সজীব চাকমা
স্থানীয় জুম্ম জনগণের অধিকার, স্বার্থ ও কল্যাণকে সম্পূর্ণভাবে পদদলিত করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদসহ জনমতকে উপেক্ষা করে, সর্বোপরি পার্বত্য চুক্তি ও আঞ্চলিক পরিষদ আইনকে লংঘন করে সরকার ও প্রশাসন একতরফাভাবে সাজেক-কমলাক সীমান্ত সড়ক ও থেগামুখ স্থলবন্দর নির্মাণ করে চলেছে। সীমান্ত সুরক্ষা ও উন্নয়নের কথা বলে স্থানীয় জুম্ম জনগণের সম্ভাব্য ব্যাপক ক্ষতিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সরকার এই প্রকল্প বেশ তড়িঘড়ি করে বাস্তবায়ন করে চলেছে। কিংবা বিপরীতভাবে বলা যায়, কার্যত জুম্মদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জনমিতিগতভাবে একটা বিরাট আঘাত হানার হীন উদ্দেশ্য নিয়েই সরকার এমন একগুয়েভাবে এই কাজ হাতে নিয়েছে।
তারই অংশ হিসেবে সর্বসম্প্রতি গত ১০ মার্চ ২০২০ সকাল ১১:০০ টার দিকে সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোঃ আসাদুজ্জামান খান কামাল হেলিকপ্টারযোগে রাঙ্গামাটি জেলার সীমান্তবর্তী সাজেকে পৌঁছেন। সাজেকে সেনাবাহিনী ও বিজিবি’র বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে তিনি দুপুর ২:০০ টার দিকে বরকলে যান। তাঁর এই সফরের কী কী উদ্দেশ্য তা সম্পূর্ণভাবে জানা না গেলেও, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে জানা গেছে যে, এই সফরের সময় তিনি তিন পার্বত্য জেলার সড়ক প্রকল্পের একাংশ সাজেক-কমলাক সড়ক এবং থেগামুখ স্থলবন্দর ও বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু বাস্তবায়নের কাজ পরিদর্শন করেন।
 লক্ষণীয় যে, এহেন স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প কার্যক্রম পরিদর্শনের সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে স্থানীয় বাসিন্দা কোন মুরুব্বী থেকে শুরু করে আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ, সংশ্লিষ্ট সার্কেল, শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন বিষয়ক টাস্কফোর্স ইত্যাদি কোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের, এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কোন প্রতিনিধিকে দেখা যায়নি। জানা গেছে, এসময় তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাভেদ পাটোয়ারী, বিজিবি’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোঃ সাফিনুল ইসলাম, আনসার ব্যাটালিয়নের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল কাজী শরীফ কায়কোবাদ, র্যাবের মহাপরিচালক মোঃ বেনজির আহমেদসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় ১৯ জন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
লক্ষণীয় যে, এহেন স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প কার্যক্রম পরিদর্শনের সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে স্থানীয় বাসিন্দা কোন মুরুব্বী থেকে শুরু করে আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ, সংশ্লিষ্ট সার্কেল, শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন বিষয়ক টাস্কফোর্স ইত্যাদি কোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের, এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কোন প্রতিনিধিকে দেখা যায়নি। জানা গেছে, এসময় তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাভেদ পাটোয়ারী, বিজিবি’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোঃ সাফিনুল ইসলাম, আনসার ব্যাটালিয়নের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল কাজী শরীফ কায়কোবাদ, র্যাবের মহাপরিচালক মোঃ বেনজির আহমেদসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় ১৯ জন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
বলাবাহুল্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর টিমের গঠন ও প্রকৃতি দেখে বিভিন্ন ধারণা অনায়াসে আসতেই পারে। প্রথমত, বিভিন্ন বাহিনীর সর্বোচ্চ বা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে তিনি কি আদতে সামরিক উদ্দেশ্যে কোন সফর বা শোডাউন করতে এসেছেন। নাকি দ্বিতীয়ত, জানা কর্মসূচি ছাড়াও আরও ভিন্ন এজেন্ডা রয়েছে, যে কারণে স্থানীয় কোন কর্তৃপক্ষকে এতে সম্পৃক্ত করা হয়নি। তৃতীয়ত, এটা কি একান্তই সরকারের ও সামরিক বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত গণবিচ্ছিন্ন একটি প্রকল্প। তবে এটা সুস্পষ্ট যে, এতে জনগণের বা এলাকাবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখা যায়নি। অথবা এজন্য সরকার বা সেনাবাহিনীও স্থানীয় জনগণের কোন অংশগ্রহণ বা সমর্থনকে গ্রাহ্যই করেনি। তবে শুরু থেকে যে জনগণ এই উদ্যোগটির ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ বা বিরোধীতা করে আসছে তা বলাই বাহুল্য।
