শাসকগোষ্ঠী আমাদেরকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের জন্য দমনপীড়নকে বেছে নিয়েছে- রাঙ্গামাটিতে নিরুপা দেওয়ান

0
665

হিল ভয়েস, ১২ জুন ২০২২, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটিতে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার ২৬ বছর উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য ও শিক্ষাবিদ নিরুপা দেওয়ান বলেন, শাসকগোষ্ঠী আজ আমাদেরকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের জন্য দমনপীড়নকে বেছে নিয়েছে। দমনপীড়নের অংশ হিসেবে তারা বিভিন্ন সময়ে অপহরণ, খুন, গুম তথা জেল-জুলুম জারি রেখেছে। কল্পনা চাকমা অপহরণ সেই নিপীড়নের অংশ ছিল।

আজ ১২ জুন ২০২২ পাহাড়ের নারী নেত্রী কল্পনা চাকমার অপহরণের ২৬ বছর উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় নিরুপা দেওয়ান একথা বলেন। আলোচনা সভায় তিনি প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

মহিলা সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রিতা চাকমার সভাপতিত্বে এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় আলোচক হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি শ্রী বিজয় কেতন চাকমা, কল্পনা অপহরণ মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জুয়েল দেওয়ান, অ্যাডভোকেট সুস্মিতা চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক ইন্টু মনি তালুকদার, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সহ সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর ত্রিপুরা নান্টু, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সুমন মারমা।

প্রধান আলোচকের বক্তব্যে নিরুপা দেওয়ান আরো বলেন, কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছিল, কারণ কল্পনা চাকমা সংগ্রামী ছিলেন। অন্যায়ের বিপক্ষে তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর এবং আমাদের প্রতিবাদী চেতনাও। শুধু কল্পনা চাকমা নয়, আমরা জুম্ম জনগণ অধিকারকামী। অধিকারকামী বলেই আমরা প্রতিবাদ করছি, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, সরকার তথা এদেশের শাসকগোষ্ঠী তাদের হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য আমাদের আত্মপরিচয়কে অস্বীকার করেছে, ফলে তারা আমাদেরকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে তকমা দিয়েছে।

নিরুপা দেওয়ান আরো বলেন, কয়েকদিন আগে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা রাঙ্গামাটিতে এলেন। অনেক কিছু বলে গেলেন। এটা কিসের ইঙ্গিত বহন করে? ভালো নাকি মন্দের? তিনি কোটা বিষয়ে জিওসির বক্তব্যকে সমালোচনা করে বলেন, জিওসি সাহেব আমাদের কোটা ব্যবস্থাকে যে রাষ্ট্রের অনুগ্রহ করে পাওয়া বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন এটা অত্যন্ত দুঃখজনক, সংবিধান পরিপন্থী এবং সাম্প্রদায়িক বক্তব্য। তিনি তার বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধুমাত্র চাকমারাই শিক্ষার হারের দিক দিয়ে এগিয়ে (৭২%) গেছেন বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের মধ্য জাতিবিদ্বেষকে উস্কে দেওয়ার জন্য। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।

এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা বলেন, আজ ২৬ বছরে পদার্পণ করলেও কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার হয়নি এবং কল্পনা চাকমার হদিশ মেলেনি। এটা আমাদের জন্য খুবই হতাশাজনক এবং রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। তবে, একদিন না হয় একদিন এর বিচার হতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি আরো বলেন, পুরুষদের পাশাপাশি আমাদের মা-বোনদের আরো সংগ্রামী হতে হবে। তাদেরকে রাজনৈতিক সংগঠনে বেশি বেশি যুক্ত হতে হবে। এখানে ঘটে যাওয়া প্রতিটা অমানবিক ঘটনার প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিবাদে না হলে প্রতিরোধ করতে হবে। প্রতিরোধে নাহলে জীবন দেওয়ার জন্য আজকের ছাত্র-যুব এবং নারী সমাজকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

কল্পনা চাকমার অপহরণ মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জুয়েল দেওয়ান বলেন, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন কল্পনা চাকমাকে অপহরণের পর পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তারই প্রেক্ষিতে সরকার বিচারপতি জলিলের নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে। সেখানে বলা হয়েছে যে, ‘কল্পনা চাকমা স্বেচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক অপহৃত হয়েছেন। কিন্তু, কারা অপহরণ করেছে তা তারা খুঁজে পায়নি’। আসলে কি কেউ নিজে স্বেচ্ছায় অপহৃত হতে পারেন কিনা? আমার ২৫ বছরের ওকালতি জীবনে এমন তাজ্জব কথা আমি শুনিনি।

