স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পার্বত্য চুক্তি বিরোধী বক্তব্য ও পাহাড়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর মূল্যায়ন

0
517
ছবি : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান
মিতুল চাকমা বিশাল

গত ০৫ জানুয়াবি ২০২২ ঢাকার বেইলী রোডে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সে ৪দিন ব্যাপী পার্বত্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে যে সমস্ত কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো নিঃসন্দেহে পার্বত্য চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক এবং চুক্তি অবমাননার সামিল। এমনকি তার এই বক্তব্য মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে তথা দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ও জনগণের জীবন-মান রক্ষার্থে তার সামগ্রিক মূল্যায়ন কতটা অন্তসারশুণ্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

উল্লেখ্য যে, বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি হতে বর্তমান কর্মপদে অভিষিক্ত আছেন। এটি সমগ্র দেশের জন্য তথা দেশের জনগণের জন্য এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ, যেখানে দেশের সার্বিক-সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থতির উন্নয়ন, আইনের সুশাসন, জনগণের জীবন-মান রক্ষা, মাদক চোরাচালান রোধ, প্রবাস ও অভিবাসন সম্পর্কিত নীতিমালা, মানবপাচার রোধ অর্থাৎ দেশের আভ্যন্তরীণ সামগ্রিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা এই মন্ত্রণালয়ের অন্যতম দায়িত্ব।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জনাব আসাদুজ্জামান খান কামাল দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একতরফাভাবে, কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে উদ্ভট সব কথা বলে যাচ্ছেন এবং বাছ-বিচারহীনভাবে বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়ে চলেছেন, যা নিঃসন্দেহে এতদঞ্চলের ভৌগলিক রাজনীতিতে বিরুপ প্রভাব ফেলছে। এছাড়াও ১৯৯৭ সালের ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়ে অর্জিত পার্বত্য চট্টগ্রামের যে বিশেষ শাসনব্যবস্থা অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য জেলা পরিষদের সমন্বয়ে বিশেষ শাসনব্যবস্থার প্রতিনিধিত্বশীল কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে কোনপ্রকার আলোচনা-পরামর্শ ব্যতিরেকে কেবলমাত্র পার্বত্য এলাকায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর মতামতের উপর ভিত্তি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিনিয়ত চুক্তিবিরোধী এবং জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত দিয়ে চলেছেন, সেগুলোও নিন্দনীয়।

গত ০৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন যে, “পার্বত্য অঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে কথা বলার পর সবাই একটাই দাবি জানিয়েছে যে, আমাদের পণ্য বাজারে তোলার রাস্তা চাই, আমাদের নিরাপত্তা চাই”। বস্তুতপক্ষে তার এই বক্তব্যের মধ্যে সত্যতার শতকরা হিসাব একেবারে নেই বললেই চলে। বরং তার এই বক্তব্য পাহাড়ের সমস্যাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে রাষ্ট্রের যে অগভীর দৃষ্টিভঙ্গি, সেটাই প্রতিফলিত করে। অপরপক্ষে এই বক্তব্য পাহাড়ের পরিস্থিতির সামগ্রিক মূল্যায়নের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং নিঃসন্দেহে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত, ভিত্তিহীন ও অবাস্তব।

পার্বত্য চট্টগ্রামে এপর্যন্ত তিনি যতগুলো সফর করেছেন, সবকটি সফরের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের কোন সম্পৃক্ততাই ছিল না। কেবলমাত্র প্রশাসনিক (সেনা, পুলিশ, সাধারণ আমলা) কর্তাদের সাথেই তিনি বৈঠকে মিলিত হয়েছেন, সাধারণ জনগণের সাথেই তিনি কোন সভায় মিলিত হননি। তদূপুরি কেবলমাত্র আমলাদেরকেই যদি তিনি জনগণ বলে দাবি করেন, সেটা তার রাজনৈতিক জীবনের বড় ব্যর্থতা।

সাধারণ মানুষের প্রাথমিক চাওয়া-পাওয়া হচ্ছে তার নিরাপত্তা এবং স্বার্থ (খেয়ে পরে বেঁচে থাকা)। পার্বত্য এলাকায় মোতায়েনকৃত দেশের এক-তৃতীয়াংশ সেনাবাহিনী পাহাড়ে যে প্রকারে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে, যে প্রকারে পাহাড়কে এক অগ্নিকুন্ডের ন্যায় উত্তপ্ত করে চলেছে, সেই অবস্থায় পাহাড়িদের তথা এখানকার স্থায়ী অধিবাসীদের নিরাপত্তা কোনভাবেই রক্ষিত হবার কথা নয়। যদি নিরাপত্তাই রক্ষিত না হয়, তাহলে সেখানে বাণিজ্যিক স্বার্থের কোন প্রশ্নই ওঠে না।

বস্তুতপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমানুষের মৌলিক মানবাধিকারের কথা বিবেচনায় না নিয়ে, তাদের নায্য অধিকারকে ভূলন্ঠিত করে, পদদলিত করে, জুম্ম জনগণের অধিকারের ইস্যুটিকে উন্নয়নের মোড়কে প্যাকেটজাত করা এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ দিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। পার্বত্য এলাকার জুম্ম জনগণ তথা এতদঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দাদের জীবন-মান রক্ষা হেতু সম্পাদিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নের কথা না বলে, কেবলমাত্র উন্নয়নের প্রলেপ দিয়ে সেটাকে ঢেকে রাখার নির্লজ্জ্ব প্রচেষ্টা রাষ্ট্র বারবার করে দেখাচ্ছে। যা পার্বত্যবাসীর জন্য অত্যান্ত হতাশাব্যঞ্জক এবং দুঃখজনকও বটে।

তিনি আরো বলেন, “পার্বত্য এলাকায় সিকিউরিটির ব্যবস্থা করাটা আমাদের দায়িত্ব। পার্বত্য চট্টগ্রামে মাঝে মধ্যেই রক্তপাত হয়। এই রক্তপাতের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে যায়।”

উল্লেখ্য যে, সরকারের পক্ষ থেকে কেবলমাত্র “পাহাড়ে রক্তপাতের” বিষয়টিই বলা হয়। কিন্তু রক্তপাতের পিছনের সমস্যাগুলো অনুসন্ধানের কোন প্রকার প্রচেষ্টা এ পর্যন্ত করা হয়নি, এমনকি সেই সমস্যাগুলো যথাযথভাবে সমাধানেরও কোন উদ্যোগও এ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।

প্রসঙ্গত ১৯৯৭ সালে সালে যখন ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেই সময়ে জুম্ম জনগণের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের একটি বছর পেরোতে না পেরোতেই তথাকথিত পূর্ণস্বায়ত্বশাসনের নাম দিয়ে “ইউপিডিএফ”-এর আবির্ভাব, যা পাহাড়ের পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করে। অনুরূপভাবে ২০০৭ সালে জরুরী অবস্থার সময়ে তথাকথিত রাজনৈতিক সংস্কারের নামে কিছু সুবিধাবাদী দলত্যাগী ব্যক্তি কর্তৃক “জেএসএস (সংস্কারপন্থী)” নামে অপর আরেকটি দলের উত্থান, ২০১৮ সালে আওয়ামীলীগ এবং সেনাবাহিনীর এজেন্ট “ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)”, বিদেশী সশস্ত্র গোষ্ঠী এএলপি, এএলপি থেকে দলচ্যুত “মগ পার্টি” (মারমা লিবারেশন পার্টি), রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন “আরসা” ও “আরসু” প্রভৃতি সংগঠন পাহাড়ে প্রশাসনের নাকের ডগায় ঘোরাফেরা করে। অথচ প্রশাসন সেখানে নীরব দর্শক হয়ে তাকিয়ে তাকে।

রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের অধীনে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, এখানে রাষ্ট্রপক্ষ হিসেবে ক্ষমতাসীন সরকার কোনভাবেই তার দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। তথাপি যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সকল সদস্যগণ অস্ত্র জমাদানের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে গণতান্ত্রিকভাবে তাদের লড়াই-সংগৃরাম পরিচালনা করে যাচ্ছে, সুতরাং চুক্তি স্বাক্ষরকারী হিসেবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকারের উচিত চুক্তিবিরোধী সমস্ত অপশক্তিকে দমন করা। কিন্তু সরকার তা না করে, বরং স্ব-উদ্যেগে চুক্তিবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলছে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেই সমস্ত সশস্ত্র গোষ্ঠীসমূহকে বিভিন্ন প্রকারে (নিরাপত্তা, আশ্রয়-প্রশ্রয়, মদদপ্রদান, অস্ত্র, গোলাবারুদ, অর্থ) সহযোগিতা দিয়ে মদদ দিয়ে চলেছে। যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে এক অন্য মাত্রায় বিকশিত করেছে এবং পর্যায়ক্রমে সংঘাতের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও পাহাড়ে রক্তপাতের ঘটনার বিষয়সমূহ নিয়ে রাষ্ট্রীয় পক্ষ থেকে সরকার কোনভাবেই দায়মুক্ত হতে পারে না। রাষ্ট্রের তথা সরকারের অবহেলা, অদূরদর্শিতা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে রাষ্ট্রের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীই এই সমস্যার অন্যতম কারণ।

অপরপক্ষে তিনি আরো বলেছেন, “পাহাড়ের পরিত্যক্ত সেনাক্যাম্পগুলোতে পুলিশ মোতায়েন করা হবে”-যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে সম্পূর্ণ বরখেলাপ এবং অবমাননা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। একই বক্তব্য তিনি গত ০৭ ডিসেম্বর চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির ৫ম বৈঠকেও বলেছিলেন। যদিওবা উক্ত কমিটির বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিত থাকার কোন আইনী প্রক্রিয়া নেই (দেখুন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি “ক” খন্ডের ৩ নং ধারা), তবুও দেশের প্রশাসনিক দায়িত্ব যেহেতু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন, সেহেতু উক্ত সভায় তার উপস্থিতিকে সাদরে গ্রহণ করা হয়েছিল।

উল্লেখ্য যে, গত ৭ ডিসেম্বর ২০২১ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এধরণের ভিত্তিহীন বক্তব্যের প্রতিবাদ হিসেবে জনসংহতি সমিতির বিপ্লবী সভাপতি ও চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির অন্যতম সদস্য জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)সরাসরি বলেছেন, “প্রত্যাহারকৃত সেনা ক্যাম্পের স্থলে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হলে তা হবে পার্বত্য চুক্তির সরাসরি বরখেলাপ। কমিটির পূর্ববর্তী সভাগুলোকে “পুলিশ (স্থানীয়) বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের নিকট নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে হস্তান্তর করা এবং আইন মোতাবেক পার্বত্য জেলা পুলিশ বাহিনী গঠন করার” সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে তিনি জানান। তদনুসারে তিন পার্বত্য জেলায় পুলিশ বাহিনী গঠন করা অপরিহার্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

প্রসঙ্গত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির “ঘ” খন্ডের ১৭নং ধারার “ক” উপধারা তে উল্লেখ আছে যে, “সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্য চুক্তি সই ও সম্পাদনের পর এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিডিআর,বর্তমান বিজিবি) ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলীকদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী,আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়া হইবে এবং এই লক্ষ্যে সময় সীমা নির্ধারণ করা হইবে। আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল সকল এলাকার ন্যায় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাইবে। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন বা সময় অনুযায়ী সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক পরিষদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করিতে পারিবে।”

