একসাথে জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, গণহত্যা, ভূমি বেদখল, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে।
সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালি কতৃর্ক পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম গণহত্যা সংগঠিত হয় ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ; যেখানে জুম্মদের ৬০০-এর বেশি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ৩০০ জন এর বেশি জুম্মকে হত্যা করা হয়।
জুম্ম জনগণের উপর অব্যাহত গণহত্যা, ভূমি বেদখল, নারী নিপীড়ন, নির্বিচারে ধর-পাকড় ও অবর্ণনীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার এবং সশস্ত্র আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসেবে জুম্ম ছাত্র সমাজের দেশপ্রেমিক অংশের মধ্যেও সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা পরিলক্ষিত হতে থাকে। তবে তাদের সেই চেষ্টা-চরিত্র ও চিন্তা-ভাবনা ছিল একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক। ফলে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন গড়ে উঠে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপজাতীয় ছাত্র পরিষদ, ঢাকায় ট্রাইবেল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, রাজশাহীতে হিল ষ্টুডেন্ট ইউনিয়ন, কুমিল্লায় হিল ষ্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন ইত্যাদি সংগঠন গড়ে উঠে। ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস না থাকায় এবং অনেক ক্ষেত্রে অরাজনৈতিক চরিত্র প্রাধান্য থাকার কারণে এসব ছাত্র সংগঠনগুলো জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হতে থাকে। অপরপক্ষে আশি দশকের শেষ প্রান্তে স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে সারাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হতে থাকে।
১৯৮৯ সালের ৪ঠা মে রাঙ্গামাটি জেলার লংগদুতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাঙালি সেটেলার কর্তৃক জুম্মদের উপর এক ভয়াবহ গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় শিশু, নারী ও বৃদ্ধসহ ৩২জন জুম্ম নিহত, অন্তত ১১জন আহত এবং ৯টি গ্রামের মোট ১০১১টি ঘরবাড়ি, ৬টি বৌদ্ধ বিহার এবং ১টি প্রাথমিক ও ১টি উচ্চ বিদ্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া দেয়া হয় এবং লুটপাট চালানো হয়।
বর্বরোচিত এই গণহত্যার প্রতিবাদ এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে ৭ মে ১৯৮৯ তারিখে লংগদু উপজেলার জুম্ম জনগণ বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি বরাবরে একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। ৯ মে ১৯৮৯ তারিখে চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, রাষ্ট্রপতির সাবেক উপদেষ্টা সুবিমল দেওয়ান, সাবেক সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজা, সাবেক সংসদ সদস্য সুদীপ্তা দেওয়ানসহ ২২জন নেতৃস্থানীয় জুম্ম লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদে স্মারকলিপি পেশ করেন।
এ ঘটনা পাহাড়ী ছাত্র সমাজের মনে গভীর রেখাপাত করে। তারা ধীরে ধীরে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। সশস্ত্র যুদ্ধ চলাকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল প্রকার মিছিল মিটিং নিষিদ্ধ থাকায় পাহাড়ী ছাত্র সমাজ লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন জায়গায় কোন মিছিল-মিটিং করতে পারেনি। এর বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া পাহাড়ী ছাত্রছাত্রীরা রাজধানী ঢাকায় প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে তারা ঢাকার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হতে থাকে। লংগদু হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ ও সংবাদ সম্মেলনের জন্য ২০ মে বিকেলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) রশীদ হলের ২০০২ নং কক্ষে বৈঠক হয়। এই ২০০২ কক্ষে থাকতেন পিসিপির প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক ধীরাজ চাকমা। মিটিংয়ে প্রশান্ত ত্রিপুরাসহ বুয়েট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার মোহাম্মদপুর পাহাড়ী ছাত্রাবাসের হোষ্টেলের পাহাড়ী ছাত্ররা উপস্থিত ছিলেন। সভায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে পাহাড়ী ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক সংগঠন না রেখে একটি একক ছাত্র সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে প্রস্তাব রাখা হয়। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। তবে বেশীরভাগ ছাত্র-ছাত্রী একক ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন। সংগঠনের নাম নিয়ে ‘উপজাতি ছাত্র পরিষদ’ হবে না ‘পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ’ হবে-এ নিয়ে বিতর্ক হয়। এক পক্ষ ‘উপজাতি’ শব্দ রাখার পক্ষে, আরেক পক্ষ ‘পাহাড়ী’ শব্দ রাখার পক্ষে। দীর্ঘক্ষণ বিতর্কের পর সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে ‘পাহাড়ী’ শব্দটি গ্রহণ করা হয়। অতপর সংগঠনের নামকরণ হয় ‘বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)’।
এভাবে ‘পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ’ পাহাড়ী ছাত্র সমাজের একক ছাত্র সংগঠন হিসেবে জন্মলাভ করে। আহ্বায়ক হিসেবে প্রশান্ত ত্রিপুরা, সদস্য হিসেবে বিধান চাকমা, শুভাশীষ চাকমা, ধীরাজ চাকমা (বাবলী) ও মং থোয়াই মারমাকে নিয়ে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট পিসিপির প্রথম আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় ভাস্কর্যে ১৯৮৯ সালের ৯ জুলাই পিসিপি’র ১ম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত কাউন্সিলে সভাপতি হিসেবে বিধান চাকমা, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ধীরাজ চাকমা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে কেরোল চাকমাকে নির্বাচিত করে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট ১ম কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়।
এভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ সমগ্র জুম্ম ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন হিসেবে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত জুম্ম শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম ও আন্দোলনের পাশাপাশি জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংগ্রামে ইস্পাত কঠিন আন্দোলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে সামিল হয়ে কাজ করছে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