তিনি আরো বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের যখন বিচার প্রক্রিয়া চলছিল, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বারংবার দাবি করা হয়েছে যে, আমাদের বিচার ব্যবস্থা নাকি আন্তর্জাতিক মানের! মানে খুব স্বচ্ছতার সহিত এদেশে বিচারকার্য সম্পাদন করা হয়। তাহলে, আজকে কল্পনা চাকমার অপহরণের ২৬ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও কেন সেটার বিচার হলো না? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের একের পর এক হত্যা, গুমের যে বিচার মেলেনি, ঠিক তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের কল্পনা চাকমাসহ অনেক অধিকারকর্মীর ওপর সংগঠিত হত্যা, গুম এবং অপহরণেরও বিচার হয়নি। বিভিন্ন নিপীড়নের মাধ্যমে আমাদের যে দমিয়ে রাখা, এটা সেই পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর যে অন্যায় নিপীড়ন, বস্তুত তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

অ্যাডভোকেট সুস্মিতা চাকমা বলেন, কল্পনা ছিলেন একজন জীবন সংগ্রামী। তিনি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সর্বদা সংগ্রামে অবিচল ছিলেন। রাষ্ট্রের বৈষম্যের কারণে কল্পনার অপহরণের বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যার কারণে ন্যায়বিচার পাওয়া যাচ্ছে না। কল্পনা চাকমা সংগ্রামের প্রতীক। জুম্ম নারী শিক্ষার্থীদের কল্পনার সংগ্রামী পথ ধারণ করা দরকার। অধিকার আদায়ে নারীদের সংগ্রামে আরও যোগ দিতে হবে। কল্পনা পাহাড়ের অনুপ্রেরণা। আমরা আশাবাদী, বিচার পাবো।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক ইন্টুমনি তালুকদার বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের জুম্ম নারী হয়েও অধিকার আদায়ের দাবিতে কল্পনার বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর পাহাড়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। কল্পনা চাকমার বক্তব্য ছিল অসাধারণ। তার বলিষ্ট কন্ঠস্বর শাসকগোষ্ঠীর ভিত কাঁপিয়েছে।

যুব সমিতির নেতা সাগর ত্রিপুরা নান্টু বলেন, ১২ জুন কালো রাত্রিতে পাহাড়ের বুকে একদিন সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গ কল্পনাকে অপহরণ করা হয়। কল্পনা পাহাড়ের কন্ঠস্বর। শাসকগোষ্ঠীর এরকম হীন কর্মকান্ডকে তীব্র নিন্দা জানাই।

তিনি বলেন, সরকার সামরিকায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। আদিবাসীদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার জন্য ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। কল্পনার অপহরণের ২৬ বছর পূরণ হলেও তার যথাযথ বিচার না হওয়া সরকারের ব্যর্থতা। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারহীনতার সংস্কৃতি জিইয়ে রেখেছে সরকার। এতে করে জুম্ম জনগণ সবখানে অনিরাপদ। বর্তমানে ইউপিডিএফ আবারো পার্বত্য চুক্তি সংশোধন করে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে। যা জুম্ম জনগণের সাথে ধোকাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। তাই যুব সমাজকে এই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য অধিকতর আন্দোলনে সামিল হতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি সুমন মারমা বলেন, জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে কল্পনা চাকমা ছিলেন বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। সরকার কল্পনা চাকমার অপহরণকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে পদোন্নতি দিয়েছে। কল্পনা অপহরণ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিথ্যাচার করেছেন। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আমাদের আরো অধিকতর সামিল হতে হবে। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যে দায়িত্ববোধ থাকা দরকার তা নিয়ে অধিকতর সচেতন হতে হবে। চুক্তিকে নস্যাৎ করতে প্রতিনিয়ত অপশক্তির উত্থান হচ্ছে। সচেতন হয়ে অপশক্তিকে রোধ করতে হবে।

আলোচনার শুরুতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বিবৃতি পাঠ করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার সহ সাধারণ সম্পাদক এলি চাকমা এবং স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি ম্রানুচিং মারমা।

সভাপতির বক্তব্যে রিতা চাকমা কল্পনা চাকমা অপহরণসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে সবাইকে সামিল হওয়ার আহবান জানান।