সরকারকে চুক্তি বাস্তবায়নে বাধ্য করতে হবে- নারী দিবসের আলোচনায় সাধুরাম ত্রিপুরা

0
297

হিল ভয়েস, ৮ মার্চ ২০২৩, রাঙ্গামাটি: আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ৩৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাঙ্গামাটিতে আয়োজিত আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা মিল্টন বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান বাস্তবতা দাবি করছে, ছাত্র-যুব সমাজকে তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বাধ্য করতে হবে।

আজ ৮ মার্চ ২০২৩ সকাল ১০ টায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে নারী সমাজ অধিকতর সামিল হউন’ আহ্বান নিয়ে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির উদ্যোগে রাঙ্গামাটির জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে উক্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মনি চাকমার সভাপতিত্বে এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাধুরাম ত্রিপুরা মিল্টন। সভায় আলোচক হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শিশির চাকমা, অ্যাডভোকেট চঞ্চু চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক ইন্টুমনি তালুকদার, জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক জুয়েল চাকমা, সমিতির মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আশিকা চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা।

প্রধান আলোচকের বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা আরও বলেন, আমাদের নারী সমাজ আজ পিছিয়ে নেই। তাদের পদচারণা আজ সর্বক্ষেত্রে। আজ আমরা যদি যার যে যোগ্যতা, যার যে দায়িত্ব তা পালন করে আমরা যদি জাতিগত উন্নতি করতে চাই, আমরা যদি অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে একটা সুন্দর জনপদ গড়তে চাই তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করতে এগিয়ে আসি, তাহলে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে থাকা সমস্ত দুর্বলতা ও ব্যর্থতাগুলো থেকে বের হওয়ার সময় এখন এসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতিগোষ্ঠীদের মধ্যে একতা ও ঐক্য সুসংহত করতে হবে। এটা করতে না পারলে আমরা আমাদের অস্তিত্বকে হারাব। এই পাহাড় আর আমাদের থাকবে না। এই জীবন আমাদের থাকবে না। একটা সময় জীবন পর্যন্ত আমাদের হাতে ছিল না, সম্পত্তি তো অনেক দূর। এই জীবন নিজেদের করে পেতে হলে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এর কোনো বিকল্প হতে পারে না।

বিশিষ্ট শিক্ষক ও সাহিত্যিক শিশির চাকমা বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী, স্পিকার নারী হলেও আমাদের দেশে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের অবস্থান শতকরা মাত্র ১% ভাগ। শতকরা ৭৩% ভাগ নারী এখনো নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অথচ, আমরা গলা ফাটিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার, নারীর সমতার বিষয়ে বলছি। এটা মধ্যবিত্তের একটা অপকৌশল। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিরাট একটা অবদান রয়েছে। আরেকদিকে এই মধ্যবিত্তের একটা স্বার্থবাদী চিন্তা প্রবল হচ্ছে, সেটা কর্তৃত্ববাদ। আমি পার্বত্য অঞ্চলে দেখি যে, মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে এই স্বার্থবাদী চিন্তা আমাদের মধ্যে প্রবলভাবে বিদ্যমান। আমরা দেখি না কেন, আজকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে উপনীত হতে এখানে সশস্ত্র সংগ্রাম হয়েছে। এই সশস্ত্র সংগ্রামে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক মানুষ তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছে। এই সংগ্রামে অনেকে তাদের বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব হারিয়েছে। কিছু একটা পাওয়ার জন্য অবশ্যই তার হিস্যা আছে। সেই হিস্যাটা কি? তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করেছে। এই চুক্তি শুধু জনসংহতি সমিতির নয়, এই চুক্তি সমগ্র জুম্ম জনগণের।

তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি একটি রক্তাক্ত দলিল। এই দলিলকে অস্বীকার করা যায় না। আজকে চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে অনেকে বাড়িতে থাকতে পারে না। তারা বর্তমানে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে না। চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন জনসংহতি সমিতির একার না, আমাদেরকেও যুক্ত হতে হবে। কিন্তু আমরা নিজের স্বার্থের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছি না। সেখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত না হলে, নারীর মান-মর্যাদা, তার অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে না।

জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক জুয়েল চাকমা বলেন, আদিবাসী নারী তথা সমগ্র জুম্ম জনগণকে শাসকগোষ্ঠী যে চোখে দেখে, সেই দৃষ্টিভঙ্গী রাষ্ট্রের পাল্টানো দরকার। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মধ্যে দিয়ে সরকার জুম্ম জনগণকে অধিকার দিয়ে এখানকার নারীদের যে নিরাপত্তা, সেই নিরাপত্তা বিধান হবে। তাদের প্রতি যে বৈষম্য, সেই বৈষম্যের অবসান হবে। কিন্তু আজ পার্বত্য চুক্তির ২৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও সরকার সেই চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন করছে না। যার ফলে জুম্ম নারীদের অধিকার, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিন দুয়েক আগে কর্মস্থলের পাশে জুম্ম নারীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় এবং বান্দরবানে এক মারমা নারীকে ধর্ষণের ঘটনা তার প্রমাণ। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য জুম্ম নারীদের অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে।

অ্যাডভোকেট চঞ্চু চাকমা বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি আনুগত্য রেখেই তো ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তাহলে পার্বত্য চুক্তি নিয়ে কথা বললে এবং পাহাড়ের মানুষগুলোর অধিকারের জন্য কথা বললে দেশদ্রোহী হতে হবে, এটা তো হতে পারে না। সরকারের প্রতি তিনি আহ্বান জানান, আপনারা আমাদের আপন করে নিন। আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা জুম্ম জনগণ রয়েছে, তারা কোনোদিন এই রাষ্ট্রের সাথে বেঈমানি করবে না।

উল্লেখ্য, আলোচনা সভা শুরুর আগে একটি র‌্যালিও বের করা হয়। র‌্যালিটি জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকে বনরূপা পেট্রোল পাম্প প্রদক্ষিণ করে আবার জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয়ে। র‌্যালি উদ্বোধন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য জ্যোতিপ্রভা লারমা।