৫ দফা দাবি জানিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে লামা ভূমি রক্ষা কমিটির স্মারকলিপি

0
232

হিল ভয়েস, ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, বান্দরবান: সরেজমিন পরিদর্শনে আসা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নিকট জীবনধারণ ও বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন ৪০০ একর জমি রক্ষা, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা এবং কোম্পানি কর্তৃক অবৈধভাবে নেওয়া লিজ বাতিলসহ ৫ দফা দাবি করেছে লামা সরই ইউনিয়নের তিন পাড়াবাসীর পক্ষে লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি।

আজ মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) গ্রামবাসীর পক্ষে স্মারকলিপি পেশ করেন লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রুংধজন ত্রিপুরা। নিম্নে স্মারকলিপিটি হুবহু দেয়া হলো-

বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ-এর নিকট লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক ভূমি বেদখল, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও অন্যায়ের প্রতিবাদে লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে স্মারকলিপি

মহোদয়,
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরের অংশ হিসেবে আমাদের অবস্থা সরেজমিন দেখতে আসার জন্য আমরা বান্দরবান জেলার লামা উপজেলাধীন ৫নং সরই ইউনিয়নের অন্তর্গত ৩০৩ নং ডলুছড়ি মৌজাধীন লাংকম মুরুং পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া ও রেংয়েন মুরুং পাড়াবাসীর পক্ষ থেকে আপনাকে ও কমিশনের অন্যান্য সদস্যদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এর আগে ৫ জানুয়ারি কমিশনের অন্যতম সদস্য কংজরী চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এখানে এসেছিলেন। তার জন্যও আমরা কৃতার্থ।

আমরা উক্ত তিন গ্রামের ম্রো ও ত্রিপুরা সম্প্রদায় সুদীর্ঘকাল ধরে বংশপরম্পরায় এই এলাকায় বসবাস করে আসছি। আমরা জীবিকার জন্য প্রধানত প্রথাগত জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আমাদের সমষ্টিগত মালিকানাধীন এইসব জুম চাষের জমির ওপর এক শ্রেণীর প্রভাবশালী মানুষের লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে এবং তারা অনেক দিন ধরে আমাদের জীবন রক্ষাকারী এই জমিগুলো কেড়ে নিতে ও আমাদের উচ্ছেদ করতে মরিয়া হয়ে বার বার চেষ্টা চালিয়ে আসছে।

এই চেষ্টার অংশ হিসেবে সর্বশেষ গত (২ জানুয়ারি আনুমানিক ভোর-রাত ১:০০টা) লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানি ভাড়াটিয়া বাহিনী নিয়ে রেংয়েন কার্বারী পাড়ায় হামলা চালায়। তারা ৪টি ট্রাক যোগে এসে দা, কুড়াল, লোহার রড, লাঠিসোটা ইত্যাদি নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করে। এ সময় আমরা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হই। আর এই সুযোগে হামলাকারীরা গ্রামের ৩টি বাড়ি আগুনে পুড়ে দেয়, অন্য ৫টি ভাংচুর করে এবং ব্যাপক লুটপাট চালায়। তারা আমাদের পালিত গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী, টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন, জাতীয় আইডি কার্ড ও গৃহস্থালীর সরঞ্জামসহ হাতের কাছে যা পেয়েছে সব নিয়ে যায়। কোম্পানির পক্ষে মো: নুরু, দেলোয়ার হোসেন ও মোহাম্মদ মহসিন এই বর্বরোচিত মধ্যযুগীয় হামলায় নেতৃত্ব দেয়।

জীবন নাশের ভয় থাকায় বিলম্বে হলেও ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পর অবশেষে গত ৭ জানুয়ারি আমরা লামা থানায় এ ব্যাপারে একটি মামলা দায়ের করতে সক্ষম হই। কিন্তু রহস্যজনক কারণে পুলিশ আজও আসামীদের গ্রেফতার করতে পারেনি। বর্তমানে আমরা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে দিন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছি, কারণ আসামীরা গ্রেফতার না হওয়ায় এবং ইতিপূর্বে এ ধরনের হামলার পরও তাদের কোন প্রকার শাস্তি না হওয়ায় তারা আবারও আমাদের ওপর হামলা চালাতে পারে।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ আমাদের জমি জবরদখল করে আমাদেরকে এলাকা থেকে উচ্ছেদ করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এ লক্ষ্যে গত কয়েক মাসে লামা রাবার কোম্পানী আমাদের বংশ পরম্পরা ভোগ দখলীয় জুম ভূমি দখল করে আমাদেরকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে যে সকল অপরাধ করেছে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এখানে পেশ করছি-

১) ৯ এপ্রিল ২০২২ লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রকল্প পরিচালক মো: কামাল উদ্দিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: জহিরুল ইসলামের নেতৃত্বে ২০০ জনের অধিক বহিরাগত শ্রমিক ও সন্ত্রাস ভাড়া করে আমাদের ৪০০ একর জমি জোরপূর্বক দখলের উদ্দেশ্যে আমাদের সৃজন করা বিভিন্ন কৃষিজ (ধান), ফলজ (আম, জাম, ক্যজু বাদাম, কলা, কাঁঠাল, বরই, আনারস) ও বনজ বাগান (ম্যালেরিয়া, একাশি, ও বাঁশ বাগানসহ) বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে সাফ করে দেয়।

২) ২৬ এপ্রিল ২০২২ কোম্পানির লোকজন কর্তন করা উক্ত বাগান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এতে জুমভূমির সাথে বিশাল পরিমাণ প্রাকৃতিক বনও আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়, বন্য প্রাণী ও ঝিড়ির মাছ মারা যায়।