উল্লেখ্য, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে নদীর সীমানা নির্ধারণ, নাব্যতা বৃদ্ধি এবং স্থলবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণের উদ্দেশ্যে গত ২৯ জানুয়ারি ২০১৭ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রীর সভাপতিত্বে এক সভা আয়োজন করে। সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের দুইজন সদস্যসহ পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সার্কেলের তিন সার্কেল চীফ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব অশোক মাধব রায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. কামালউদ্দিন তালুকদার, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্তী ও বিআইডাব্লিউটি-এর চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মেল হকসহ নৌপরিবহন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
সভায় পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনজেলায় তিনটি স্থলবন্দর, যথা- খাগড়াছড়ির রামগড়ের সঙ্গে দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম, বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের সঙ্গে মিয়ানমারের মংডু এবং রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার ঠেগামুখের সঙ্গে ভারতের মিজোরামের কোয়ার্পুচ্ছয়ার মধ্যে স্থলবন্দর নির্মাণের প্রস্তাব তুলে ধরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ থেকে খাগড়াছড়ির রামগড়ের সঙ্গে দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম এবং বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের সঙ্গে মিয়ানমারের মংডু-এর মধ্যে স্থলবন্দর নির্মাণের পক্ষে অনুকূল মত দেয়া হয়। তবে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ঠেগামুখ-কোয়ার্পুচ্ছয়া স্থলবন্দর উন্নয়ন এবং ঠেগামুখ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ রাখার লিখিত সুপারিশ পেশ করা হয়। এতে এই মর্মে আঞ্চলিক পরিষদ মতামত পেশ করে যে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তা সুফল আনয়নের পরিবর্তে কুফলই বেশী পরিমাণে আনয়ন করতে পারেÑ তা নি:সন্দেহে বলা যায়।
ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাঙ্কের কারিগরী সহযোগিতায় স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক এক সমীক্ষা চালানো হয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু এতে শতাধিক পরামর্শসভা আয়োজন করার তথ্য দেয়া হলেও এসব পরামর্শসভা সম্পর্কে স্থানীয় জনগণ, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ-হেডম্যান-কার্বারী, পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, ২৯৯ আসনের সংসদ সদস্য সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন না বলে জানা যায়। জনগণ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিও বিদ্যমান বাস্তবতায় থেগামুখ স্থলবন্দরসহ সংশ্লিষ্ট সড়ক নির্মাণের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে এবং এলাকার সামগ্রিক স্বার্থে এই উদ্যোগ বন্ধ রাখার দাবি জানায়। জনসংহতি সমিতি এটিকে ‘স্বাধীন ও পূর্বাবহিত পূর্বক সম্মতি’র অধিকার সংক্রান্ত মূলনীতির পরিপন্থী এবং ‘দ্বিতীয় কাপ্তাই বাঁধ’ বলে অভিহিত করে।
জনসংহতি সমিতি এই মত ব্যক্ত করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বিশেষ শাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের উদ্যোগ পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যাস্বল্প জনগোষ্ঠীসহ পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। এই সময় জনসংহতি সমিতি নিম্নরূপ মতামত তুলে ধরে-
(ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, বিশেষ শাসনব্যবস্থার যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ কার্যকরকরণ, পাহাড়ি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ তথা স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান না হওয়া পর্যন্ত কেবলমাত্র বিদ্যমান জলপথে অর্থাৎ ঠেগামুখ থেকে কর্ণফুলী নদীপথে রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা উন্নয়ন করা এবং ঠেগামুখ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সংযোগ সড়ক পথ নির্মাণ বন্ধ রাখা।
