শিজক কলেজে পিসিপি’র নবীনবরণ অনুষ্ঠিত

হিল ভয়েস, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় পিসিপি শিজক কলেজ শাখার উদ্যোগে “শেকলে বাঁধা জীবন, কাঁদছে জুম পাহাড়, শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রাম হোক নবীনের অঙ্গীকার” – এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে শিজক কলেজে ভর্তিকৃত একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নবীন বরণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) সকাল ৯:৩০ ঘটিকায় সময়ে শিজক কলেজের হলরুমে অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় বলে জানা গেছে।

পিসিপি শিজক কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক জগৎ আলো চাকমার সঞ্চালনায় এবং পিসিপি শিজক কলেজ শাখার সভাপতি রুপেজ চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিজক কলেজের অধ্যক্ষ সুভাষ দত্ত চাকমা, প্রধান আলোচক ছিলেন পিসিপির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বাঘাইছড়ি থানা কমিটির সভাপতি পুলকজ্যোতি চাকমা, শিজক মুখ উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক জ্ঞানময় চাকমা, পিসিপি রাঙামাটি জেলা শাখার সভাপতি সুমন চাকমা, বাঘাইছড়ির হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ভূমিকা চাকমাসহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সুভাষ দত্ত চাকমা বলেন, সময়ে যেটা প্রয়োজন সেটা যদি কোন ব্যক্তি সম্পাদন করতে পারে, তাহলে সে একজন প্রকৃত মহাপুরুষ। তাঁকে সর্বজনে পূজা করে, শ্রদ্ধা করে। আজকে আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসের সামনেও এম এন লারমার একটা ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। মহান নেতা এম এন লারমা জুম্ম জনগণের জাতীয় দুর্দিনে আত্মসুখ, ব্যক্তিস্বার্থ বাদ দিয়ে জুম্মদের সামগ্রিক স্বার্থে সময়োপযোগী কাজ করতে পেরেছেন বলে তিনিও একজন মহান পুরুষ হিসেবে পরিগণিত হতে পেরেছেন।

তিনি আরও বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের কেবল শিখলে হবে না। একাডেমিক বই-পুস্তকের বাইরে গিয়েও তোমাদের নীতি নৈতিকতাবোধ শিখতে হবে। স্বজাতির প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। দেশপ্রেম থাকতে হবে।

প্রধান আলোচক সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, প্রকৃত নবীন তাকেই বলে যার মর্যাদাবোধ, আত্মসম্মানবোধ আছে, লড়বার তেজ আছে এবং অন্যায়ের মোকাবেলা করার সাহস রাখে। আদর্শিক চেতনায় একত্রিত, সংগঠিত এবং মুক্তির সংগ্রামে সমাবেশিত হওয়ার সমস্ত প্রচেষ্টা রাখতে দুর্ভেদ্য সৎসাহসিকতার পরিপক্কতা অর্জন করে এগিয়ে যেতে পারে।

তিনি বলেন, আজকে জুম্মদের জীবন প্রকৃত অর্থে শেকলে বাঁধা। ৫ই আগস্টের পরেও জুম্মদের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর যে বিমাতাসুলভ আচরণ সেটা দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে। গুটিকয়েক সেটেলার বাঙালির অবরোধে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের মত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক বাতিল হয়ে যায়, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল হয়ে যায়। অথচ রাষ্ট্রযন্ত্রের সদিচ্ছা থাকলে, জুম্ম জনগণের অধিকারের প্রতি রাষ্ট্র আন্তরিক থাকলে এমনটা ঘটতো না।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিণত করার ষড়যন্ত্র আরও জোরদার হয়েছে। জুম্ম জনগণ আজ তাদের নূন্যতম মৌলিক মানবাধিকার চর্চার পর্যন্ত সুযোগ পাচ্ছে না। খাগড়াছড়িতে নিজের বোনের ধর্ষণের বিচার খুঁজতে গিয়ে গুইমারাতে জুম্মদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট লুটপাট ও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনজন নিরীহ যুবককে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গণহারে মামলা দেয়া হয়েছে। সমাবেশে অংশগ্রহণ করার কারণে অনেকজনকে সেনাক্যম্পে নিয়ে গিয়ে টর্চার করা হয়েছে।

পুলকজ্যোতি চাকমা বলেন, নবীন মানে নতুন কিছু, নতুন চিন্তা-ভাবনা, নতুন উদ্যোগ। এটাই নবীনের প্রকৃত মাহাত্ম্য। নবীনরা চাইলে একটি জাতিকে যেমনি এগিয়ে নিতে পারে, তেমনি ইতিহাসের পেছনের দরজা দিয়েও তারা সেই জাতির পতনও ঘটাতে পারে। তাই নবীনদের অবশ্যই নবীনত্বের ইতিবাচক দিকটা বেছে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

তিনি বলেন, পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়া জুম্মদের বিকল্প কিছু ভাবনা ভাবার অবকাশ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বৃহত্তর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। এ ঘোষণায় জনসংহতি সমিতি ছাত্র ও যুব সমাজকে অধিকতর অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছে।

সুমন চাকমা বলেন, পরিবর্তনের বিশ্বে আজ চারদিকে তরুণ-ছাত্র সমাজের অভূতপূর্ব উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে সেটা ইতিবাচক, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে নেতিবাচক। এমনতর বাস্তবতায় আমাদের জুম্ম তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও আমরা একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। এটা নিঃসন্দেহে খুবই ভালো এবং ইতিবাচক একটা লক্ষণ। তিনি বলেন, ছাত্র সমাজকে শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলে হবে না, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে গিয়েও তাদের অবশ্যই সময়োপযোগী, বিভিন্ন বই-পুস্তক, পেপার-ম্যাগাজিন অধ্যয়ন করতে হবে।

সুমন চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষাব্যবস্থাও আজ বেহাল দশা। বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাটা আজ প্রায় ধ্বংসের দারপ্রান্তে। সরকারিভাবে নিয়োগকৃত অনেক শিক্ষক তাদের পরিবর্তে স্থানীয় ক্লাস ফাইভ-সেভেনে পড়া বর্গা শিক্ষক দিয়ে নিজেদের চাকরি টিকিয়ে রেখেছেন। আমরা মনে করি এ দায় সম্পূর্ণ বাংলাদেশ সরকারের এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। আজকে শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে যদি যথাযথ তদবির করা হতো তাহলে শিক্ষাব্যবস্থার এমন বেহাল দশা হতো না।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুপন চাকমা। নবীন শিক্ষার্থীদের পক্ষ বক্তব্য প্রদান করেন কানন চাকমা। এছাড়া নবীনদের ফুল দিয়ে বরণ করেন শিজক কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জয়ন্তী চাকমা ও নবীনদের থেকে ফুলের তোরা গ্রহণ করনে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তরুণ শান্তি চাকমা ও ত্রয়া চাকমা।

বিকেলের পর্বে শিজক কলেজের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্যে দিয়ে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে।

More From Author

+ There are no comments

Add yours