৩) ১৩ জুলাই ২০২২ ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক রুংধজন ত্রিপুরার প্রাণ নাশের উদ্দেশ্যে ডলুছড়ি মৌজা হেডম্যান কার্যালয়ে হামলা চালায়। এতে তিনি গুরুতর আহত হলে প্রথমে লামা এবং পরবর্তীতে অবস্থা আশংকাজনক হলে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে ৫ দিন চিকিৎসাধীন থাকতে বাধ্য হন।

৪) ১১ আগষ্ট ২০২২ ভূমি দস্যুরা রেংয়েন কারবারি পাড়ায় নবনির্মিত অশোক বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালিয়ে বিহার সম্পত্তি ভাংচুর করে এবং ২টি বুদ্ধ মুর্তি লুট করে নিয়ে যায়।

৫) ১৪ আগষ্ট ২০২২ ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক রংধজন ত্রিপুরা, সদস্য সচিব, লাংকম ম্রো, যুগ্ম আহবায়ক, রেংয়েন ম্রো, যুগ্ম আহবায়ক, ফদরাম ত্রিপুরা, সদস্য মথি ত্রিপুরাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করে।

৬) ১ সেপ্টেম্বর ২০২২ আমাদের ক্ষেত থেকে আনুমানিক ২৫ মন মিস্টি কুমড়া লুট করে নিয়ে যায়।

৭) ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ পুনরায় ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি ও গ্রামের কয়েকজনের নামে অন্য একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে।

৮) ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ আমাদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে কোম্পানির লোকজন পানি পানের একমাত্র উৎস ঝিড়িতে বিষ প্রয়োগ করে। এর ফলে একদিকে যেমন আমাদের পানীয় জলের সংকট দেখা দেয়, অন্যদিকে ঝিড়ির মাছ, কাঁকড়া ও চিংড়িসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী মারা যায়।

৯) ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ আমাদের ৮ জনের বিরুদ্ধে লামা রাবার কোম্পানী আরও একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে।

১০) ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ঘটনাস্থল পরিদর্শনের জন্য ঢাকা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিমসহ ৪/৫ জনের একটি প্রতিনিধি দলের আগমন ঠেকাতে কোম্পানি রোহিঙ্গাদের দিয়ে লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করে রাস্তা অবরোধ করে।

১১) ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ কোম্পানির লোকজন আমাদের সৃজিত কলা বাগান কেটে ধ্বংস করে দেয়।

১২) ২৩ অক্টোবর ২০২২ কোম্পানির লোকজন রেংয়েন কার্বারি পাড়ায় পাড়াবাসীর নিজেদের সৃজিত আম, কলা ও অন্যান্য গাছ কেটে দেয়।

লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ এভাবে বার বার অপরাধ করে যাচ্ছে, অথচ তার কোন শাস্তি হচ্ছে না। আমাদের প্রশ্ন, কোম্পানির লোকজন কি আইনের উর্ধ্বে? তারা কি রাষ্ট্র ও সরকারের চাইতেও শক্তিশালী যে দেশের আইন-আদালত তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে না? আমরাও এ দেশের নাগরিক। কিন্তু আমরা আজ পর্যন্ত কোন ন্যায়বিচার পাইনি। আমাদের বিরুদ্ধে একের পর এক অন্যায় করা হচ্ছে, আমাদের জায়গা-জমি কেড়ে নেয়া হচ্ছে। আমাদের নিজ এলাকায় আমরা এখন সংখ্যালঘু। অথচ খুব বেশী দিনের কথা নয়, আমরা এক সময় লামায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলাম। গত কয়েক বছরে আমাদের শত শত একর জুমের জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে। তারপরও ভূমি দস্যুদের জমির ক্ষুধা মেটে না। তারা আমাদের সর্বশেষ অবলম্বন ৪০০ একর জমিও কেড়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

জমি হারাতে হারাতে আমাদের অবস্থা এখন অত্যন্ত সঙ্গীন, কোনমতে জীবন ধারণ করাও কঠিন ও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। যে বিশাল জমি এক সময় আমাদের ছিল, সেই জমি এখন অন্যের দখলে — এই দৃশ্য দেখলেই চোখে জল আসে। আমাদের পুরো অস্তিত্বই আজ চরম হুমকির সম্মুখীন। দেশের সহৃদয় মানুষের সাহায্য সহানুভূতি ছাড়া আমাদের পক্ষে টিকে থাকা আদৌ সম্ভব নয়। কাজেই এ অবস্থায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে মহোদয়ের কাছে আমাদের বিনীত আবেদন-

১) আমাদের জীবনধারণ ও বেঁচে থাকার সর্বশেষ অবলম্বন এই ৪০০ একর জমি রক্ষার জন্য কমিশনের ক্ষমতার মধ্যে যা করা সম্ভব তাই করুন। লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। সরকারের কাছে কোম্পানি কর্তৃক অবৈধভাবে নেওয়া লিজ বাতিলের সুপারিশ করুন।

২) সরকার ও কোম্পানির নিকট থেকে আমাদের ন্যায্য দাবি ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে সাহায্য করুন।

৩) আমাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত হয়রানিমূলক বিভিন্ন মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে সরকার ও লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজকে চাপ দিন।

৪) স্বাভাবিক জীবন যাপন ও আমাদের পরিবার, জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতের অধিকার পেতে সহযোগীতা করুন।

৫) অদূর ভবিষ্যতে বর্তমানে যে সমস্যা বিরাজমান তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় তার ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের নিকট সুপারিশ করুন।

বিনীত,
গ্রামবাসীর পক্ষে
রুংধজন ত্রিপুরা, আহ্বায়ক, লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি।