সেনাবাহিনী কর্তৃক জুম্মর বাড়ি ভাঙচুর ও ভূমি বেদখলের প্রতিবাদে খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল

0
685

হিল ভয়েস, ১৪ জুন ২০২১, খাগড়াছড়ি: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাধীন গুইমারা উপজেলার সিন্দুকছড়ি-মহালছড়ি সড়কের পাশে পুংখিমুড়া পাড়ার সনেরঞ্জন ত্রিপুরার সদ্য নির্মিত বাড়ি ভাংচুর এবং অবৈধভাবে ভূমি বেদখলের প্রতিবাদে ত্রিপুরা স্টুডেন্টস্ ফোরাম (টিএসএফ) বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে। অপরদিকে, খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ি এলাকাবাসীর পক্ষ থেকেও পক্ষীমুড়োতে (পুংখিমুড়া) জমি বেদখলের ষড়যন্ত্র বন্ধ করার দাবিতে এবং ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে গণপ্রতিবাদের আয়োজন করা হয়।

আজ ১৪ জুন ২০২১ সকালে টিএসএফ’র ব্যানারে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলটি খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ থেকে শুরু হয়ে খাগড়াছড়ির জেলা শহরের মুক্তমঞ্চে গিয়ে সমাপ্ত হয় এবং এর পরপরই সেখানে মানববন্ধন করা হয়। একইদিন সকালের দিকে লক্ষীছড়ি এলাকাবাসীর ব্যানারে লক্ষীছড়িতেও একই বিষয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও গণপ্রতিবাদের আয়োজন করা হয়।

টিএসএফ’র কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রেম কুমার ত্রিপুরার সভাপতিত্বে এবং কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক অঞ্জুলাল ত্রিপুরার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত মানববন্ধনের সমাবেশে সংহতি বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস্ কাউন্সিল (বিএমএসসি) এর কেন্দ্রীয় সভাপতি নিঅং মারমা, টিএসএফ’র সাধারণ সম্পাদক নক্ষত্র ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের প্রতিনিধি ফোরামের সদস্য কৃপায়ন ত্রিপুরা, গুইমারা উপজেলার টিএসএফ’র সভাপতি বতেন ত্রিপুুরা ও স্থানীয় কার্বারি লোকনাথ ত্রিপুরা প্রমুখ।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, গত শনিবার, ১২ জুন, রাত আনুমানিক ১১:০০ টার দিকে মহালছড়ি সেনা জোনের মৃত্যুঞ্জয়ী ২৫ বেঙ্গলের অধীন ধুমনীঘাট সেনা ক্যাম্পের একদল সেনা সদস্য মহালছড়ি উপজেলার ২২৬নং সিন্দুকছড়ি মৌজাধীন মহালছড়ি-সিন্ধুকছড়ি সড়কের পাশে পুংখিমুড়া নামক এলাকায় সনেরঞ্জন ত্রিপুরার সদ্য নির্মিত বাড়ি ভেঙে দেয়। পাশাপাশি সেখানে থাকা তার বিভিন্ন ধরনের গৃহ নির্মাণ সরঞ্জামাদি যেমন দা, কোদাল, শাবলসহ গৃহের সমস্ত খুঁটি ও বেড়াগুলো গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় সেনা জওয়ানরা দ্রুত সেখানে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হবে জানিয়ে একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়ে যায় এবং এর পরপরই সেখানে কমিউনিটি সেন্টার বসিয়ে উদ্বোধন করা হয়।

বক্তারা আরো বলেন, সেনাবাহিনী কেবল সনেরঞ্জন ত্রিপুরার বাড়ি ভেঙে দিয়ে থেমে থাকেনি। তারা সনেরঞ্জন ত্রিপুরার ভোগদখলীয় ঐ জায়গাটিও নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। এছাড়া সনেরঞ্জন ত্রিপুরার ঐ জায়গার পার্শ্ববর্তী পনেন্দ্র ত্রিপুরা (৩৫) ও তারামুনি চাকমা নামে আরো দুই গ্রামবাসীর জায়গা বেদখল করে নেয়।

সমাবেশে টিএসএফ’র কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি প্রেম কুমার ত্রিপুরা বলেন, মানুষের সবগুলো চুরি হতে পারে। কিন্তু রাতের আধাঁরে সদ্য নির্মিত ঘরটি কিভাবে চুরি হতে পারে? এসব ঘটনায় প্রশাসন ও উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ কোন ধরনের ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ না নিলে বৃহৎ আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবেন বলেও হুশিয়ারি দেন তিনি।

