১০ই নভেম্বর ও আমাদের অঙ্গীকার

0
642

সত্যবীর দেওয়ান

জুম্ম জাতির সবরেচয়ে হৃদয় বিদারক কলঙ্কময়, ঘৃণ্য, বিশ্বাসঘাতকতামূলক, শোকাবহ অবিস্মরণীয় একটি দিন ১০ই নভেম্বর। আজ থেকে ৩৮ বছর আগে এই দিনের ঘন মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ও বৃষ্টিভেঝা রাতে অগণতান্ত্রিক, অমানবিক, বিবেকহীন একদল বিভেদপন্থী জাতীয় কুলাঙ্গারদের অতর্কিত এক সশস্ত্র আক্রমনে জুম্ম জাতির জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত মহামতি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তাঁর আটজন সহযোযাদ্ধাসহ শহীদ হন। তাই এই দিনটি জুম্ম জাতির জন্য একদিকে শোক ও ঘৃণার, অপরদিকে শোককে শক্তিতে পরিণত করার আমাদের আত্মসমীক্ষারও দিন। এই দিনটিকে শুধু আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে শহীদ বেদীতে পুষ্পার্ঘ অর্পণ এবং স্মরণ সভা করে উদযাপন করাই যথেষ্ট নয়। এই দিনটি একদিকে জুম্ম জাতির জাতীয় ইতিহাসের কলঙ্কময় বিশ্বাসঘাতকতার একটি দিন, অন্যদিকে জুম্ম জনগণের মধ্যে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম পরিচালনার শপথ গ্রহণ করারও দিন।

একই সাথে এই দিনটি আমাদের প্রত্যেকের আত্মসমীক্ষার ক্ষেত্রে করণীয় নির্ধারণ করারও দিন। আমরা কে কতটুকু বিপ্লবী আদর্শে উজ্জীবিত, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রদর্শিত বৈপ্লবিক রাজনৈতিক লাইন অনুসরণ করছি কিনা এটা আন্তরিকভাবে বিচার বিশ্লেষণ তথা আত্মজিজ্ঞাসা করা একান্ত প্রয়োজন। তাঁর একটি উদ্ধৃতিতে তিনি যেমনটি বলেছেন- “ক্ষমাগুণ, শিক্ষা গ্রহণের গুণ, পরিবর্তন হওয়ার গুণ – এই তিনটি গুণের অধিকারী নাহলে বিপ্লবী হওয়া যায়না।” আন্দোলনের বহুমুখী কাজ একজন কর্মীকে করতে হয়। কাজ করতে গিয়ে অজ্ঞানতাবশত অনেক ভুল হয়ে থাকে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ পর্যন্ত করতে পারেন। তাই কেউ অজ্ঞতাবশত ভুল কিংবা অপরাধ করে থাকলে তাকে একটা ভুল বা অপরাধের জন্য একেবারে কঠোরভাবে ভৎসনা করা এবং একেবারে বহিষ্কার করে দূরে ঠেলে দেয়া কর্মী নীতির কোন প্রকারেই সঠিক পদ্ধতি হতে পারে না। এই জন্য শহীদ লারমার প্রদর্শিত ক্ষমাগুণ আমাদের প্রত্যেকের অর্জন করা একান্ত কর্তব্য। একারণে তিনি বলেছেন- “অপরাধ বা ভুল স্বীকারের মধ্যেও বীরত্ব বিদ্যমান, ক্ষমার মধ্যেও মহত্ব ক্রিয়াশীল।” কিন্তু বিভেদপন্থীরা সেরূপ কোন কিছুই করেনি বরং প্রতিক্রিয়া এমনভাবে করেছিল যা সম্পূর্ণ প্রতিবিপ্লবীতে পরিণত হয়ে নিজেদের আত্ম-বিলোপ ঘটিয়েছিল।

আর বিপ্লবী এম এন লারমা যে শিক্ষাগুণের কথা বলেছেন, তাও আমরা কে কতটুকু নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পেরেছি, তা আত্মজিজ্ঞাসা করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন বয়স নেই। যে কোন বয়সেই মানুষ প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। এখানে কেবল প্রয়োজন আগ্রহ। তাছাড়া মানুষের শিক্ষার কোন শেষ নেই। আমরা সাধারণত দুইভাবে শিক্ষাগ্রহণ করে থাকি। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ- এই উভয় উপায়ে শিক্ষাগ্রহণ বা যেকোন বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করা যায়। এক্ষেত্রে প্রধানত ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও আগ্রহটাই শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্যতম ভিত্তি। এইগুণ না থাকলে বা অর্জন করতে না পালে তাকে মহামতি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আদর্শের অনুসারী বলা যাবেনা।

শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধান শত্রু হচ্ছে- আত্মসন্তোষ। তাই যিনি শিক্ষার উচ্চশিখরে গিয়ে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন তাই নিয়ে সন্তুষ্ট হলে তবে তার শিক্ষা গ্রহণের গুণের বিকাশ রুদ্ধ হতে বাধ্য। সাথে সাথে তার বৈপ্লবিক রাজনৈতিক গুণের বিকাশও রুদ্ধ হবেই। তাই মহামতি লারমার শিক্ষা গ্রহণের গুণের অধিকারী হতে হলে যেকোন সংগ্রামী বন্ধুকে অবশ্যই শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বদা অতৃপ্ত থাকতে হবে, অজানাকে জানার জন্য, অচেনাকে চেনার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এক্ষেত্রে যা কিছু প্রয়োজন, সেসব করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। তাই আমাদের বর্তমান উদীয়মান প্রজন্ম মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার শিক্ষা গ্রহণের গুণ অর্জনে আমরা কতটুকু মনযোগ দিচ্ছি তা আমাদের আত্ম-জিজ্ঞাসার দাবি রাখে। তাছাড়া এটা অবিদিত সত্য যে, শিক্ষা গ্রহণের গুণ ব্যতিত একজন লোকের পক্ষে বিনয়ী হওয়া যায়না। অথচ এই বিনয়ই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায় প্রগতির পথে। পক্ষান্তরে অহংকার মানুষকে পিছিয়ে দেয়। বিনয়ী মনোভাব মানুষকে ভ্রান্ত পথ হতে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে পারে এবং আত্মগঠনের জন্য পরিবর্তিত হওয়ার গুণে ধাবিত করে।

আর ‘পরিবর্তন হওয়ার গুণ’ অর্জন করতে পারলে একজন প্রতিক্রিয়াশীল লোকও বিপ্লবী কর্মীতে রূপান্তর হতে পারে। আমাদের জুম্ম সমাজ হচ্ছে সামন্ত চিন্তাধারায় আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। সেই সামন্তীয় সমাজ থেকে আমরা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বিপ্লবীসংগ্রামে যোগদান করছি। তাই আমরা সমাজ থেকে সেই সামন্ত চিন্তাধারার প্রতিক্রিয়াশীল দিকগুলো সঙ্গে করে নিয়ে আসি। শিক্ষা গ্রহণ তথা অধ্যয়ন-অনুশীলন-বাস্তবায়নের মাধ্যমে একজন সংগ্রামী বন্ধু যদি সমাজের সেই সামন্তীয় প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারাগুলো ঝেড়ে ফেলতে পারে তাহলে তিনি নিজেকে নিজে সাচ্চা বিপ্লবীতে রূপান্তর ঘটাতে পারে। এজন্য একজন বিপ্লবী কর্মীর জন্য পরিবর্তন হওয়ার গুণ অবশ্যই অর্জন করতে হয়।

আর পরিবর্তিত হওয়ার গুণ অর্জন করতে পারলে একজন খারাপ লোকও ভালো লোকে পরিবর্তন হতে পারে, একজন সাধারণ কর্মীও বিপ্লবী কর্মীগুণে রূপান্তরিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ আমার সহপাঠি বন্ধু শহীদ আশুতোষ তালুকদার এক সময়ে শম্ভুগুলো (ওরফে সুশান্ত দেওয়ান)-এর ডাকাত দলে যোগ দিয়েছিলেন। তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠিত হয়েছিল। পাশাপাশি শান্তিবাহিনীও সংগঠিত হয়েছিল। সেসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ডাকাত দলগুলোর উপদ্রবও দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। জনগণের জানমালের নিরাপত্তাহীনতার এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল।

পাকবাহিনীর রেখে যাওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদ রাজাকার, মুজাহিদ, সিএএফ সদস্যরা মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পন করতে চেয়েছিল। কিন্তু কন্ঠকুমার ত্রিপুরার নেতৃত্বে ১৫ জনের একদল রাজাকার যখন মাটিরাঙ্গায় আসা মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পন করেছিল, তখন মুক্তিবাহিনী তাদের হাতিয়ার ও গোলাবারুদগুলো জমা নেয়ার পর তাদের সবাইকে একলাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। এরপর বাকী রাজাকার, মুজাহিদ, সিএএফ জোয়ানরা মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ না করে অনেকে পার্বত্য অঞ্চলের গহিন অরন্যে আশ্রয় নিয়েছিল।তারা অনেকেই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ডাকাত দলে পরিণত হয়েছিল। আবার অনেকে দেশান্তরিত হয়েছিল। শম্ভুগুলো দেওয়ানের পাশাপাশি বাদীহুলো, পুকগুলো, পরানধন, পোড়া ঠেঙাসহ আরও বিভিন্ন নামের প্রায় ২০/২৫ টি ডাকাতের দল পার্বত্য এলাকায় সৃষ্টি হয়েছিল। তারা নিরীহ জনগণের উপর একের পর এক ডাকাতি করতে শুরু করে। এতে প্রতিটি গ্রামের মানুষ জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাহীনতার মাঝে কালাতিপাত করতে থাকে।

এভাবে সমগ্র পার্বত্য এলাকায় এক অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকলে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পাকবাহিনীর ফেলে যাওয়া হাতিয়ার গোলাবারুদ সংগ্রহ করা হয়। কতিপয় অবসরপ্রাপ্ত ইপিআর-এর পাহাড়ী কমান্ডারের মাধ্যমে সদ্য গঠিত শান্তিবাহিনী সদস্যদের প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হলো। সাধারণ জনগণের জানমাল রক্ষার জন্যশান্তিবাহিনী সদস্যরা ডাকাত দলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান পরিচালিত করে। যারা আত্মসমর্পন করেছিল তাদের সংশোধনের ব্যবস্থা করা হয়। আর যারা আত্মসমর্পন করেনি, তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে তাদেরকে নির্মূল করা হয় এবং জনগণের বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।

ডাকাত দল হতে আত্মসমর্পন করা আমার সহপাঠি বন্ধু আশুতোষ তালুকদারকে আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় তারই আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে অবস্থানের সুযোগ দেয়া হয় আর তার সাথে সপ্তাহে অন্তত একবার আলাপ-আলোচনা করে জনসংহতি সমিতির আওতাধীন শান্তিবাহিনীতে যোগদানের আহ্বান করা হয়। অবশেষে তিনি জনসংহতি সমিতির নীতি আদর্শে উদ্বুদ শান্তিবাহিনীতে যোগদান করেন এবং সবশেষে শান্তিবাহিনীর সহকারী কোম্পানী কমান্ডারের পদে উন্নীত হন। পার্বত্য চুক্তির পরেও তিনি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অবশেষে তিনি বিভেদপন্থী চুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফ-এর এক সশস্ত্র আক্রমণে শহীদ হন। শহীদ আশুতোষ তালুকদার দুস্যুবৃত্তি জীবন পরিত্যাগ করে নিজেকে পরিবর্তন করে একজন বিপ্লবীতে পরিণত করেছেন। তিনি জুম্ম জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। তেমনি আমাদের অনেক নেতা-কর্মী এখনও রয়েছেন যারা নিজেদের ব্যক্তিগত ও বৈষয়িক জীবন পরিত্যাগ করে বিপ্লবী জীবন বরন করে জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

ক্ষমাগুণ, শিক্ষা গ্রহণের গুণ এবং পরিবর্তন হওয়ার গুণের অধিকারী হয়ে যে উদ্দেশ্য-লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, সেই উদ্দেশ্য-লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন না করা অবধি দৃঢ়তার সাথে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃপ্ত শপথই হোক আজকের ১০ই নভেম্বরের অঙ্গীকার। জয় আমাদের হবেই। ১০ই নভেম্বর অমর হোক, মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার চিন্তাধারা দীর্ঘজীবী হোক। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী জানুক অন্যায়ভাবে জুম্ম জনগণকে তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে, জুম্মদের ধর্মান্তরিত করে,পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে, ফ্যাসীবাদী কায়দায় দমন-পীড়ন করে, সামরিক অভিযান চালিয়ে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রাধিকার আন্দোলনকে দমন করা যাবেনা। জুম্ম জনগণের মুক্তি সংগ্রাম দীর্ঘজীবী হোক।