৭ই জানুয়ারি: পরাধীনতা থেকে মুক্তির ডাক দিয়ে যায়

0
432

 

 

বাচ্চু চাকমা

ঐতিহাসিক ৭ই জানুয়ারি নিপীড়িত জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনের ইতিহাসে মহান অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তির সংগ্রামে জেগে উঠার অন্যতম একটি দিন। এদিনে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগ্রামের বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার হাতে-গড়া রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা ‘শান্তিবাহিনী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষের মতো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতার গভীর উপলদ্ধি থেকে এই ঐতিহাসিক ৭ই জানুয়ারি জন্মলাভ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জাতিসমূহের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সমুন্নত রেখে একটা জাতি হিসেবে আত্মপরিচয় নিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বেঁচে থাকার মৃত্যুহীন বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রদর্শিত চেতনা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা থেকে বিশ্বের সবচেয়ে কষ্টকর ও কঠিনতর সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের পথচলা শুরু হয়েছে।

পরাধীনতা থেকে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির মূলমন্ত্র নিয়ে জন্মলাভ করা এই গেরিলা বাহিনীর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ বেঁচে থাকার সঠিক দিশা খুঁজে পেয়েছে। নীতিগতভাবে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই সংগ্রামে বিশ্বাসী হয়ে হাজারো বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে মুক্তির মহান উদ্দেশ্যে সশস্ত্র সংগ্রামে সামিল হয়েছে অসংখ্য শান্তিবাহিনী গেরিলা। এই দীর্ঘযাত্রায় পথচলা অতি কষ্টকর ও বেদনাদায়ক হলেও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিচারে বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর পরাধীনতার নির্মম বাস্তবতা থেকে জুম্ম জাতির মুক্তির ভিত্তিভূমি নিহিত রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জাতিসমূহের আত্মপরিচয়ের অধিকারকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

এই অস্বীকৃতিস্বরূপ চির অধিকার বঞ্চিত জুম্ম জাতির পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ও যন্ত্রণাকে সাথে নিয়ে জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার মহান উদ্দেশ্যকে বুকে লালন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ১৯৭২ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি নিপীড়িত, বঞ্চিত জাতি ও মানুষের পার্টি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর দেশে দেশে নিপীড়িত জাতি ও মানুষের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটের আলোকে ৭৩-এর ৭ই জানুয়ারি জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা ‘শান্তিবাহিনী’ জন্মলাভ করেছে। এই গেরিলা বাহিনী বিশাল একটা প্রতিষ্ঠিত সরকারি বাহিনীর অসম শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কষ্ট সহিষ্ণুতার গল্পের ইতিহাস জন্ম দিয়েছে।

পৃথিবীর দেশে দেশে অসংখ্য নিপীড়িত জাতির পরাধীনতা থেকে মুক্তির সংগ্রামে প্রত্যেক বিপ্লবের মধ্যে একটা মোড় রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপ্লবের ক্ষেত্রে মোড় হল দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। ৭৩-এর ৭ই জানুয়ারি জনসংহতি সমিতির বাস্তবমুখী সিদ্ধান্তই পুরো জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনে পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এই সময় মুক্তিকামী জুম্ম জনগণকে সংগঠিত করার জন্য সংগঠক, প্রশাসক ও যোদ্ধার ভূমিকা নিয়ে শান্তিবাহিনী গেরিলারা রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদারভাবে চালিয়ে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ছিল পশ্চাদপদ। সামন্তীয় সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস থেকে তখনই পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ বেরিয়ে আসতে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ অধিকাংশই জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

