সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনা ভুলে যাওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে যাওয়া: বিদ্রোহের ১৬৬তম বর্ষপূর্তির আলোচনায় পঙ্কজ ভট্টাচার্য

0
656

হিল ভয়েস, ৩০ জুন ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬৬তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আইপিনিউজ কর্তৃক আয়োজিত অনলাইন আলোচনা সভায় প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনাকে ভুলে যাওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে যাওয়া।’

আজ ৩০ জুন ২০২১, সান্তাল বিদ্রোহের ১৬৬তম বর্ষপূতি উপলক্ষে আদিবাসীদের স্বতন্ত্র নিউজ পোর্টাল আইপিনিউজ এর আয়োজিত এই আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি সুলভ চাকমা। এতে আলোচক হিসেবে আরও সংযুক্ত ছিলেন প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হরেন্দ্রনাথ সিং, সাহেদগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সভাপতি চন্দ্রা ত্রিপুরা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলীক মৃ প্রমুখ।

রাষ্ট্রীয়ভাবে সান্তাল বিদ্রোহ দিবস পালন না হওয়ায় আক্ষেপ জানিয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য আরো বলেন, ‘উপনিবেশ বিরোধী প্রথম গণসংগ্রাম সান্তাল বিদ্রোহ। এটাকে ভুলে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম বলে তুলে ধরা যায় না। এটাই ছিল প্রথম অনুপ্রেরণা এবং বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রেরণা সাওতাল বিদ্রোহ। এই চেতনা যদি আমরা ধরে রাখতে না পারি তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে এটা আমাদের ব্যর্থতা।’ তিনি বলেন, ‘সান্তাল বিদ্রোহের নেতারা কেবল সান্তাল নেতা হয়। তারা জাতীয় নেতা এবং তাদেরকে ভুলে যাওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে যাওয়া।’

তিনি আরো বলেন, ‘সান্তালরা মূলত ব্রিটিশ-দালাল, সুদখোর, মহাজন ও নিপীড়নকারীদের কাছ থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। এখনো প্রান্তিক আদিবাসী, গরীব ও নিপীড়িত বাঙালিরা তাদের থেকে মুক্তি চায়।’ সান্তাল বিদ্রোহের জাতীয় বীরদের আকাঙ্খা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি বলেও মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘সাহেদগঞ্জ-বাগদাফার্মের নিপীড়িত সান্তাল এবং বাঙালিরা এখনো বিচার পায়নি এবং বাপ-দাদার জমি এখনো ফেরত পায়নি।’ নীপিড়িত আদিবাসী, গরীব বাঙালি এবং মুসলমান নারী, হিন্দু নারী ও আদিবাসী নারীদের উপর যে চরম নিপীড়ন চলছে তাঁর বিরুদ্ধে এখনো যে লড়াই চলমান সে লড়াই সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরবের বলেও দাবি করেন তিনি।

আদিবাসীদের আন্দোলনকে বাদ দিয়ে যারা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে দেখেন তারা আংশিক সত্য বলছেন বলেও মনে করেন এই প্রবীণ নেতা। এছাড়া পাহাড়ের আদিবাসীদের ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি তিন ভাগের দুইভাগ অবাস্তবায়িত রয়েছে। সিধু-কানুর হাত ধরে লড়াই করে এসব বাস্তবায়ন করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

আলোচনায় যুক্ত হয়ে বিশিষ্ট এই ইতিহাসবিদ ও আদিবাসী গবেষক অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, ‘ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো হয়েছিল তার প্রধান মাইলফলক হচ্ছে সান্তাল বিদ্রোহ। এই আন্দোলনের প্রধানতম দিক হচ্ছে অন্যান্য সকল আন্দোলন স্থানীয় পর্যায়ে থেকে গেলেও সান্তাল বিদ্রোহ বাংলা, বিহার ও উরিষ্যা এবং দিল্লি পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত ছিল। ব্রিটিশদের কাছে এটি ছিল অন্যতম চ্যালেঞ্জ।’ এই বিদ্রোহের আত্মবলিদান সুবিশাল এবং অন্তত বিশ হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছেন বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন এই ইতিহাসবিদ। প্রাণদানের মহোৎসবের বিবেচনায়ও এই আন্দোলন অনেক গৌরবের বলেও মনে করেন এই অধ্যাপক। এই আন্দোলন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে অনন্য উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে বলেও মনে করেন তিনি।

অধ্যাপক মেসবাহ কামাল আরো বলেন, ‘আমরা এক উপনিবেশ (ব্রিটিশ) থেকে আরেক উপনিবেশে (পাকিস্তানে) প্রবেশ করেছিলাম। সকল সংগ্রামে দেশের সকল আদিবাসীরা সংগ্রাম করেছেন। অসংখ্য কৃষক, বাঙালি ও আদিবাসী এবং শ্রমিকরা জীবন দিয়েছেন। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে আদিবাসীদের যে অবদান সেগুলো লিপিবদ্ধ হওয়া দরকার। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বারবার হোচট খেয়েছে এবং মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে এই স্বাধীনতা চলে গেছে।’

আদিবাসীদের সমস্যার মূলে ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া এবং আদিবাসীদের অস্তিত্ব চরম চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে আছে বলেও মনে করেন তিনি। জমিন-জঙ্গল-জল আদিবাসীদের মূল প্রাণ। এই তিন উপাদান থেকে যদি আদিবাসীদেরকে বিযুক্ত করা হয় তাহলে আদিবাসী আর আদিবাসী থাকে না বলেও মনে করেন তিনি। সেটাকে নিশ্চিত করা না গেলে আদিবাসীর অস্তিত্ব থাকবে না বলেও মনে করেন তিনি। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটার অভিশাপ ‘একীভূতকরণ’ পলিসি। কিন্তু পৃথিবীটা এখন শিক্ষা নিয়ে ‘রিকোগনিশন অব ডাইভার্সিটি’ বা বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি প্রদান করাটাই সমীচিন বলে মনে করা হচ্ছে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে ভারতের রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. জ্যোৎস্না চট্টোপধ্যায় বলেন, ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ বা হুল বিদ্রোহ ভূমিজ মানুষেরই অধিকারের কথা। যেটা সবার সামনে তুলে আনা দরকার। শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতিগতভাবে তাদেরকে উপক্ষো করা হয়। তাদের অধিকাররের জায়গাটা সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয় না, এটা খুবই দুভাগ্যজনক।’

তিনি বলেন, ‘আমরা এতবছরের সভ্যতার ধারক-বাহক যারা তাদেরকে বিচ্ছিন্ন কিছু সাহিত্যের মধ্যে তুলে ধরা হলেও প্রকৃত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। তারা নিপীড়িত বা তাদের অধিকারকে স্বীকার করা হয় না।’ এই অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তরুণদেরকে দায়িত্ব নিতে হবে বলেও মনে করেন পশ্চিমবঙ্গের এই শিক্ষাবিদ।

সাহেদগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে বলেন, ‘সিধু-কানুরা যে আন্দোলন করেছেন আমরা বাংলাদেশেও আদিবাসীরা নিজেদের সংস্কৃতির অধিকার, ভূমির অধিকারের জন্য লড়ছি। সাহেদগঞ্জ-বাগদাফার্মের ভূমি উদ্ধারের আন্দোলনে নিপীড়িত বাঙালিরাও আছেন। আমরা চাই আমাদের বাপ-দাদার জমিতে ফসল ফলিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষা করে বসবাস করতে এবং সে আন্দোলন আমরা করে যাচ্ছি।’

যুব নেত্রী চন্দ্রা ত্রিপুরা বলেন, ‘আমরা আশায় থাকি এই রাষ্ট্র ঐতিহাসিক এই দিবসগুলো উৎযাপন করবে। কিন্তু আমরা দেখি, কেবল আদিবাসী এবং প্রগতিশীল বাঙালি সমাজ এটি পালন করে থাকেন। দেশের আদিবাসীদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বিকৃত করে সত্যিকারে এই দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা পাঠ্য পুস্তক বলেন, অন্যান্য কোনো জায়গায় বলেন, রাষ্ট্র কখনো এই আদিবাসীদের গৌরবময় অধ্যায়কে সেভাবে তুলে ধরতে পারেনি। যার ফলে গৌরবময় এই ইতিহাস তরুণ প্রজন্মসহ অনেকের কাছে অজানা।’

তিনি আরও বলেন, ‘ব্রিটিশদের সময় যেমন তাদের অধিকারকে ‘রিকোগনাইজ’ করা হয়নি, এখনো হয়নি। তাঁর বদলে আমরা অভিধা পেয়েছি কখনো সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদীসহ নানা নামে।’ মানবমুক্তির সংগ্রামে সিধু-কানু ও চাঁদ-ভৈরব এর লড়াই এবং আদিবাসীদের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলো তুলে ধরা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করার জন্য তিনি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে আহ্বানও জানান।

আদিবাসী ফোরামের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হরেন্দ্র নাথ সিং বলেন, ‘আমরা দেখেছি যে ব্রিটিশদের সময়ে সান্তালদের জমিগুলোর উপর নামে বেনামে লীজ দিয়ে ব্রিটিশ এবং তাদের দোসররা হরিলুট করেছে। ঠিক তেমনি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেদগঞ্জ-বাগদাফার্মের সান্তাল আদিবাসীদের উপরও একই ধরনের নিপীড়ন করা হয়েছে। আগেকার দিনে সান্তালদেরকে ঠকানোর জন্য জোর করে ঋণ দেওয়া হতো। যে একবার ঋণ নিয়েছে তার সারাজীবন লোন শোধ করতে হয়েছে এবং নিজের জমিতে উৎপাদিত ফসলের সিংহভাগই হারাতেন ঋণদাতাদের কাছে। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধেই মূলত তৎকালীন আদিবাসীরা দাঁড়িয়েছিলেন।’ বর্তমান সরকার আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ে যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন সেই প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়নও দাবি করেন তিনি। অবিলম্বে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠনের দাবি করেন এই আদিবাসী নেতা।

আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলীক মৃ বলেন, ‘আজকে ব্রিটিশরা চলে গেছে। কিন্তু ব্রিটিশরা যেভাবে অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন করেছিল ঠিক একই কায়দায় জোর জবরদস্তি করে সান্তালসহ অন্যান্য আদিবাসীদেরকে অত্যাচার করছে শাসকরা এবং তাদের জমি দখল করছে। সাহেদগঞ্জ-বাগদাফার্মের যে ঘটনা তার জলন্ত প্রমাণ।’

তিনি আরও বলেন, ‘আজকে আদিবাসীরা তাদের ভূমির অধিকার চায়। সমতলের আদিবাসীরা ভূমি কমিশনের দাবি করে আসছে। কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও পায়নি।’ সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব যে লড়াইয়ের সূচনা করেছিল সেই লড়াই এখনো আদিবাসীরা লড়ছেন বলেও মনে করেন এই আদিবাসী ছাত্র নেতা।