স্মতর্ব্য যে, চুক্তি স্বাক্ষরের অব্যবহিত পরে পাঁচ শতাধিক সেনাক্যাম্পের মধ্যে মাত্র ৭০টি অস্থায়ী ক্যাম্প এবং ২০০৯-২০১৩ সালে ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। তদূপুরি বিগত কয়েকটি বছরে, বিশেষ করে ২০১৯-২০২১ সালে প্রায় ২০টির অধিক সেনাক্যাম্প পূনর্বহাল করা হয়েছে। অপরদিকে ২০০১ সালের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে সরকার কর্তৃক একতরফাভাবে “অপারেশন উত্তরণ” জারি করে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীকে সমস্ত প্রশাসনিক এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের উপর কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়েছে।

তাছাড়া পরিত্যক্ত কিছু জায়গা-জমি প্রকৃত মালিকদের নিকট হস্তান্তর করা হলেও, কোন কোন অস্থায়ী ক্যাম্প কর্তৃক পরিত্যক্ত জায়গা-জমি প্রকৃত মালিকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। অপরদিকে পরিত্যক্ত অনেক জায়গাতে নতুন করে ক্যাম্প স্থাপন করে, সেই জায়গাগুলো পূনরায় দখলে নেয়া হয়েছে।

একই ধারার “খ” উপধারাতে উল্লেখ আছে যে, “সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প ও সেনানিবাস কর্তৃক পরিত্যক্ত জায়গা জমি প্রকৃত মালিকের নিকট অথবা পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হইবে।”

সুতরাং আইনুনাসরে সেনাক্যাম্পের পরিত্যক্ত জায়গাতে “পুলিশ নিয়োগ করা হবে” মর্মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যটি চুক্তির সম্পূর্ণ বরখেলাপ। তাছাড়া স্থানীয় পুলিশ বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যতালিকার অধিভূক্ত। সুতরাং এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ করার কোন সুযোগ নেই।

এর আগে গত ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খাগড়াছড়িতে আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক এক সভা করেন। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন শরণার্থীবিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ও সাংসদ কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সাংসদ বাসন্তী চাকমা, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরী, সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের সচিব মো. শহিদুজ্জামান, গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার মো. শাহরিয়ার জামান ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী। কিন্তু দূর্ভাগ্য হলেও এটিই সত্য এবং বাস্তব যে, উক্ত সভায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার মূল প্রতিষ্ঠান আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা কোন প্রতিনিধিকে রাখা হয়নি। যা অত্যান্ত অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত।

অন্যদিকে এইসব সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চুক্তিবিরোধী ও উস্কানিমূলক নানা বক্তব্য প্রদান করেছেন। সর্বশেষ গত ২৪ ডিসেম্বরের সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, “সমতলের মতো পাহাড়ের আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে। তিনি আরও বলেন, ‘শান্তি চুক্তি মোতাবেক যে স্থানগুলো থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে, নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনে সেই পরিত্যক্ত সেনাক্যাম্পগুলোতে চাঁদাবাজি বন্ধ রাখতে পুলিশ, আনসার, বিজিবি এমনকি র‌্যাব মোতায়েন করা হবে (সুত্র: প্রথম আলো,২৪ ডিসেম্বর ২০২০)।”

প্রসঙ্গত, তারও আগে গত ১৬-১৭ অক্টোবর ২০১৯ রাঙামাটিতে পার্বত্য মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত এক সভা আয়োজন করা হয়। উক্ত সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, হানাহানি, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রবাজির একতরফা অভিযোগ এনে পার্বত্য চট্টগ্রামে “সামনে ভয়ঙ্কর দিন” আসছে বলে হুমকি ও উস্কানীমূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়।

উক্ত সভায় জিওসি, র‍্যাবের মহাপরিচালক, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও স্বরাষ্ট্র সচিব প্রমুখ ব্যাক্তিরাও একতরফাভাবে সন্ত্রাস, হানাহানি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে উস্কানিমূলক ও হুমকিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন। “মাটির তিন ফুটের নিচে লুকিয়ে থাকলেও সন্ত্রাসীদের বের করে আনা হবে, দুই কোটি লোক বসবাসকারী  ঢাকায় সন্ত্রাসীদের অনায়াসে খুঁজে বের করা হয়, সেখানে ১৫/১৬ লক্ষ বসবাসকারী পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করা কোন ব্যাপারই না” বলে হুমকি প্রদান করা হয়।

গত ১০ মার্চ ২০২০ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে রাঙামাটির সাজেকে যান, সেখানে তিনি সেনাবাহিনী ও বিজিবির বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন করে বরকলের ঠেগামুখ স্থলবন্দর পরিদর্শন করেন। সেখানেও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষশাসন কাঠামোর কোন প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা রাখা হয়নি। অন্যদিকে একই বছরে ১৫ অক্টোবর দুইদিনের সফরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থানচি সফর করেন। সেই সময়েও পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং আঞ্চলিক পরিষদের কোন প্রতিনিধিকেই তিনি অবহিত করেননি।

এছাড়া গত ২৯ নভেম্বর ২০২১, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের সর্ব পূর্বের উপজেলা থানচি সফরে যান, সেখানে তিনি ৩৮ বিজিবি’র সীমান্ত অবকাশ কেন্দ্রে গিয়ে পরিদর্শন করে আসেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য এই বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার মূল স্তম্ভ আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহকে কোনপ্রকার সম্পৃক্ত করেননি। যা এতদঞ্চলের বিশেষ শাসনব্যবস্থার প্রতি সরকারের তথা দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ছাড়া আর কিছুই না।

উপরোক্ত বিষয়গুলো থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় এখনো পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে আশানুরুপ কোন ধারণা রাখে না। এমনকি ধারণা থাকা সত্ত্বেও চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কোনপ্রকার ইচ্ছা রাখে না।

পার্বত্য চটগ্রামের সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা, এই সমস্যা অতীতে যেমনি সামরিক-অর্থনৈতিক এবং দমন-পীড়নের মাধ্যমে সমাধান করা যায়নি, ভবিষ্যতেও করা যাবে না। পার্বত্য জুম্ম জনগণ শান্তি চায় বলেই আলোচনার টেবিলটিকে স্বাগত জানিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে হেঁটেছিল। যদি বাস্তবিকই পাহাড়ের জনগণ বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বে বিশ্বাসী হতো, তাহলে আলোচনার টেবিলটিকে কোনদিনই তাারা সামনে নিয়ে আসতো না। যদি সত্যিই তারা বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাসী হতো, তাহলে চুক্তির প্রস্তাবনাতে “বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভোমত্ব ও অখন্ডতাকে” মেনে নিতো না। কিন্তু রাষ্ট্র বরাবরই আমাদেরকে বাংলাদেশ নামের ভূ-খন্ড হতে বিচ্ছিন্ন করার অপকৌশল প্রয়োগ করে চলেছে, যা নিঃসন্দেহে দেশের সামগ্রিক স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর।

বস্তুতঃপক্ষে পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনী অথবা উন্নয়ন কৌশল দিয়ে পাহাড়ে তথাকথিত রক্তপাত বন্ধ করা যাবে না, এমনকি পাহাড়ে শান্তিও ফিরে আসবে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার, ভূমি সমস্যার যথাযথ সমাধান, আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোকে জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে রুপান্তরের লক্ষ্যে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন পূর্বক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এবং তাদের উপর অর্পিত সমস্ত কার্যাবলি ও বিষয় যথাযথভবে হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে, সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই পাহাড়ের সমস্যার সমাধান অর্জিত হবে। অন্যথায় পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস কোনদিনই বইবে না। অবশ্যই বাংলাদেশের অন্যান্য জেলাসমূহ হতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পৃথক বৈশিষ্ট্যতার দাবি রাখে। এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েই বিশেষ অঞ্চলের জন্য বিশেষ শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সুতরাং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকারের উচিত জুম্ম জনগণের এই বিশেষত্বকে সম্মান এবং শ্রদ্ধা করে,পার্বত্য চুক্তি দ্রূত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করে দেশকে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করা।