সমাবেশে টিএসএফ’র পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত ৫ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়-
১। পার্বত্য এলাকায় চিরাচরিত প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি কমিশন আইন ২০০১ ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে;
২। বেদখলকৃত জায়গাটি প্রকৃত মালিকদের নিকট সম্পূর্ণভাবে ফেরত দিতে হবে;
৩। কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের জন্য পূর্ব নির্ধারিত পাশের জায়গায় উক্ত কমিউনিটি ক্লিনিকটি স্থানান্তরিত করতে হবে;
৪। পুংখীমুড়া এলাকার স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন জীবিকা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে;
৫। হোটেল, মোটেল, পর্যটন ও উন্নয়নের নামে উচ্ছেদ বন্ধ করতে হবে।

ভুক্তভোগী ও এলাকাবাসীর তথ্য মোতাবেক, গত বছর মহালছড়ি-সিন্দুকছড়ি রাস্তা সংস্কার শুরু হলে ভুক্তভোগী সনেরঞ্জন ত্রিপুরার (৪০) জায়গাটিও সেনাবাহিনী বেদখলে নিয়ে নেয়। পরে সনেরঞ্জন ত্রিপুরা প্রতিবাদ জানিয়ে সেনাবাহিনী জায়গার নিজস্ব মালিকানা আছে এবং তিনি সেখানে বাড়ি নির্মাণের বিষয়টি তুলে ধরেন। বাড়ি নির্মাণের লক্ষ্যে সমাধান চেয়ে তিনি গত ২৫ মে ২০২১ খাগড়াছড়ি জেলার এমপি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে জায়গার দলিল দস্তাবেজ দেখালে এমপি তাকে নিজের জায়গায় বাড়ি নির্মাণের অনুমতি প্রদান করেন।

এরপর সনেরঞ্জন ত্রিপুরা বাড়ি ফিরে এসে পাড়া প্রতিবেশিদের সহায়তায় বাড়িটি নির্মাণ করেন। বাড়িটি নির্মাণের পরের দিন ২৬ মে ২০২১ দুমনিঘাট ক্যাম্প থেকে একদল সেনাসদস্য গিয়ে বাড়ি নির্মাণের বাধা প্রদান করে এবং সনেরঞ্জন ত্রিপরার কাছ থেকে জায়গার দলিল কেড়ে নিয়ে যায়।

তার দুইদিন পর ২৮ মে ২০২১ সনেরঞ্জন ত্রিপুরাসহ চারজনের একদল প্রতিনিধি দুমনিঘাট সেনা ক্যাম্পে যান। এসময় দুমনিঘাট ক্যাম্প কমান্ডার মেজর আনিস সনেরঞ্জন ত্রিপুরাসহ চার প্রতিনিধি দলকে বলেন, ‘সনেরঞ্জনের কাগজপত্র দেখলাম, কিন্তু জায়গাটি তার নামে রেজিষ্ট্রি নাই। তাই জায়গার মালিক সনেরঞ্জন হতে পারে না। তোমরা মেনে নাও, এখানে পর্যটন হলে তোমাদের লাভ হবে। তোমরা যদি এ জায়গা ছেড়ে না দাও তাহলে তোমাদের নামে ভূমি বেদখলকারী হিসেবে থানায় মামলা দেয়া হবে।’ এ কথা বলে তিনি গুইমারা থানায় কল দিয়ে সেখান থেকে ৩ সিএনজি পুলিশ সেনা ক্যাম্পে নিয়ে আসেন।

তখন উপস্থিত প্রতিনিধিরা বলেন, জায়গাটি আমাদের নামে রেজিষ্ট্রিকৃত তাই আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। আপনারা মামলা আর যাই করুন বলে ক্যাম্প থেকে গ্রামে ফিরে আসেন।

তারপর বিষয়টি গত ৫ জুন ২০২১ স্থানীয় এমপি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে জানালে তিনি বলেন, বাড়ি যেহেতু নির্মাণ শেষ হয়েছে। তোমরা অব্যাহত রাখ, আমি ফিরে এসেই ব্রিগেডিয়ারের সাথে কথা বলে সমাধান করে দিব।

তারপর, সেনাবাহিনী তাদের সিদ্ধান্তে অটুট থেকে মোটেল ও পর্যটন স্থাপনা নির্মাণ করার লক্ষ্যে গতকাল ১২ জুন ২০২১ রাত ১০:৩০ টায় দুমনিঘাট সেনা জোন থেকে ২০-২৫ টি গাড়িতে করে একদল সেনাসদস্য এসে সনেরঞ্জন ত্রিপুরার নির্মাণ করা বাড়ি ভেঙ্গে দেয় এবং বাড়ির খুঁটি, আসবাবপত্র, অন্যান্য সামগ্রী দুমনিঘাট ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ঠিক তার কিছুক্ষণ পরে সনেরঞ্জন ত্রিপুরার জায়গার পাশে পনেন্দ্র ত্রিপুরা (৩৫) ও তারামুনি চাকমা নামে আরো দুই জুম্মর জায়গা বেদখলে নেয়।

এর পরদিনই ১৩ জুন ২০২১ সেনাবাহিনী তড়িঘড়ি করে ঐ বেদখলকৃত জায়গায় কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করে তা উদ্বোধন করা হয়েছে বলে ঘোষণা করেন।