জুম্ম সমাজের সহজ-সরল অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থায় কঠিনতর সশস্ত্র সংগ্রামে অর্থবল যোগান দেওয়া ছিল আরও বেশি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। শান্তিবাহিনী গেরিলারা সামগ্রিক বিপ্লবের বিশ্বাসী বলে নিজেরাই প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদন সংগ্রামে সামিল হয়ে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে পেরেছেন। বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রদর্শিত আদর্শের ভিত্তিতে শান্তিবাহিনী গেরিলারা নিজেদেরকে গড়ে তোলার সংগ্রামের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জাতিসমূহের সামগ্রিক পরিবর্তনের সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তৎসময়ে শান্তিবাহিনী গেরিলাদের প্রতি জুম্ম জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল আকাশচুম্বি। কেননা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের মধ্যে ছিল দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা। শান্তিবাহিনী গেরিলাদের কথা ও কাজের মিল দেখে জুম্ম জনগণ অধিকতর আশান্বিত হন। সরকারি বাহিনীর অসম শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় প্রায় প্রত্যেকটি আক্রমণে শান্তিবাহিনী গেরিলারা সুনিশ্চিতভাবে জয়ী হয়ে নিজেদের নিরাপদ ও ঘাঁটি এলাকায় ফিরে আসে।

সশস্ত্র সংগ্রামে অসংখ্য শান্তিবাহিনীর বীরযোদ্ধা শত্রু বাহিনীর সাথে লড়তে লড়তে রণাঙ্গনে মারা গেছেন এবং সমগ্র পাহাড় শান্তিবাহিনীর বীর শহীদদের রক্তে লাল হয়ে গেছে। তারপরও মুক্তিকামী জুম্ম জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে সরকার বাহিনী শত চেষ্টা করেও দমিয়ে রাখতে পারেনি। শান্তিবাহিনী গেরিলাদের একেক জনের মৃত্যুতে অন্যজন এসে শূণ্যস্থান পূরণ করে এক একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। জাতির মুক্তির জন্য যাঁরা আত্মবলিদান দিয়েছেন-এই বিপ্লবী শান্তিবাহিনী গেরিলাদের একেক জনের মৃত্যু পাহাড়ের চেয়েও অধিক ভারী ছিল। জুম্ম জাতির আন্দোলনের ইতিহাসে এই বিপ্লবী শান্তিবাহিনী সদস্যদের মৃত্যু মুক্তিকামী মানুষের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে আজও শক্তি, সাহস ও প্রেরণা দিয়ে যায়।

তৎকালীন শান্তিবাহিনী গেরিলারা অনেকেই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এক একজন নিবেদিত তরুণপ্রাণ এবং গেরিলা জুম্ম তরুণেরা শিক্ষকতার মতো মহান পেশা ত্যাগ করে জুম্ম জাতির মুক্তির জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দিয়েছেন। একদিকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এক ঝাঁক জুম্ম তরুণপ্রাণ অন্যদিকে তারা বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রদর্শিত আদর্শের রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দুনিয়াকে কেবলমাত্র জানা ও ব্যাখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, দুনিয়াকে পরিবর্তনের বিশ্বাসী হয়ে মানবমুক্তির সাধনায় নিবেদিত ছিলেন। এই জুম্ম জাতির শান্তিবাহিনী গেরিলারা তৎসময়ে সাহস, শক্তি, কষ্ট সহিষ্ণুতা, ধৈর্য, মনোবল, সামরিক ও রাজনৈতিক উভয় জ্ঞানে দক্ষ হয়ে দেশে-বিদেশে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের সংগ্রামের কথা এবং শান্তিবাহিনী গেরিলাদের বীরত্বের কথা ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনী হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে। শান্তিবাহিনীর গেরিলারা অত্যন্ত দক্ষ, চৌকষ ও বিচক্ষণ এবং সুশৃঙ্খল।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে ক্রমান্বয়ে গড়ে উঠে গ্রাম পঞ্চায়েত, যুব সমিতি, মহিলা সমিতি, গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠী, গ্রামে গ্রামে বিশাল মিলিশিয়া বাহিনী এবং সেই সাথে শান্তিবাহিনী গেরিলাদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সাধারণ জুম্ম জনগণের ভেতরে গ্রামে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘গণলাইন’। এক সময় সরকারি বাহিনী বলতে বাধ্য হয়, বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আন্দোলনকে ‘মাস্টার্স রেভ্যুলেশন’বলে এবং এটি একটি ওয়েল অর্গানাইজ হিসেবে। তার কারণ অসংখ্য জুম্ম তরুণ স্কুলের শিক্ষক হয়েও আন্দোলনে যোগদান করেন এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষিত জুম্ম ছাত্র জুম্ম জাতির মুক্তির জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দিয়েছেন।

তৎকালীন জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনে শান্তিবাহিনী নামে খ্যাত গণমুক্তি ফৌজের চৌকষ ও বীরত্ব দেখে শত্রু বাহিনীর মনে ভয়, আতঙ্ক ও ত্রাসের সঞ্চার হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। পাহাড়ের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার মহান উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে অসংখ্য সহযোদ্ধা নিজের জীবনকে আত্মোৎসর্গ করেছেন। জুম্ম জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অসংখ্য সহযোদ্ধা জীবন উৎসর্গের বিনিময়ে জুম্ম জাতির জাতীয় জীবনে অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এক সময় যে জাতির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেনি সে জাতির মধ্যে জাতীয় রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছে। যে জাতির মধ্যে নিজেকে জানার আগ্রহ ছিল না, সে জাতির শান্তিবাহিনীরা আপন জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্বকে নিজেদের চেতনার মধ্যে জাগরণ ঘটিয়ে মুক্তির লড়াইয়ে সামিল হয়েছে। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সময় শান্তিবাহিনী গেরিলাদের সশস্ত্র সংগ্রাম পাহাড়ের এই ভূমিতে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে অনেকটাই সহজতর করে দিয়েছে। জুম্ম জাতির মুক্তিবাহিনী হিসেবে শান্তিবাহিনীতে ৬০-৭০ দশকের অসংখ্য জুম্ম জাতির ছাত্র-যুবক সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে জুম্ম জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হিসেবে মুক্তিকামী মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছে।

৭ই জানুয়ারি, এদিনটি জুম্ম জাতির জন্য গৌরবের দিন এবং অবিস্মরণীয় স্মৃতি-বিজরিত একটি দিন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও জুম্ম জাতির জাতীয় জাগরণের মহান অগ্রদূত বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার রাজনৈতিক ও সামরিক উভয় জ্ঞানের দক্ষ পরিচালনায় নীতিগতভাবে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই সংগ্রামে বিশ্বাসী হয়ে কৌশলগতভাবে দ্রুত নিষ্পত্তির লড়াই চালিয়ে যাবার অন্যতম একটা ভিত্তি রচনা করে গেছেন। বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনকে রাজনৈতিক জ্ঞান, বিজ্ঞান ও শিল্পকলা দিয়ে সাজিয়েছেন। আধুনিক জগতের জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিক্ষা ও শিল্পকলার সাথে যুগ যুগ ধরে কুসংস্কার ও অন্ধকারে নিমজ্জিত জুম্ম জাতিকে মানব কল্যাণ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচয় করে দিয়ে কঠিনতর সশস্ত্র সংগ্রাম শিখিয়ে গেছেন।

বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার হাতে-গড়া জনসংহতি সমিতির যুগোপযোগী সিদ্ধান্তই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের সশস্ত্র সংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। সেই সাথে তৎকালীন ৬০-৭০ দশকের পাহাড়ী ছাত্র সমিতির বিপ্লবী কর্মীরা ঝাঁকে ঝাঁকে শান্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে জুম্ম জাতির সংগ্রামের ইতিহাসের পৃষ্ঠাকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৭৩ সালে ৭ই জানুয়ারী শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠার ৩ বছরের মাথায় ১৯৭৬ সাল থেকে শুরু হয়েছিল সরকারি বাহিনীর উপর শান্তিবাহিনী গেরিলাদের সশস্ত্র আক্রমণ। তৎসময়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত ছাত্র তথা পাহাড়ী ছাত্র সমিতির বিপ্লবী কর্মীরা ঝাঁকে ঝাঁকে সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেওয়ার প্রবল জোয়ারে জনসংহতি সমিতির আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তির এই আন্দোলন নীতি ও আদর্শগতভাবে সমগ্র বিশ্বের মধ্যে এক ও অভিন্ন।

পৃথিবীর দেশে দেশে পরাধীনতা থেকে মুক্তির আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল-তৎকালীন সময়ের ফিলিপাইন, কিউবা, ভিয়েতনাম, রাশিয়া ও চীনসহ অসংখ্য দেশে দেশে, যেখানে এধরনের গেরিলাদের সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের কষ্ট সহিষ্ণুতার গল্প রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মধ্যে তেলেঙ্গানা আন্দোলন, মিজোরামে মিজোদের আন্দোলন ও নাগাল্যান্ডের নাগাদের সশস্ত্র আন্দোলন এবং প্রতিবেশী বার্মার মুক্তিকামী মানুষের সশস্ত্র আন্দোলনের কথা আজও মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা যোগাতে পারে। ভারত সরকার ভারতের ভিন্ন ভাষাভাষী অসংখ্য আদিবাসী জাতিসমূহের মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বের দরবারে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রশংসিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ বার্মা ও আমাদের বাংলাদেশ এখনও সেই মহানুভবতার পরিচয় দিতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় মুক্তি আসেনি এবং পরাধীনতার নাগপাশের দুঃসহ যন্ত্রণাকে জুম্ম জাতিকে আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের চাইতে এই সশস্ত্র সংগ্রাম অধিকতর কঠিন ও রক্তাক্তময়। পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামে শান্তিবাহিনীর গেরিলাদের এক সময় ২০০ গ্রাম চালের ভাত খেয়ে আন্দোলনে টিকে থাকতে হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে রাত-দিন ক্ষুধার দুঃসহ যন্ত্রণাকে সহ্য করে শান্তিবাহিনী গেরিলারা জুম্ম জনগণের জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম থেকে এক পাও পিছপা হয়নি। কঠিন কঠোর দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে কেটেছে শান্তিবাহিনী গেরিলাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন। একটি মাত্র ইউনিফর্মের প্যান্ট-শার্ট পরিধান করে রাত-দিন ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে শান্তিবাহিনী গেরিলারা কষ্টকর জীবন কাটিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছেন। তারা নিপীড়িত জুম্ম জনগণকে পরাধীনতার দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন-হাজারো কষ্টের মাঝে এটাই কেবলমাত্র গেরিলাদের মনে তৃপ্তি ও আনন্দ এনে দিত।

সশস্ত্র সংগ্রামের দুঃখ আর কষ্টগুলোকে আপন করে নিয়ে আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে গেছেন অসংখ্য শান্তিবাহিনী। নিজেদের শ্রমের ফলে উৎপাদিত ক্ষেতের ফসলাদি বিক্রি করে তরকারি রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্রয় করে গেরিলারা জীবন অতিবাহিত করেছেন। পৃথিবীর দেশে দেশে নিপীড়িত জাতি ও মানুষের অধিকার অর্জনে এই সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের অসংখ্য কালজয়ী ইতিহাস রচিত হয়েছে। এই সশস্ত্র সংগ্রাম একটি বাঁচা-মরার লড়াই, এই সংগ্রামে বলপ্রয়োগের রাজনীতির কথা বিশ্বাস করতে হয়। এই সশস্ত্র সংগ্রাম কখন করতে হয়? মূলতঃ রাজনীতির গোড়া বুঝতে পারলে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রেক্ষাপট অবশ্যই সহজে বুঝে নেওয়া সম্ভব। রাজনীতি যখন একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে বিকাশ লাভ করে এবং আগের মত করে আর রাজনীতি এগুতে পারে না, তখন রাজনৈতিক পথের বাধাকে ঝেড়ে দূর করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজন হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই হয়েছে।

পৃথিবীর দেশে দেশে নিপীড়িত জাতি ও মানুষের পক্ষে সংগঠিত সশস্ত্র সংগ্রাম বুঝতে পারা যতোটা সহজ-এই সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আন্দোলন সংগঠিত করা আরও বেশি কঠিন। এই কঠিনতর সশস্ত্র সংগ্রাম বাস্তবে করে দেখিয়েছেন বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও বর্তমান নেতা সন্তু লারমাসহ ৬০-৭০ দশকের জুম্ম সমাজের পাহাড়ী ছাত্র সমিতির অসংখ্য বিপ্লবী বন্ধু। বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনীর প্রথম চৌকষ ফিল্ড-কমান্ডার জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার সুদক্ষ পরিচালনায় বিশেষ পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের সংগ্রামের রূপ পরিবর্তন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এই কঠিনতর সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়েছিলেন।

উগ্র মুসলমান ধর্মান্ধ ও ইসলামি সম্প্রসারণবাদী বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর অনমনীয় মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি, আমাদের জুম্ম জাতির উপর প্রতিনিয়ত নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনার মাত্রা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া, শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও উগ্র বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের জাত্যভিমানে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার ঘৃণ্য নীতি ও কৌশল, জুম্ম জনগণের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সমস্ত দাবি-দাওয়া পূরণ না করে উগ্র জাত্যভিমানের দৃষ্টিভঙ্গিতে উপেক্ষা করা এবং সবশেষে ৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে মারা যাওয়ার পর দেশের মধ্যে সামরিক শাসন জারী হলে গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনের সমস্ত পথ অবরুদ্ধ হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনের রূপ পরিবর্তন করে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।

সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে একদিকে প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিবিপ্লবী শত্রু বাহিনীর প্রবল বৈরিতার মুখোমুখি, অপরদিকে প্রাকৃতিক অসংখ্য বাধা ও প্রকৃতির বৈরি আবহাওয়া-এই দুই দিকের বৈরিতার সাথে লড়াই করে শান্তিবাহিনী গেরিলাদের সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুরু করতে হয়েছে। শান্তিবাহিনী গেরিলারা সশস্ত্র সংগ্রামের সময়ে রাত-দিন, ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে দূর্গম পাহাড়-পর্বতে ঘেরা গিরিখাদ, জনশূন্য বনজঙ্গল, নদী-খাল, ঝিরি-ঝর্ণা পাড়ি দিয়ে শত্রু বাহিনীর সাথে লড়াই করেছেন এবং তাদেরকে পর্যুদস্ত করেছেন। এই সশস্ত্র সংগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রামের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের একটা প্রধান সন্ধিক্ষণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তৎসময়ে জুম্ম জাতি বিলুপ্তিকরণের অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর জঘন্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শান্তিবাহিনীর গেরিলারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। অসংখ্য শান্তিবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের সাথে মিশে গিয়ে শত্রু বাহিনীর টার্গেট থেকে সহজে বেঁচেছিলেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনীর গেরিলারা ছিলেন জুম্ম জনগণের সবচেয়ে কাছের জন ও সবচেয়ে আপনজন। দেশপ্রেম ও জাতিপ্রেমের চেতনায় উদ্ভূত হয়ে জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষায় বীরদর্পে সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামে সামিল হয়েছিলেন। সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সময় পাহাড়ের বুকে এক সময় কাউখালীতে কলমপতি ইউনিয়নে প্রথম বর্বরতম গণহত্যা সংগঠিত করে শাসকগোষ্ঠী। জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের জন্য পরিকল্পিতভাবে একে একে ভূজনছড়া, লংগদু, লোগাং, নান্যাচর, কাচালং এর মতো অসংখ্য লোমহর্ষক গণহত্যা, জুম্ম জনগণের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, লুটপাট, উচ্ছেদ ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ-এধরনের মানব বিধ্বংসী অন্যায়ের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামে সামিল হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন পাহাড়ী ছাত্র সমিতির বিপ্লবী কর্মীরা ও অসংখ্য জুম্ম ছাত্র তরুণ। জুম্ম জাতির উপর শাসকগোষ্ঠী যত বেশি দমন-পীড়ন চালিয়েছে ততই জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র লড়াই সংগ্রাম শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী শান্তিবাহিনী গেরিলাদের দমনের জন্য জুম্ম জাতির সাথে অস্ত্রের ভাষা ব্যবহার করেছিল। তৎকালীন জুম্ম জাতির মুক্তি পাগল টগবগে শান্তিবাহিনী গেরিলারাও অস্ত্রের ভাষায় জবাব দিয়ে সরকার বাহিনীকে দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পশ্চাদপদ সামন্তীয় সমাজের মধ্যে বেড়ে উঠা ৬০-৭০ দশকের শান্তিবাহিনীর গেরিলারা পাহাড়ের সংকটময় পরিস্থিতিকে বদলানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে আজীবন লড়াই করে গেছেন। জুম্ম সমাজের মধ্যে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও শান্তিবাহিনীর গেরিলারা সমাজের গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে সমগ্র জুম্ম জনগণের জন্য লড়াই করেছেন। জাতীয় অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে রীতিমত বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীকে পর্যুদস্ত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করেছেন। দুনিয়ার ভোগবাদী সমাজের দালালীপনা শান্তিবাহিনী গেরিলাদের সেদিন বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারেনি। ভোগবাদী সমাজ কোনোক্রমেই গেরিলাদের ভোগবাদী বানিয়ে জাতীয় মুক্তির আন্দোলনকে ধ্বংস করতে পারেনি। ব্যক্তি স্বার্থপরতা, দোদুল্যমানতা, উচ্চাভিলাষ, আত্মকেন্দ্রিকতা ও সুবিধাবাদিতা চলমান সমাজ ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা সংগ্রাম বিরোধী চিন্তাধারাগুলো তাদের লড়াই সংগ্রামকে একমুহূর্তের জন্যও থামিয়ে রাখতে পারেনি। গেরিলাদের নিজস্ব স্বার্থ, নিজস্ব জগৎ ও নিজস্ব পৃথিবীকে ত্যাগ করে সবচেয়ে আপনজন থেকে দূরে থেকে একটা স্বপ্নকে বুকে আলিঙ্গন করে মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। যে স্বপ্ন মানুষকে ঘুমাতে দেয় না, যে স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে যুগের পর যুগ ধরে এবং যে স্বপ্নকে বাস্তবায়নে শান্তিবাহিনীর গেরিলারা প্রতিটি মুর্হূতে ছটফট করেছে, সেই স্বপ্নকে ঘিরে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পর্যন্ত দ্বিধাবোধ করেনি।