(খ) বাংলাদেশ রিজিওনাল কানেক্টিভিটি প্রজেক্ট সম্পর্কে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, রাংগামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ ও মৌজার হেডম্যান, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ও উপজেলার জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজের নিকট হতে যথাযথ পদ্ধতিতে মতামত গ্রহণ করা।
কিন্তু তারপরও সরকার একতরফাভাবে এই উদ্যোগ অব্যাহত রাখে। তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ও প্রশাসন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের রুইলুই হতে বড় কমলাক এলাকা পর্যন্ত একটি ট্রানজিট সড়ক নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করে চলেছে। যার দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৫০ কিলোমিটার বলে জানা গেছে। সড়কটি সিজকছড়া, দাড়িপাড়া, বলপিয়ে, উপরের ছয়নালছড়া, নীচের ছয়নালছড়া, বড় কমলাক হয়ে সাজেক তীর পর্যন্ত যাবে। এই সড়কটি ভারতের মিজোরাম রাজ্যের মামিট জেলাধীন মার বাজার থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত সড়কটির সাথে যুক্ত হবে।
খবর নিয়ে জানা গেছে, রুইলুই হতে বড় কমলাক এলাকা পর্যন্ত এই সড়ক নির্মাণের ফলে প্রায় ৩০০ পরিবার অধ্যুষিত বড় কমলাক, ছয়নালছড়া ও সিজকছড়া সহ অন্তত পাঁচটি গ্রামের জুম্ম গ্রামবাসী তাদের ভূমি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। উল্লেখ্য যে, সাজেক অধিবাসীদের অন্তত ৯০% ভাগই অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু পরিবার, যারা ১৯৭০ হতে ৯০ দশকের মধ্যে অস্থিতিশীলতার সময় তাদের নিজেদের গ্রাম ও বাড়িঘর হতে উচ্ছেদের শিকার হয়েছিলেন। অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পরিবারসমূহকে যেখান থেকে তারা উচ্ছেদ হয়েছিলেন তাদের সেই ভূমিতে পুনর্বাসনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে বিধান থাকা সত্ত্বেও, চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিগত ২২ বছরেও সরকার তাদেরকে পুনর্বাসন করেনি। জানা গেছে, এই সড়ক নির্মাণকালে ইতিমধ্যে রাস্তার মধ্যে পড়ে অনেক জুম্ম গ্রামবাসীর জায়গা-জমি ও বাগান-বাগিচার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। হাজার হাজার ফলজ ও বনজ গাছ এবং বিভিন্ন ফসলি ক্ষেত ক্ষতি করা হয়েছে। সেনা-পুলিশ-বিজিবি-র্যাব ইত্যাদি বাহিনী দিয়েই জোরজবরদস্তিমূলকভাবে এসব তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
বস্তুত বন্দুকের নল দিয়েই সরকার এসব জুম্মস্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। আর এতে সরকারী বাহিনীসহ দলের কায়েমী স্বার্থবাদীদের বিরাট অংকের লাভের বা আখের গোছানোর সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে। তিন পার্বত্য জেলায়ই সেনাবাহিনী, বিজিবি ইত্যাদি, কখনো তাদের প্রশ্রয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়েই উন্নয়নের নামে বিলাসবহুল পর্যটন ব্যবসা, সড়ক নির্মাণসহ সকল উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত ও তদারকি হচ্ছে। আর হাস্যকর ব্যাপার হল, এসবই করা হচ্ছে নাকি পার্বত্য এলাকার মানুষের উন্নয়নের স্বার্থে। সরকার, সরকারী মহল ও বিভিন্ন বাহিনীর পক্ষ থেকে সেটাই ফলাও করে প্রচার করা হয়ে থাকে। অথচ জুম্ম জনগণের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে এবং গলা টিপে ধরে শ্বাস রুদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। পার্বত্য চুক্তিকে লংঘন ও স্থানীয় মানুষের অধিকার খর্ব করেই সরকার গায়ের জোরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন ও তা স্থাপন এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপন এবং এর জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করেছে।
বলাবাহুল্য, এসব উদ্যোগের ফলে জুম্মদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ হতে হচ্ছে। আর বহিরাগতদের ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের পার্বত্য অঞ্চলে অনুপ্রবেশসহ ব্যাপক লুটপাট ও আগ্রাসনের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, জনসংহতি সমিতি ও জনগণ বারবার বলে এসেছে যে, তারা নীতিগতভাবে কোনক্রমেই উন্নয়ন, পর্যটন স্থাপন, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন বিরোধী নয়। তারা অবশ্যই এই অঞ্চলের মানুষের সুষম উন্নয়ন চায়, সমৃদ্ধি চায়, স্থায়ীত্বশীল শান্তি স্থাপিত হোক তা চায় এবং পার্বত্য সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক সমাধান চায়। এই কারণেই জনসংহতি সমিতি সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনে সম্মত হয়।
অথচ বিপরীতে এখন আমরা দেখছি, বিগত ২২ বছরেও সরকার চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করেনি। সেনাশাসন ও অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়নি, এখন বরং তা জোরদার করা হয়েছে। ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুরা তাদের জায়গা ফেরত পায়নি। একটি ভূমি বিরোধও নিষ্পত্তি করা হয়নি। স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা করে আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার উদ্যোগও নেয়া হয়নি। আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে নিয়ে বিশেষ শাসনব্যবস্থা কার্যকর করার বিধান থাকলেও এসব পরিষদে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ (স্থানীয়), ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থা, বন ও পরিবেশ ইত্যাদিসহ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি, বরঞ্চ সরকার ও প্রশাসন প্রতিনিয়ত এগুলিকে খর্ব করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি (উপজাতীয়) অধ্যুষিত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের পরিবর্তে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করে চলেছে। বস্তুত সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রেখেছে।
শুধু তাই নয়, সরকার ও সেনাবাহিনী অবিরত একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপত্তার কথা বলছে, অপরদিকে পার্বত্য চুক্তি ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী নানা ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করে চলেছে। আঞ্চলিক পরিষদকে অকার্যকর করে রেখে দিয়েছে। চুক্তির পক্ষ ও চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতি এবং এর সহযোগী সংগঠনসমূহকে আঘাত করার লক্ষে এর নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার, আটক, তল্লাশী করে এবং তাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে হস্তক্ষেপ ও বাধা সৃষ্টি করে জুম্ম জনগণের প্রতিবাদী কন্ঠ ও চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের শক্তি ধ্বংস করার চেষ্টা করা হচ্ছে। চুক্তির পূর্বের মতই সেনাশাসন, দমন, পীড়ন, জেল, জুলুম, তল্লাশি, ক্রসফায়ারের নামে হত্যা, জুম্ম নারী ধর্ষণ, ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক হামলা ইত্যাদি জোরদার করা হয়েছে।
অথচ সরকার, তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসব দেখতে পান না। এসব শোনেনও না। বোঝেনও না। কারণ তারা উগ্র জাত্যভিমানী বাঙালি চেতনায় শিহরিত এবং জুম্মজাতি বিদ্বেষী বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণায় আকন্ঠ নিমজ্জিত। তারা সর্বদা তথাকথিত নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও উন্নয়নের চশমায় পার্বত্য অঞ্চলকে দেখতে পান। জুম্ম জনগণকে ও জনসংহতি সমিতিকে তারা কেবলই সামরিক বাহিনীর প্রবর্তিত গৎবাঁধা সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, রাষ্ট্রবিরোধী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ইত্যাদি লেবেল মার্কা পাঠ্যক্রমেই নিজেদের উপলব্ধির জগতকে আবদ্ধ রাখেন। এর বাইরে যেতে পারেন না, দেখতেও পান না। তাই তারা পাহাড়ের জুম্মদের কান্না, চিৎকার, ক্ষোভ, আগুন দেখতে পান না। একারণেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা, বিভিন্ন বাহিনীর আমলারা এভাবে অনায়াসে নির্বিকারভাবে উন্নয়ন ও নিরাপত্তার নামে জুম্মদের ভূমি বেদখল, জুম্মদের উচ্ছেদ, জুম্মদের মানবাধিকার এবং জুম্মদের অধিকারের সনদ পার্বত্য চুক্তিকে লংঘন করে যান।
বস্তুত উন্নয়নের নামে সাম্প্রতিককালে সরকার জুম্মদের উপর যে আগ্রাসন ও জবরদস্তি চালাচ্ছে, তা এক কথায় ‘সর্বাত্মক আদিবাসী জুম্ম বিধ্বংসী ষড়যন্ত্র’ বা এক গণবিরোধী ঔপনিবেশিক আগ্রাসন ছাড়া আর কিছু নয়। এসব জনবিচ্ছিন্ন উন্নয়নের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুম্ম শূন্য করে এ অঞ্চলকে সম্পূর্ণভাবে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা। বলাবাহুল্য, যে কোন ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েই নিক্ষিপ্ত হয়। জুম্ম জনগণও অবশ্যই শাসকমহলের এই ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করবে।
 
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
             
             
                             
                             
                             
                                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        