হিল ভয়েস, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ঢাকা: আজ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ বিকাল ৪ ঘটিকার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে আদিবাসী ছাত্র জনতার ব্যানারে খাগড়াছড়িতে ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক জুম্ম স্কুল ছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও ধর্ষকদের অতিদ্রুত গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে এবং বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক উক্যনু মারমাকে সেনাবাহিনী কর্তৃক অন্যায়ভাবে আটক ও মারধরের প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
এই সময় উক্ত সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা, কন্ঠশিল্পী সায়ান, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা, পিসিপি, কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈসানু মারমা, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের দপ্তর সম্পাদক অনিক কুমার দাশ, পিসিপির সহ সাধারণ সম্পাদক কৃতিত্ব চাকমা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি রাকিবুল হাসান সুজন, বিএমএসসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হ্লাশৈ মারমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, জগন্নাথ হল সংসদের সাহিত্য সম্পাদক কথক বিশ্বাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুর্মী চাকমা প্রমুখ।
দীপায়ন খীসা বলেন, বর্তমান সরকার ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে কিন্তু এই সরকার আজও পাহাড়ে ধর্ষণ থামাতে পারেনি। এই দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে। সরকারের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে পাহাড়ে বর্তমানে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক ধর্ষণের মহাৎসব চলছে। এই সরকার নানা সংস্কারের কথা বলছে কিন্তু পাহাড়ের প্রশ্ন উঠলে সবাই নিরব ভূমিকা পালন করছে। পাহাড়ে ধর্ষণ থামছে না, নিযার্তন থামছে না, জোর পূর্বক ভূমি বেদখল থামছে না।
তিনি বলেন, পাহাড়ে শান্তির উদ্দেশ্যে একটি চুক্তি হয়েছে, যেটিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু অন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার ১ বছরের অধিক অতিক্রান্ত হলেও চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো সদিচ্ছা প্রকাশ করছে না।
তিনি আরো বলেন, যারা ধর্ষকদেরকে আইনের আওতায় আনার জন্য প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তাদের মধ্যে একজনকে সেনাবাহিনী অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করেছে। তারা মারধর করে উক্যনু মারমাকে পরে ছেড়ে দিয়েছে। এই বাংলাদেশের সংবাদ মিডিয়াগুলো একটি ন্যারেটিভ তৈরি করে দিয়েছে- সেনাবাহিনী সদস্যরা দেশপ্রেমিক, পাহাড়িরা সন্ত্রাসী। কোনো গণমাধ্যম কি এই পর্যন্ত বলেছে- বাঙালি ধর্ষক? ইউনুস সাহেবের মতো পান্ডিত্যপূর্ণ সরকারের আমলে আদিবাসী নারীরা কেন ধর্ষিতা হয়? যেসকল বাহিনীর সদস্যরা অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে যায় তাদেরকে অতিদ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে।
কন্ঠশিল্পী সায়ান বলেন, আমাদের সমাজকে পাল্টাতে হবে। সমাজ পাল্টালে দেশ পাল্টাতে বাধ্য। পাহাড়ি বাঙালি এই বিভাজনগুলো ভুলে আমাদের এক হয়ে সকল ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে আমাদের কন্ঠসর জারী রাখতে হবে। শুধু সম্প্রীতির কথা বললে হবে না। সম্প্রীতিকে চর্চা করতে হবে। আমাদের শুধু বাংলাদেশের কথা বললে হবে না, বাংলাদেশে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা বলতে হবে।
সুর্মী চাকমা বলেন, বাংলাদেশ বাদে পৃথিবীর কোনো দেশে ধর্ষণের প্রতিবাদ করার জন্য প্রতিবাদারীদের গ্রেপ্তার করতে দেখিনি। শুধুমাত্র উক্যনু মারমাকে গ্রেপ্তার করে আন্দোলনকে বন্ধ করা যাবে না, কারণ আমরা সবাই মিলে একটি কন্ঠস্বর। আদিবাসী নারীসহ সকল নারীর নিরাপত্তা প্রদান করে অতিদ্রুত ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করতে হবে ও সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
সৈসানু মারমা তার সংহতি বক্তব্যে বলেন, আজকে যদি দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি না থাকতো, যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার কাজ সুষ্ঠুভাবে পালন করতো, তাহলে আজকে আমাদের এখানে ধর্ষকদের গ্রেপ্তারের জন্য দাঁড়াতে হতো না। পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় সেনাবাহিনীর অবস্থান সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ থাকে। তারা সবসময় ধর্ষক, ভূমি বেদখলদার, গণহত্যাকারীর পক্ষে থাকে।
হ্লাশৈ মারমা বলেন, কোনো রকম আইনী নোটিশ ছাড়া রাতের অন্ধকারে উক্যনু মারমাকে গ্রেপ্তারের ঘটনা, আমাদেরকে কল্পনা চাকমার কথা মনে করিয়ে দেয়।
অনিক কুমার দাশ বলেন, এই রাষ্ট্র প্রশ্রয় দিচ্ছে বলেই এই রাষ্ট্রে নতুন নতুন ধর্ষক জন্ম নিচ্ছে। দুই বছরের শিশুও বাংলাদেশে নিরাপদ না। এই সংকট শুধু পাহাড়ে না, পুরো বাংলাদেশে চলমান রয়েছে। এই সমাজকে বসবাসের জন্য নিরাপদ করে তুলুন।
কথক বিশ্বাস বলেন, আজকে বাংলাদেশ একটি মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে। যে যার মত কাজ করছে। বর্তমানে আমাদের সংখ্যালঘুদেরকে হেয় করে দেখা হয়। অনিয়মের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ সবসময় জারি থাকবে। আর কোনো অনিয়ম দেখা দিলে সংখ্যালঘুরা এক হয়ে বিক্ষোভে ফেটে উঠবে।
কৃতিত্ব চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সকল সমস্যা সমাধান করতে হলে অতিদ্রুত ৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। আদিবাসীদের উপর চলমান সমস্ত নিপীড়ন, শোষণমূলক ব্যবস্থাকে আদিবাসী তরুণ সমাজ একসাথে প্রতিহত করবে।
শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, গতকাল উক্যনু মারমার সাথে যা ঘটেছে সেটা আমার বা আপনার সাথেও ঘটতে পারে। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের যে নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থা চলমান রয়েছে তার মাধ্যমে প্রতিদিন আদিবাসীদেরকে পিষ্ট করা হচ্ছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা আশা করেছিলাম বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। কিন্তু বর্তমানে আমরা সেটির ছিটেফোঁটা দেখছি না। বরং আন্দোলনকারীদেরকে এই রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক দমন নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, আমরা আজব এক দেশে বসবাস করছি, যেখানে ধর্ষণকারীদের গ্রেফতার না করে ধর্ষণের প্রতিবাদকারীদের অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হয়। উক্যনু মারমা একা না, আমরা সবাই সম্মিলিত একটি প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। আমরা পার্বত্য চুক্তির আগের দুই দশকেরও বেশি সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাসকে ভুলি নাই। আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথগুলোকে যদি রুদ্ধ করা হয়, আমরা পরবর্তীতে অগণতান্ত্রিক পথকে বেছে নিব।
রাকিবুল হাসান সুজন বলেন, ধর্ষণ কান্ড শুধুমাত্র ধর্ষণ নয়, এগুলো রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিকল্পিত ঘটনা। রাষ্ট্র বছরের পর বছর আদিবাসীদের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্যাতনের ধারা জারি রেখেছে। আমরা এইধরনের বিমাতাসুলভ আচরণকে নতুন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী রূপ হিসেবে দেখি।
পিসিপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শান্তিময় চাকমার সঞ্চালনায় সমাবেশটিতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল(বিএমএসসি), ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি নুমংপ্রু মারমা।
+ There are no comments
Add yours