জুম্ম জাতির মুক্তির লড়াইয়ে গেরিলারা দেখা স্বপ্নকে সবার উর্ধ্বে রেখে জাতীয় অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে সমগ্র জুম্ম জনগণ এখনও করে যাচ্ছে প্রতিবাদ, পাশবিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। পরাধীনতার দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য আজও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গড়ে তুলবার চেষ্টা করছে প্রতিরোধ সংগ্রাম। মানুষের মুক্তির স্বপ্ন চেতনার মধ্যে জাগরণ না ঘটলে অসম শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে অসম্ভবকে সম্ভব করার বৈপ্লবিক আন্দোলন ক্রিয়াশীল রাখা সম্ভব নয়। সমগ্র মানুষের জন্য বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখলে সেই স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের শান্তিবাহিনী কেবল নয় বিশ্বের মুক্তিকামী অসংখ্য বিপ্লবী সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য পরিপূরণের জন্য নিরন্তর গতিতে এগিয়ে যেতে পারবে। বস্তুতঃ দেশপ্রেম, জাতিপ্রেম ও জন্মভূমির প্রতি গভীর ভালবাসা থেকে সত্যিকার অর্থে ত্যাগ ও সংগ্রামের প্রেরণা অঙ্কুরিত হতে পারে! সংগ্রাম ও ত্যাগের প্রেরণা না থাকলে সমগ্র দুনিয়ায় বঞ্চিত জাতি ও মানুষের জন্য গণমুক্তি ফৌজের ন্যায় দীর্ঘস্থায়ী লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব।

একটা গেরিলা যুদ্ধ চালাতে গেলে সেই গেরিলা বাহিনীর জন্য প্রয়োজন হয় পশ্চাদভূমি এবং সেই সাথে প্রয়োজন হয় জনবল, অর্থবল ও অস্ত্রবল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে শান্তিবাহিনী গেরিলাদের মধ্যে এই তিনটি শক্তি অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ে ছিল। শত-হাজারো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এই তিনটি শক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে তারা সশস্ত্র সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্রভাবে সক্রিয় গেরিলাদের মধ্যে অগাধ দেশপ্রেম, জাতিপ্রেম ও নিপীড়িত জুম্ম জনগণের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকার ফলে সশস্ত্র আন্দোলন দুর্বার গতিতে অগ্রসর হয়েছিল। জাতিপ্রেম ও জন্মভূমির প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জুম্ম জাতির মুক্তির ব্যাপারে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে অসংখ্য শান্তিবাহিনীর গেরিলা সর্বদাই উদগ্রীব ছিলেন। বিজাতীয় শাসন-শোষণ ও পরাধীনতার প্রতি তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার ফলে অসম শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাবার জন্য গেরিলাদের মধ্যে অসীম ধৈর্য্য, মনোবল, সাহস, শক্তি ও কৌশল-এই ধরনের অভ্যন্তরীণ ভিত্তিসমূহ সক্রিয় ছিল। শাসকগোষ্ঠীর এই বিশাল শক্তিশালী শত্রুবাহিনীর সামনে তৎকালীন পাহাড়ের বিপ্লবী শান্তিবাহিনী গেরিলারা বুক ফুলিয়ে লড়াই চালিয়েছিলেন। শক্তিশালী শত্রুবাহিনীকে প্রতিটি যুদ্ধে কাবু করে তৎকালীন শত্রুবাহিনীরা রণ-ক্লান্ত হয়ে ‘আমরা যুদ্ধ চাই না’ বলতে বাধ্য হয়েছেন। এই শান্তিবাহিনী গেরিলাদের মধ্যে রাজনৈতিক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতি ও আদর্শ যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান থাকায় তা সম্ভব হয়েছে।

সেই সময়ের অসংখ্য জুম্ম ছাত্র তরুণ শান্তিবাহিনীর ইউনিফর্ম পরিধান করে দেশপ্রেম ও জাতিপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জুম্ম জাতির প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গের জন্য উৎসুক ছিলেন। সমাজ বিপ্লবের রাজনৈতিক তত্ত্বে বলা হয়েছে, গাছ যেমন জমিনের রস খেয়ে দেহ বৃদ্ধি করে ঠিক তেমনি পাহাড়ের ৬০-৭০ দশকের সশস্ত্র শান্তিবাহিনীর গেরিলারাও জুম্ম জনগণের কাছ থেকে রস খেয়ে লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চালিয়েছিলেন। জুম্ম জনগণের গর্ভেই জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শান্তিবাহিনী গেরিলাদের জন্ম হয়েছে। কাজেই জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার্থে শান্তিবাহিনী গেরিলারা সব সময় সোচ্চার ও সচেতন ছিলেন। জুম্ম জনগণের গর্ভেই জন্মলাভ করা শান্তিবাহিনীর বীর সেনানীরা স্বপ্ন দেখেছিলেনপার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের মৌলিক মানবাধিকার ছিনিয়ে আনবে। জুম্ম জনগণের মুখে হাসি ফুটাবে এবং পাহাড়ের গণমানুষের দুঃখ-কষ্ট, গ্লানিভরা যন্ত্রণাকে মুছে দিয়ে পাহাড়ের স্বতন্ত্রতা ফিরিয়ে আনবে। বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও বর্তমান নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে উপযুক্ত রাজনৈতিক গাইডলাইনকে সামনে রেখে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের আশা-আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছেন তৎকালীন শান্তিবাহিনীর গেরিলারা। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সূত্রপাত ৭ই জানুয়ারি আজও পরাধীনতা থেকে আমাদের মুক্তির ডাক দিয়ে যায়। মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক!