২৬ বছরেও অপহৃত কল্পনা চাকমার হদিশ নেই, হয়নি বিচার, দোষীরা ঘুরছে অবাধে

0
632
ছবি: কল্পনা চাকমা

হিল ভয়েস, ১২ জুন ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদন:

আজ কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার ২৬ বছর পূর্ণ হলো। তিনি ছিলেন জুম্ম ছাত্রীদের লড়াকু সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক, প্রতিশ্রুতিশীল এক সংগ্রামী নারী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম নারীর উপর সহিংসতাসহ জুম্ম জনগণের উপর শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সাহসী এক কন্ঠস্বর। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন দিনের শুরুতে মধ্যরাতে সেনাবাহিনীর তৎকালীন লেঃ ফেরদৌস এবং ভিডিপি সদস্য নূরুল হক ও সালেহ আহমদের নেতৃত্বে একদল সেনা ও ভিডিপি সদস্য কর্তৃক রাঙ্গামাটি জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউলাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে নির্মমভাবে অপহরণের শিকার হন তিনি। অপহরণকারীরা এসময় কল্পনার দুই বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা (কালীচরণ) ও লাল বিহারী চাকমা (ক্ষুদিরাম)কেও বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে। কল্পনার বড় ভাইয়েরা স্পষ্টতই টর্চের আলোতে অপহরণকারীদের মধ্যে তাদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লেঃ ফেরদৌস (সম্পূর্ণ নাম মো: ফেরদৌস কায়ছার খান) এবং তার পাশে দাঁড়ানো ভিডিপি’র প্লাটুন কম্যান্ডার মো: নূরুল হক ও সদস্য মো: সালেহ আহম্মদকে চিনতে পারেন বলে জানান।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে সেদিনের অপহরণ ঘটনা

কল্পনা অপহরণ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী ছিলেন দুই বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা (কালীচরণ) ও লাল বিহারী চাকমা (ক্ষুদিরাম)। ১৯৯৬ সালের ১১ জুন প্রয়োজনীয় আলাপ ও রাতের খাবার সেরে নিজ বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কল্পনা চাকমা, তার বৃদ্ধা মা, তার দুই বড় ভাই ও তার বড় বৌদি। রাত ১২.০০ টা অতিক্রম করার পরপরই ১২ জুন শুরু। ১২ জুন সকাল হলেই বাংলাদেশের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয় কেতন চাকমার পক্ষে নির্বাচনী দায়িত্বও পালন করছিলেন কল্পনা চাকমা। সারাদিন পরিশ্রম করে সবাই অচিরেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হন। ১২ জুন তারিখের প্রথম প্রহরে রাত আনুমানিক ১:০০ টা হতে ১:৩০ টার মধ্যে শুরু হয় অপহরণকারীদের কর্তৃক ঠান্ডা মাথায় পাশবিক কায়দায় অপহরণ ঘটনার প্রথম পর্ব।

এ প্রসঙ্গে কালিন্দী কুমার চাকমা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সেদিন রাত আনুমানিক ১:০০ টা-১:৩০ টার সময়। উগোলছড়ির কজইছড়ি সেনা ক্যাম্প থেকে একদল সেনা সদস্য এসে বাড়ির লোকদের ডাকতে থাকে। প্রথমে আমরা সাড়া দিইনি। সেই সময় আমাদের দরজাটি ছিল বাঁশের। কিছুক্ষণ পর তারা আমাদের দরজার রশি কেটে দরজা খুলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। এসময় আমি সেখান গেলে তারা আমাকে বাড়িতে কে কে আছি তা জানতে চায়। তখন আমি আমাদের বাড়ির লোকেরা আছি বলে জবাব দিই। তখন সেনা সদস্যরা বলে যে, সবাই বের হও। সবাই বের হয়ে এলে প্রত্যেককে টর্চ জ্বালিয়ে দেখে কার কী নাম তা জিজ্ঞেস করে। তখন আমার মা ছিলেন, আমি ও আমার স্ত্রী, আমার ভাই ক্ষুদিরাম ও বোন কল্পনা চাকমা। এসময় আমার মা চেরাক (কেরোসিন বাতি) জ্বালাতে চাইলে তাকে সেনা সদস্যরা ধমক দেয়। এসময় আমার ভাই ক্ষুদিরামকে আলাদা জায়গায় নিয়ে যায়। তারপর দশ/পনের মিনিট তারা চুপ করে থাকে। এরপর একজন বলে যে, সাহেব ডাকছেন, তার সাথে আমাকে ও কল্পনা চাকমাকে সেখানে যেতে হবে। এরপর আমাদেরকে বাড়ি থেকে কিছু দূরে কূয়োর ঘাটে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি যে, আমার ভাই ক্ষুদিরামকে সেখানে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এরপর আমাদেরকেও বসানো হলো। এসময় আমি সবসময় কল্পনাকে ধরে আছি। এর মধ্যে আমার ভাই ক্ষুদিরামকে সেখান থেকে কোথায় নিয়ে গেছে জানি না। সেখানে বসার তিন মিনিটের মত হবে, তখন হঠাৎ একটি গুলির শব্দ শোনা যায়। তখন আমি ধরেই নিই যে, আমার ভাইকে তারা গুলি করেছে। এসময় যতটুকু শক্তি আছে কল্পনাকে ধরে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একজন সেনা সদস্য আমার বাম হাতটিতে শক্ত করে ধরে থাকে। এক পর্যায়ে আমি কোনোমতে হাতটি মুক্ত করে এক দৌঁড়ে পার্শ্ববর্তী বিলে ঝাঁপ দিই। এসময় সেনা সদস্যরা সঙ্গে সঙ্গে আমাকে গুলি করে। এরপর আমি পানিতে ডুবসাতার দিয়ে বিলের অপর পারে গিয়ে টিলায় উঠি। এসময় কল্পনার ‘ও দা’ বলে একটা ডাক শুনতে পাই। এরপর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। এরপর গ্রামের দক্ষিণ দিকে গিয়ে একটা পরিচিত লোকের বাড়িতে উঠি। তাদেরকে ঘটনার বিষয়ে বলি এবং বলি যে, আমি কোনোমতে পালিয়ে এসেছি। কল্পনা ও ক্ষুদিরামের অবস্থা কী হলো জানি না। গুলি করার শব্দ শুনেছি।

এরপর ঘরের গেরস্থকে নিয়ে আমি গ্রামের কার্বারির কাছে যাই। কার্বারিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ঘটনার বিষয়ে বলি। এরপর আশেপাশের লোকজনের সাথে জানাজানি হলে বেশ কিছু প্রতিবেশী সেখানে আসে। এরপর আমি কার্বারি ও গ্রামবাসীদের সেনাক্যাম্পে যাওয়ার কথা বলি। এতে কয়েকজন দ্বিমত পোষণ করলে সেখানে যাওয়া হয়নি। এরপর কিছুক্ষণের মধ্যে দিনের আলো ফুটে ওঠে। এরপর যেখানে ভাইকে গুলি করা হয়েছিল সেখানে সবাই ভাইকে তন্ন তন্ন করে খোঁজ করলেন। ভাইকে কোথাও পাওয়া গেল না। এক পর্যায়ে ভাইয়ের লুঙ্গী ও গামছা এবং ভিডিপিদের ব্যবহার করা একটি বেন্ডলি (গুলি রাখার জ্যাকেট) পাওয়া গেল। এর মধ্যে গোটা গ্রামবাসী সেখানে উপস্থিত হয়। এর কিছুক্ষণ ক্ষুদিরাম ফিরে আসে। ক্ষুদিরাম ফিরে আসলে তার অনুসন্ধানকারীরাও ফিরে আসে।’

কালিন্দী কুমার চাকমা আরো জানান, ‘সেনা সদস্যরা আমাদেরকে যখন বাড়ি থেকে বের করে আনে, তখন মুখমন্ডলে টর্চ মারার সময় সেনাবাহিনীর একজন ও ভিডিপি সদস্য দুইজন চিনতে পারা যায়। তারা মোট ১২-১৩ জন লোক হতে পারে। ভিডিপি সদস্য যারা তারা আমাদের গ্রামেরই পরিচিত। আর সেনা সদস্য যাকে চেনা গেছে সে এখানে বিভিন্ন সময় ছেলেদের সাথে খেলা করে এবং পেট্রোলিং-এ আসে সেই হিসেবে পরিচিত। ভিডিপি সদস্যরা হল একজন নূরুল হক সে ভিডিপি’র পিসি (প্লাটুন কম্যান্ডার) ছিল, আরেকজন সালেহ আহমদ। আর সেনা সদস্যটি হল ১৭ ই বেঙ্গল রেজিমেন্টের লে: ফেরদৌস।’

সে রাতের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কালীচরণ চাকমা বলেন, ‘আমি বাইরে গেলাম। দেখলাম বেশ কয়েকজন সেনাবাহিনী ও ভিডিপি’র সদস্য। দেখি যে সেখানে লে: ফেরদৌস রয়েছে, তার পাশে ভিডিপি সদস্যরা। তারা আমার দিকে টর্চ মারে, সেই টর্চের আলোই আমি তাদের চেহারা দেখি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে এক হাত পরিমাণ বিলের পানিতে নামানো হয়। সেনা সদস্যটি তখনও আমাকে ধরে রয়েছে। এরপর আমার হাতে ধরা সেনা সদস্যটি বলে যে, আরও পানিতে নামো। আমি আরো পানিতে নামলাম, সেনা সদস্যটিও আমাকে ধরে নামতে থাকে। এমন সময় পেছন থেকে শুনতে পাই, একজন কানে কানে বলছে, তাড়াতাড়ি গুলি কর..তাড়াতাড়ি গুলি কর..। সেটা শুনে আমি জোর করে সেনা সদস্যকে ছেড়ে যেতে চাইলে সেনা সদস্যটি আরও জোর করে ধরে রাখার চেষ্টা করে। এতে কয়েক মিনিট ধস্তাধস্তি চলে। তখন আমি হাতটা খুলে চোখের বাঁধন খুলে ফেলি এবং সেনা সদস্যটিকে একটি জোরে ঘুষি দিই। সাথে সাথে গুলির শব্দ শুনি এবং আলোর ঝলক দেখতে পাই। সাথে সাথে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হই। উলঙ্গ অবস্থায় বিলের অপর পারে যাই।’

থানায় অভিযোগ ও মামলা

১২ জুন ভোর হওয়ার সাথে সাথে সর্বত্র কল্পনার খোঁজখবর নিয়েও কোন হদিশ না পাওয়ায় কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা স্থানীয় মুরুব্বি সম্রাটসুর চাকমা ও ইউপি চেয়ারম্যান দীপ্তিমান চাকমাকে নিয়ে বাঘাইছড়ির টিএনওর (বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) নিকট বিষয়টি অবহিত করেন। টিএনও কালিন্দী কুমার চাকমার বিবরণ রেকর্ডভুক্ত করে বাঘাইছড়ি থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট পাঠিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর কালিন্দী কুমার চাকমাকে থানায় পাঠানো হয়। থানায়ও পুলিশের নিকট ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন কালিন্দী কুমার চাকমা। সারাদিন কালিন্দী কুমার চাকমাকে থানায় রাখা হয়। বিকেলে রাঙ্গামাটি থেকে এডিসি, ম্যাজিস্ট্রেট রেস্ট হাউজে আসলে তাদের কাছে গিয়েও বিস্তারিত তুলে ধরেন কালিন্দী কুমার চাকমা। কালিন্দী কুমার চাকমা তাদের সকলের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন যে, অপহরণকারীদের মধ্যে তারা লে: ফেরদৌস, ভিডিপি সদস্য নূরুল হক ও সালেহ আহমদকে পরিষ্কারভাবে চিনতে পেরেছেন।

বাঘাইছড়ি টিএনওর কাছে বর্ণিত বিবরণই বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি অভিযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং থানায় তা মামলা নং ২, তারিখ ১২/০৬/৯৬ ধারা ৩৬৪ দ: বি: হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এরপর ১৭ জানুয়ারি ১৯৯৭ তারিখে মামলাটি জেলা গোয়েন্দা শাখা, রাঙ্গামাটি’র নিকট হস্তান্তর করা হয়। ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ তারিখ হতে মামলার তদন্ত কার্যক্রম পুনরায় বাঘাইছড়ি থানায় স্থানান্তর করা হয়।

অপহরণ ঘটনার প্রায় ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১ মে ঘটনার বিষয়ে পুলিশের চুড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট পেশ করা হয়, যাতে অভিযুক্ত ও প্রকৃত দোষীদের সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আদালতে উক্ত চুড়ান্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন দাখিল করেন। এরপর ২ সেপ্টেম্বর ২০১০ আদালত বাদীর দাখিলকৃত নারাজির উপর শুনানী শেষে মামলার বিষয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য পুনরায় সিআইডি পুলিশকে নির্দেশ দেন। এর দুই বছর পর গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ জনৈক তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক চট্টগ্রাম জোন সিআইডির পক্ষ থেকে চুড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়। উক্ত সিআইডি তদন্ত রিপোর্টেও অপহৃত কল্পনার কোন হদিশ না পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয় এবং অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তা লেঃ ফেরদৌসসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আবারও উক্ত সিআইডি তদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখান করেন এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবী জানান। পরে গত ২০ জুলাই ২০১৪ রাঙ্গামাটির তৎকালীন পুলিশ সুপার আমেনা বেগম কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার উপর রাঙ্গামাটির চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ‘তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন’ দাখিল করেন। নামে এটি ‘তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন’ হলেও বাস্তবে তদন্তে কোন কিছুই অগ্রগতি মেলেনি।

এর দুই বছর পর ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ মামলার ৩৯তম তদন্ত কর্মকর্তা রাঙ্গামাটির তৎকালীন পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান তাঁর চূড়ান্ত রিপোর্ট রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কগনিজেন্স আদালতে দাখিল করেন। তাঁর রিপোর্টেও পূর্বের রিপোর্টের বক্তব্যগুলো চর্বিতচর্বন করে প্রকৃত পক্ষে দোষীদের ও অভিযুক্তদের আড়াল করার অপচেষ্টা চালানো হয় এবং ‘…সার্বিক তদন্তে লেঃ ফেরদৌস, ভিডিপি নূরুল হক ও পি.সি সালেহ আহমেদের উক্ত ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি’ বলে দাবি করা হয়। এমনকি রিপোর্টে ‘কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছে মর্মে প্রাথমিকভাবে সত্য বলিয়া প্রমাণিত হয়’ বলে স্বীকার করা হলেও ‘দীর্ঘ ২০ বৎসর ৩৯ জন তদন্তকারী অফিসারের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও কল্পনা চাকমাকে অদ্যাবধি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই এবং অদূর ভবিষ্যতেও সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ’ বলে দায়িত্বহীন ও হতাশাব্যঞ্জক বক্তব্য প্রদান করা হয়। পাশাপাশি ‘ভবিষ্যতে কল্পনা চাকমা সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া গেলে বা তাহাকে উদ্ধার করা সম্ভব হইলে যথানিয়মে মামলাটির তদন্ত পুনরুজ্জীবিত করা হইবে’ বলে প্রকারান্তরে মামলার কার্যক্রম বা তদন্ত কাজ বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়।

পরে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা উক্ত ৩৯তম তদন্তকারী কর্মকর্তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন এবং মামলার কার্যক্রম বন্ধ রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে আদালতে নারাজি আবেদন দাখিল করেছেন এবং উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে যথাযথ বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান। এরপর থেকে আদালত একের পর এক শুনানির দিন ধার্য করলেও পুলিশ এ বিষয়ে বার বার প্রতিবেদন দাখিলে অপারগতা প্রকাশ করে সময় চাইতে থাকেন।

সর্বশেষ মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে, কালিন্দী কুমার চাকমা বলেন, মামলাটি এখন সময় চাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। মাঝখানে ডিএনএ পরীক্ষা করতে চায়। এসপি’র তদন্তের পর তিনি ডিএনএ পরীক্ষার সুপারিশ করেন। কিন্তু আমাদের পরিবারের সদস্যরা রাজি হইনি। আমরা বলি, আগে কল্পনার হদিশ পেয়েছেন কিনা বলুন, যদি পান, তবেই আমরা ডিএনএ পরীক্ষা করতে রাজি হব। তার আগে আমরা ডিএনএ পরীক্ষা করতে রাজি নই।

অভিযুক্ত আসামীরা কোথায় এবং প্রশাসনের ভূমিকা কী?

কল্পনা চাকমার দুই বড় ভাই শুরু থেকে অপহরণকারীদের চিনতে পারার কথা বললেও সরকার ও প্রশাসন তাদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে শুরু থেকে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এমনকি টিএনও, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, এডিসি, ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট চিহ্নিত আসামীদের কথা উল্লেখ করা হলেও মামলায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলে জানান কালিন্দী কুমার চাকমা। এছাড়া দেশে-বিদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, মানবাধিকার সংগঠন অচিরেই অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে ঘটনার যথাযথ বিচারের দাবি জানালেও সরকার ও প্রশাসন অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

এ প্রসঙ্গে কালিন্দী কুমার চাকমা বলেন, ‘টিএনও ও থানায় আমার যে বিবরণ সেটাই মামলা হিসেবে গৃহীত হয়। কিন্তু আমার বিবরণে আমি যে, পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত লে: ফেরদৌস, ভিডিপি সদস্য নূরুল হক ও সালেহ আহমদের কথা উল্লেখ করেছি, মামলায় তাদের নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এই অভিযুক্তদের কাউকে আজ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি। বর্তমানে মামলাটিও নামে মাত্র মামলা হিসেবে বিচারাধীন রয়েছে। আর লে: ফেরদৌসকে তো এরপর থেকে আর দেখা যায়নি। কিন্তু নূরুল হক ও সালেহ আহমদ- তারা এখন এখানে অবাধে ঘোরাফেরা করছে, গ্রামে আসছে। সেই ঘটনার পর অনেক মানবাধিকার কর্মী হতে অনেক সাংবাদিক এসেছেন, জিওসিও এসেছেন, তাদেরকেও আমি ঘটনার বিষয়ে বলেছি। আসামীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। কাজেই আমি এখনো পর্যন্ত মামলার সুবিচার দেখতে পাইনি।’

আরও চার জুম্ম তরুণ-ছাত্রকে হত্যা

কল্পনা অপহরণ ঘটনার প্রতিবাদে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে ২৭ জুন ১৯৯৬ বাঘাইছড়িসহ রাঙ্গামাটি জেলায় অর্ধদিবস সড়ক অবরোধ কর্মসূচি আয়োজন করা হয়। অবরোধ চলাকালে তৎকালীন বাঘাইছড়ি সেনা কর্তৃপক্ষের মদদে স্থানীয় ভিডিপি ও সেটেলারদের সাম্প্রদায়িক হামলায় বাবুপাড়া ও মুসলিম ব্লক এলাকায় গুলি করে রূপন চাকমাকে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে সুকেশ চাকমা, মনোতোষ চাকমা ও সমর বিজয় চাকমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বলাবাহুল্য, সেই হত্যাকান্ডেরও কোনো বিচার হয়নি এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হয়নি।

রাষ্ট্র, সরকার ও প্রশাসন দায় এড়াতে পারে না

শুধু কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা নয়, পার্বত্য সমস্যার সমাধান এবং জুম্মসহ পার্বত্য অধিবাসীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও চুক্তিটি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় বিশেষত সেটেলার বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা বহু জুম্ম নারী যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতার স্বীকার হয়েছেন। কল্পনা চাকমা অপহরণ এবং রূপন চাকমা, সুকেশ চাকমা, মনোতোষ চাকমা ও সমর বিজয় চাকমা হত্যাকান্ডের দায় রাষ্ট্র, বর্তমান সরকার, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও নিরাপত্তা বাহিনী কেউ এর দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারে না। দায়সারা বক্তব্য ও ভূমিকা গ্রহণ করে এমন বর্বরোচিত ও জঘন্য মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার ন্যায়বিচার ব্যর্থ হতে পারে না। দোষীদের চিহ্নিত করে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। রাষ্ট্র, সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই তা নিশ্চিত করতে হবে।