৭ই জানুয়ারি: শান্তিবাহিনী গঠন ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ে জুম্ম জনগণের সশস্ত্র আন্দোলন

0
1699
মঙ্গল কুমার চাকমা

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের প্রতিনিধিবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি থেকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে একের পর এক দাবি-দাওয়া পেশ সত্ত্বেও জুম্ম জনগণের কোন দাবি-দাওয়াই তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার আমলে নেয়নি। বরঞ্চ সংবিধানে জুম্ম জাতিসমূহকে বাঙালি হিসেবে অভিহিত করা, পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বায়ত্তশাসিত উপজাতীয় অঞ্চল হিসেবে সংবিধানে অস্বীকৃতি, লক্ষ লক্ষ বাঙালি মুসলমান অনুপ্রবেশের হুমকি, জুম্ম জনগণের উপর অত্যাচার-নিপীড়ন ও ধর-পাকড় বৃদ্ধি করা হয়। ফলে জুম্ম জনগণ চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং আপামর জুম্ম জনগণের মনে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। এমতাবস্থায় জনসংহতি সমিতি ও পাহাড়ি ছাত্র সমিতির নেতৃবৃন্দের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে যে, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সংগ্রাম করে এই উগ্র ধর্মান্ধ ও সম্প্রসারণবাদী সরকারের কাছ থেকে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায় করা সম্ভব হবে না। এজন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই বলে জনসংহতি সমিতি ও পাহাড়ি ছাত্র সমিতির অনুভব করতে থাকে। তাই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি ধীরে ধীরে অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনেরও প্রস্তুতি নিয়ে থাকে জুম্ম জনগণ। যার চূড়ান্ত ফল হিসেবে ১৯৭৩ সালে ৭ জানুয়ারি জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে গঠন করা হয় সশস্ত্র শাখা ‘শান্তিবাহিনী’।

শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের জন্য বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার ইটছড়ি এলাকার ভেতরে পাহাড় ঘেরা এক দুর্গম স্থানে আগে থেকে জঙ্গল পরিস্কার করে মাঠ প্রস্তুত করা হয়। সেদিন সকালে রান্না করা ভাত ও তরকারি নিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রবাহন, জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা তুঙ (সন্তু লারমা), অমিয় সেন চাকমা কাঞ্চন, রাম কিশোর চাকমা শংকর, কালিমাধব চাকমা মিহির, রূপায়ন দেওয়ান রিপ, গৌতম কুমার চাকমা অশোক, নিলচন্দ্র চাকমা কান্ত, সুদত্ত চাকমা রোক্সিও, বিজয় সিংহ চাকমা পুলুই, জগদীশ চন্দ্র চাকমা দেবংশী, ভদ্রসেন চাকমা উন্মেষ, অনাদি কুমার চাকমা অম্বর, পরিমল বিকাশ চাকমা, প্রিয় কান্তি চাকমাসহ ৩৫ জন সদস্য উক্ত স্থানে জড়ো হন। তখন শীতকাল। ভোর সকাল। রবিবার। ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন চারপাশের উঁচু-নীচু পাহাড়-জঙ্গল। গার্ড অব অনারের জন্য সবাই সারিবদ্ধভাবে সামরিক কায়দায় মাঠে দাঁড়িয়েছিলেন। শুরু হয় ঐতিহাসিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। গার্ড অব অনার পরিচালনা করেন শান্তিবাহিনী (গণমুক্তি ফৌজ) এর ফিল্ড কম্যান্ডার সন্তু লারমা। গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এম এন লারমা। সন্তু লারমার কম্যান্ডান্টে শান্তিবাহিনীর চৌকষ দলের সেলুট প্রদানের পর এম এন লারমা শুরু করেন পতাকা উত্তোলন। সাথে সাথে শুরু হয় শ্লোগান। শ্লোগান ধরেছিলেন সুদত্ত চাকমা এবং সাথে সাথে সবাই সমস্বরে আওয়াজ তুলেন-

জয় জনসংহতি সমিতি!

জয় গণমুক্তি ফৌজ!

আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক!

পতাকা উত্তোলন ও শ্লোগানের পর শুরু হয় আকাশে গুলি ছোঁড়া। বিজয় সিংহ চাকমা একটি রাইফেল থেকে ৭ বার গুলি ছোঁড়েন। এভাবে শান্তিবাহিনীর গার্ড অব অনার, পতাকা উত্তোলন, শ্লোগান, রাইফেল থেকে গুলি ছোঁড়ার মধ্য দিয়ে শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এরপর সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এম এন লারমা শান্তিবাহিনী গঠনের প্রেক্ষাপট, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষের সশস্ত্র আন্দোলন, তৎকালীন বিশ্বব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে সবিশেষ তুলে ধরে এক প্রেরণাদায়ক জোরালো বক্তব্য প্রদান করেন। সন্তু লারমা ও সুদত্ত চাকমার এক সাক্ষাৎকারে তাঁরা লেখককে বলেছিলেন, উক্ত উদ্বোধনী বক্তব্যে এম এন লারমা বলেছিলেন যে- সারাবিশ্বে উপনিবেশিক ও সা¤্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দেশে দেশে নিপীড়িত নির্যাতিত মুক্তিপাগল জাতিসত্তাসমূহের আন্দোলন চলছে। পরাধীনতা থেকে মুক্তির এই আন্দোলন আদর্শগতভাবে সারা দুনিয়ায় এক ও অভিন্ন। তিনি ভারতের তেলেঙ্গেনা আন্দোলন, ফিলিপাইন, আলবেনিয়া, বার্মার মুক্তিকামী মানুষের সশস্ত্র আন্দোলনের কথা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন বিশ্বের দেশে দেশে মুক্তিকামী সশস্ত্র আন্দোলনের সাথে একসূত্রে গাঁথা। তাই জুম্ম জনগণ একা নয়। তিনি বলেন যে, জুম্ম জনগণের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের আশু লক্ষ্য হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামন্তবাদী ও উপনিবেশিক শাসন-শোষণ নির্মূল করে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা, ইসলামিক সম্প্রসারণবাদ প্রতিহত করে জুম্ম জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা, জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণ করা। আন্দোলনের আশু লক্ষ্য ও চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য অবিচল সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে, বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনে ক্ষান্ত না হতে, ধৈর্য ও সাহসের সাথে আত্মবলিদানে উজ্জীবিত হতে তিনি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রতি সেদিন উদাত্ত আহ্বান জানান।

সেদিন শান্তিবাহিনীর প্রথম ব্যাটেলিয়ন গঠন করা হয়। সশন্ত্র বাহিনীর ফিল্ড কম্যান্ডার হিসেবে নির্বাচিত হন সন্তু লারমা। ফলে শুরু হয় জুম্ম জনগণের আতানিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের এক নবতর অথচ কঠোর জীবন-মৃত্যুর সশস্ত্র সংগ্রাম। পাহাড়ি ছাত্র সমিতির বিপ্লবী কর্মীরা দলে দলে শান্তিবাহিনীতে যোগ দিতে থাকে। পাহাড়ি ছাত্র সমিতির নেতৃস্থানীয় কর্মীগণ আত্মগোপনে গিয়ে সশন্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকে। সেই সাথে জুম্ম জনগণকে সশস্ত্র সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের সংগ্রাম জোরদার করতে থাকে। পাহাড়ি ছাত্র সমিতির এই বলিষ্ঠ ও যুগোপযোগী মহাসিদ্ধান্ত অচিরেই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের সশস্ত্র আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। ১৯৭৬ সাল থেকে শুরু হয় সরকারি বাহিনীর উপর শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ। সেসময় ছিল যুব সমাজের মধ্যে আলোড়িত করে শান্তিবাহিনীতে তথা সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দেয়ার এক প্রচন্ড জোয়ার। সেসময় শান্তিবাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১০ হাজারে দাঁড়িয়েছিল বলে জানা যায়।

দলে দলে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির নেতা-কর্মীরা শান্তিবাহিনীতে যোগ দিতে থাকেন। তৎসময়ে পার্বত্যাঞ্চলের অন্যতম বিদ্যাপীঠ রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র রাজনীতির মূল কেন্দ্র। শান্তিবাহিনীতে তথা সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দেয়া অধিকাংশ ছাত্র নেতৃবৃন্দ ছিলেন রাঙ্গামাটি কলেজের শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে অনেকেই লেখাপড়া বাদ দিয়ে কিংবা সন্নিকটস্থ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দেন। গৌতম কুমার চাকমা, চন্দ্রশেখর চাকমা, চাবাই মগ প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দ স্নাতক পরীক্ষায় পাশ করার পর পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে শান্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। অন্যদিকে রূপায়ণ দেওয়ান শান্তিবাহিনীতে যোগদান করেন রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে পড়ার সময় স্নাতক কোর্স শেষ না করে। লক্ষ্মী প্রসাদ চাকমা (দেবাশীষ), নিল চন্দ্র চাকমা (কান্ত), বীরেন্দ্র লাল চাকমা (তঞ্চঙ্গ্যা), কমল বিকাশ চাকমা (দ্বৈবারিক), দেবজ্যোতি চাকমা (দেবেন), নীতিশ দেওয়ান (রোজার), মণিস্বপন দেওয়ান (রাজেশ), সুদত্ত চাকমা (রোক্সিও), তাতিন্দ্র লাল চাকমা (পেলে), সুমন সহ অনেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে সশস্ত্র আন্দোলনে যোগদান করেন। ছাত্রীদের মধ্যে উমে মং (শ্রীমতি গৌতম কুমার), দীপ্তি চাকমা (শ্রীমতি চন্দ্রশেখর), যুথিকা চাকমা (শ্রীমতি নিলচন্দ্র), জয়শ্রী দেওয়ান (শ্রীমতি রূপায়ণ), মায়ারাণী চাকমা (শ্রীমতি রাম কিশোর), জড়িতা চাকমা (শ্রীমতি ধীর কুমার), ভেলুয়া চাকমা (শ্রীমতি লক্ষ্মীপ্রসাদ) সহ অনেক ছাত্রী সশস্ত্র আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন। এভাবেই শত শত জুম্ম ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া শেষ না করে যোগ দিয়েছিলেন সশস্ত্র আন্দোলনে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ফাইনাল (রাজনীতি বিজ্ঞান) পরীক্ষা দেয়ার পর পরীক্ষার ফলাফল অপেক্ষা না করে উষাতন তালুকদার শান্তিবাহিনী যোগদান করেন। শাহ হাই স্কুলে পড়ার সময় তিনি স্কাউটের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেসময় ১৯৬৭ সালে তিনি স্কাউট লিডার হিসেবে পাকিস্তানের করাচি জাম্বুরীতে অংশগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় তিনি ইউনিভারসিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর্পস (ইউ.ও.টি.সি)-এর সদস্য ছিলেন এবং সপ্তাহে ১/২ দিন করে এক বছর ব্যাপী প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন। স্কাউট হিসেবে ছাত্র জীবনের এই প্রশিক্ষণ শান্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ার পর প্রচন্ডভাবে কাজে লাগে।

সামরিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ মহান নেতা এম এন লারমার নির্ভুল নির্দেশনায় ও শিক্ষায় এবং প্রত্যুৎপন্ন নেতা জে বি লারমার সুদক্ষ পরিচালনায় ও নেতৃত্বে শান্তিবাহিনী ক্রমান্বয়ে এক শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল মুক্তি বাহিনীতে গড়ে উঠতে থাকে। শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাহস, কষ্ট সহিঞ্চুতা, ধৈর্য, মনোবল ও সামরিক দক্ষতা দেখে শক্র বাহিনীর মনে ত্রাসের সঞ্চার হয়। দেশে-বিদেশে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংগ্রামের কথা, শান্তিবাহিনীর বীরত্বের কথাও প্রচার হতে থাকে। একসময় সেনাবাহিনী থেকে বলা হয় যে, শান্তিবাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত দক্ষ ও বিচক্ষণ। এটি একটি সুশৃঙ্খল ও চৌকষ গেরিলা বাহিনী। শান্তিবাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা। এই সমস্যাকে সামরিক উপায়ে নয়, রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে বলে সেনাবাহিনী থেকে বলা হতে থাকে।

শান্তিবাহিনীর অন্যতম প্রশিক্ষক ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল (ইপিআর) এর সুবেদার মেজর নলিনী রঞ্জন চাকমা ওরফে অফুরন্ত (বুড়ো ওস্তাদ), ইপিআরের হাবিলদার অমৃত লাল চাকমা (বলি ওস্তাদ) ও মুজাহিদ বাহিনীর কালকেতু চাকমা (কেতু ওস্তাদ)। এমনকি বান্দরবান থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সৈন্য হিসেবে কাজ করা বয়োবৃদ্ধ একজন মারমাও (নাম জানা যায়নি) সেসময় কিছুদিন শান্তিবাহিনীর গোপন আস্তানায় অবস্থান করেছিলেন বলে কেতু ওস্তাদ জানান। বুড়ো ওস্তাদ ১৯৫৪ সালে ইপিআরে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে সিপাহী থেকে লেন্স নায়েক হিসেবে এবং ১৯৬০ সালে লেন্স নায়েক থেকে নায়েক (নন-কমিশন অফিসার) হিসেবে তাঁর পদায়ন হয়। ১৯৬৭ সালে নায়েক থেকে হাবিলদার পদে প্রমোশন পান। রাজশাহী সেক্টরে পোষ্টিং-এ পর তাঁকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন তাঁকে আলাদাভাবে ব্যারাকের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি কক্ষে রাখা হয়েছিল পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে। তাঁর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কাছে গোলাবারুদ ও তথ্য সরবরাহের অভিযোগ আনা হয়।

’৭৩ সালে সামরিক প্রশিক্ষক হিসেবে পার্টিতে যোগ দেবার জন্য পার্টির আহ্বানে বুড়ো ওস্তাদ আন্তরিকভাবে সাড়া দিয়েছেন। পার্টিতে যোগদানের পর তাঁকে নিয়মিত বাহিনীর মতো কাজ করতে হয়নি। একাডেমীতে যতক্ষণ প্রশিক্ষণ কর্মসূচী থাকে ঠিক ততক্ষণই ভিতরে থাকতেন। প্রশিক্ষণ সমাপনান্তে তিনি বাকী সময়টা তাঁর পরিবারের সঙ্গেই কাটাতে পারতেন। তাঁর কাজের পরিধি কম হলেও গুরুত্বের দিক থেকে ছিল অতুলনীয়। কেন্দ্রীয় কমিটিকে তিনি পার্টির সামরিক বাহিনী সাজানো ব্যাপারে পরামর্শ দিতেন। খাদ্য, গোলাবারুদ ইত্যাদি সামরিক সরঞ্জাম সংরক্ষণ ও বিলি বন্টন ইত্যাদি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তিনি ছিলেন অভিজ্ঞ। তিনি ইপিআরে চাকরির সময় জুনিয়র লিডারশীপ কোর্স লাভ করে। সেই প্রশিক্ষণের দলিল ও বইপত্র তাঁর কাছে ছিল। সেসব প্রশিক্ষণ দলিলপত্র দিয়ে প্রশিক্ষণের যাবতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করে শান্তিবাহিনীকে চৌকষ করে তুলেন। একটা সামরিক বাহিনী গঠন সম্পর্কিত জ্ঞান তাঁর যথেষ্ট ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সামরিক বিভাগ সমৃদ্ধ করার পশ্চাতে তাঁর অবদান ছিল বহুমুখী ও অপরিসীম।

নলিনী রঞ্জন চাকমা বুড়ো ওস্তাদের জন্ম ১০ নভেম্বর ১৯৩২ খৃষ্টাব্দে রাঙ্গামাটি জেলার নান্যাচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের ছোট মহাপুরম গ্রামে। মহান নেতা এম এন লারমাদের প্রতিবেশী। বুড়ো ওস্তাদের প্রাইমারী শিক্ষা সম্পন্ন হয়েছিল মহাপুরম এম ই স্কুলে (মিডল ইংলিশ স্কুল)। যেখানে প্রধান শিক্ষক ছিলেন চিত্ত কিশোর চাকমা। মাধ্যমিক স্তরে পড়াশুনা করে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। গৃহযুদ্ধে এম এন লারমা নিহত হলে তিনি হতাশ ও মর্মাহত হয়ে পড়েন। এম এন লারমার মৃত্যুকে তিনি সহজে মেনে নিতে পারেননি। পরে পাটি কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে সশস্ত্র আন্দোলন ছেড়ে ১৯৮৪ সালে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। আনসার বাহিনীতে তিনি আবার চাকরি লাভ করেন। ২৯ অক্টোবর ২০১৫ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও পাহাড়ি ছাত্র সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের পক্ষ থেকে বার বার প্রতিনিধিত্ব করা সত্ত্বেও সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার জুম্ম জনগণের মৌলিক সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেনি। বরঞ্চ পরিবর্তে সংবিধানে জুম্ম জনগণকে বাঙালি হিসেবে পরিণত করা হয়। জুম্ম জনগণের উপর লুণ্ঠন, ধর্ষণ, হত্যা, ধরপাকড় ও অন্যান্য নাশকতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখে, সর্বোপরি ব্যাপকভাবে বেআইনী বাঙালি মুসলমান অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব চিরতরে ধ্বংস করার নির্মম ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। বৈদেশিক আক্রমণের দোহাই দিয়ে দীঘিনালা, আলিকদম ও রুমায় তিনটি সেনানিবাস স্থাপন করা হয়। গণপ্রতিনিধির মাধ্যমে পেশকৃত জুম্ম জনগণের সকল দাবি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যাত হতে থাকে। ফলে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যেতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হলে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পথ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।

উল্লেখ্য যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকান্ডের পর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপরে দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়। এরপর অভ্যুত্থান পাল্টা-অভ্যুত্থান এবং দেশে সামরিক শাসন জারির ফলে সংবিধানের কিছু মৌলিক অধিকার স্থগিত করা হয়। সভা-সমিতি, বাক-স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। শুরু হয় ব্যাপকভাবে ধর-পাকড়, জেল-জুলুম, দমন-পীড়ন। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। এমনিতর পরিস্থিতিতে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পাহাড়ি ছাত্র সমিতিও অনিয়মতান্ত্রিক তথা সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।

বস্তুত জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম জনগণ নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। কিন্তু বিশেষ বাস্তবতায় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের রূপ পরিবর্তন করে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেগুলো হচ্ছেÑ

(১)উগ্র ধর্মান্ধ ও সম্প্রসারণবাদী সরকারের অনমনীয় মনোভাব এবং নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনার মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া।

(২)দেশের শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অদূরিদর্শিতা, সংকীর্ণতা, উগ্র জাত্যিাভিমানী শাসন, নীতি ও কৌশল।

(৩)নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করা সত্ত্বেও জুম্ম জনগণের কোন দাবি-দাওয়া পূরণ করতে শাসকগোষ্ঠীর এগিয়ে না আসা।

(৪)সর্বোপরি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশে সামরিক আইন জারি হলে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার যাবতীয় পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়া।

সহজ সরল শান্তিপ্রিয় জুম্ম জনগণকে নিজেদের পথ নিজেরাই বেছে নেয়ার কিংবা সশস্ত্র আন্দোলনের মতো চরম পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতি বস্তুত ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তি কাল থেকে শুরু হয়েছিল। প্রথমত: ভারত বিভক্তির সময় ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে বারে বারে ধর্ণা দিয়েও বল্লভ ভাই প্যাটেল ব্যতীত কেউই আন্তরিকতা ও মহানুভবতার সাথে কর্ণপাত করেনি। জুম্ম জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে এবং ভারত বিভক্তির সকল নীতিকে পদদলিত করে উপনিবেশিক ব্রিটিশ কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে নিক্ষেপের মাধ্যমে জুম্ম জনগণের প্রতি যে চরম অবিচার করা হয়েছিল তা জুম্ম জনগণের মনে চরমভাবে রেখাপাত করেছিল।

দ্বিতীয়ত: পাকিস্তান হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের স্বকীয় সংস্কৃতি ও স্বাতন্ত্রতাকে, ঐতিহাসিক শাসনতান্ত্রিক মর্যাদা, পার্বত্য চট্টগ্রামের পশ্চাপদতাকে বিন্দুমাত্র বিবেচনায় না নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হতে না হতেই ভারত থেকে আসা মুসলমানদেরকে পার্বত্য বসতি প্রদান, ক্রমান্বয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনতান্ত্রিক মর্যাদা তুলে দেয়া এবং ব্রিটিশ প্রবর্তিত উপনিবেশিক আইন পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনে সর্বশেষ যে ন্যূনতম রক্ষাকবচ ছিল তাও জুম্ম জনগণের অগোচরে ধীরে ধীরে কর্তন করার ফলে অস্তিত্ব বিলুপ্তির আশঙ্কায় জুম্ম জনগণকে ত্রস্ত করে তোলে। বিশেষ করে জুম্ম জনগণের কোন মতামত না নিয়েই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক জুম্ম জনগণের মরণ ফাঁদ কাপ্তাই বাঁধ চাপিয়ে দেয়া, উদ্বাস্তুদেরকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন না দেয়া, দিশেহারা উদ্বাস্তুদের একটা অংশ ভারত ও বার্মায় চলে গেলেও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর চরম নির্লিপ্ততা ইত্যাদি জুম্ম জনগণকে চরমভাবে ভাবিয়ে তোলে ও অশান্ত করে তোলে।

তৃতীয়ত: জাতিগত নিপীড়ন ও শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতে না হতেই পাকিস্তানপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক জুম্ম জনগণের উপর একের পর হত্যাকান্ড এবং ফেনী-রামগড়ে হাজার হাজার মুসলমান বাঙালির অনুপ্রবেশ, সর্বোপরি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসিত অঞ্চলের মর্যাদার দাবি প্রত্যাখ্যাত হওয়া, আশা-ভরসার একমাত্র স্থল মহান বিপ্লবী নেতা বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানও জুম্ম জনগণের দাবিদাওয়ার প্রতি বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করা ইত্যাদি ধারাবাহিক ঘটনায় জুম্ম জনগণ চরমভাবে আশাহত হয়ে উঠে। উপরন্তু বাংলাদেশের স্থপতি স্বয়ং এম এন লারমাসহ জুম্ম নেতৃবৃন্দকে বাড়াবাড়ি না করতে, প্রয়োজনে পার্বত্য চট্টগ্রামে লক্ষ লক্ষ বাঙালি ঢুকিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়ায় জুম্ম নেতৃবৃন্দকে তীব্রভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। সেই সাথে সংবিধানে ভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারী জুম্ম জনগণকে ‘বাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করায় জুম্ম জনগণ নিজেদের জাতিগত পরিচয় নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠে। বাকশাল গঠনের সময় বঙ্গবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানে জুম্ম নেতৃবৃন্দকে কিছুটা আশার বাণী শোনালেও তা বাকশাল সরকারের পতনে অঙ্কুরেই ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়।

এমনিতর পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশে সামরিক শাসন জারি হলে এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ হলে নিয়মতান্ত্রিক পথ ছেড়ে অনিয়মতান্ত্রিক পথে যেতে জুম্ম জনগণকে আরো উৎসাহিত করে তোলে। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের স্বার্থে এম এন লারমা ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থানের পর পরই আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন এবং তিনি সরাসরি সশস্ত্র আন্দোলনের দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হন। তখন থেকেই কার্যত শুরু হয় সশস্ত্র উপায়ে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনের জীবন-মরণের এক নবতর অধ্যায়।

তথ্যসূত্র:

১। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংক্ষিপ্ত জীবনী, শ্রী হিমাদ্রী, ১০ই নভেম্বর স্মরণে, ১৯৮৫, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।

২। নারী মুক্তি প্রসঙ্গে এম এন লারমা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম নারী নির্যাতন, শ্রীমতি পল্লবী, জুম্ম সংবাদ বুলেটিন, বুলেটিন নং-২৩, ৫ম বর্ষ, ১০ নভেম্বর ১৯৯৫, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।

৩। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন, বিভেদপন্থী চক্রান্ত ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা, মঙ্গল কুমার চাকমা।

৪। শান্তিবাহিনী: গেরিলা জীবন, গোলাম মোর্তোজা, সময় প্রকাশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি বইমেলা ২০০০।

৫। এম এন লারমার জীবন ও সংগ্রাম, স্মারকগ্রন্থ, এম এন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশন।