শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে দরকার সরকারের সদিচ্ছাঃ বিভিন্ন দেশের ইতিহাস তাই বলছে

0
918
ফাইল ফটো
অনুরাগ চাকমা

১৯৯৮ সালে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে যখন Good Friday Agreement হয়, তখন এই শান্তি চুক্তির স্বাক্ষরকারী বিদ্রোহী দল Irish Republican Army (IRA) ভেঙে যায়। Michael McKevitt-এর নেতৃত্বে কিছু বিদ্রোহী মিলে Real Irish Republican Army (RIRA) নামে একটি চুক্তিবিরোধী সশস্ত্র গ্রুপ গড়ে তোলে। এই গ্রুপটি সরকারের কাছে Irish Republican Army-এর অস্ত্র সমর্পণকে জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা এবং প্রতারণার অভিযোগ আনে। সেই সাথে চুক্তিটিকে বাঁধাগ্রস্ত করার জন্য এই গ্রুপটি বিভিন্ন সময়ে বোমা হামলাসহ ব্রিটিশ এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে যায়। দেশে চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় থাকার পরেও চুক্তি সম্পাদনের ১০ বছরের মধ্যে Good Friday Agreement ৯৫.২৪ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।

অপরদিকে, পাপুয়া নিউ গিনির সরকার এবং Bougainville Republican Army (BRA) ২০০১ সালে Bougainville Peace Agreement সম্পাদন করে। কিন্ত, এই চুক্তির বাস্তবায়নকে বাধা দেওয়ার জন্য Bougainville Republican Army (BRA) নেতা Francis Ona কিছু সদস্য নিয়ে তার সশস্ত্র কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। দেশে চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় থাকার পরেও চুক্তি সম্পাদনের ১০ বছরের মধ্যে Bougainville Peace Agreement ৮৯.৩৩ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।

এবার কি বুঝতে পারছেন, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে চুক্তি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে? চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপ উত্থান হওয়ার পরেও চুক্তি বাস্তবায়ন করলে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে না। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড এবং পাপুয়া নিউ গিনির উদাহরণ তাই বলছে। এবার ভেবে দেখুন, তারাও কি আমাদের মত চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র দলের কার্যক্রমের উদাহরণ দিতে পারত না? চুক্তি বাস্তবায়ন না করার জন্য একটা অজুহাত দেখাতে পারত না? তাদের প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করতে পারত না? চুক্তি স্বাক্ষরকারী বিদ্রোহী দলকে খোঁচা মেরে বলতে পারত না? তোমরা এক গ্রুপ থেকে ভেঙে নিজেরাই কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মারামারি কর। এতে দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। তাই, চুক্তি বাস্তবায়ন করা যাবে না। এখানে আরও বেশি নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রয়োজন।

এখানেই নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড এবং পাপুয়া নিউ গিনির সাথে আমাদের পার্থক্য হয়ে গেছে। তারা চুক্তি বাস্তবায়ন না করার জন্য কোন অজুহাত দেখায়নি, আমরা সেটা করছি। তারা কেন অজুহাত দেখায়নি? কারণ, চুক্তি বাস্তবায়নে সেদেশের সরকারগুলোর জেনুইন ইন্টারেস্ট আছে। যেটা আমাদের নেই। একারণে, চুক্তি সম্পাদনের দশ বছরের মধ্যে আমাদের পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি মাত্র ৪৮.৮৯ শতাংশ।

এবার আপনি হয়তো বলবেন, এই দুটো কেস স্টাডি (নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড এবং পাপুয়া নিউ গিনি) নিয়ে কেন পার্বত্য চুক্তির তুলনা করছি? একজন গবেষক হিসিবে বলব, পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনেকে Small-N Comparative Research করে। অর্থাৎ, কোন একটা বিষয় নিয়ে দুই/তিনটা দেশের মধ্যে তুলনামূলক গবেষণা করে। যাক সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এবার গ্লোবাল স্যাম্পল নিয়ে আলোচনায় যাওয়া যাক। এখানে এটাও বলে রাখি, আমরা Peace and Conflict Studies-এ এসব চুক্তি বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে Spoilers in Civil War Peace Processes হিসেবে অধ্যয়ন করি। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Stephen John Stedman GB Spoilers বিষয়ে পাইওনিয়ার কাজ করেছেন।

এবার আসুন আসল কথায়। Andrew G. Reiter ২০১৫ সালে Does Spoiling Work? Assessing the Impact of Spoilers on Civil War Peace Agreements শিরোনামে একটি গবেষণা প্রবন্ধ Civil Wars জার্নাল থেকে প্রকাশ করেছিলেন। এই গবেষণা দাবি করেছে, স্নায়ু যুদ্ধের পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সম্পাদিত ২৪১টি শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রে চুক্তি বিরোধীতা দেখা গেছে। এমনকি দেশে দেশে চুক্তি বিরোধী অনেক সশস্ত্র দলের উত্থান ঘটেছে। কিন্ত, চুক্তি বাস্তবায়নে এসব চুক্তি বিরোধী গোষ্ঠীর তেমন প্রভাব পড়েনি।

এবার কি বুঝতে পারছেন? চুক্তিকে বিরোধিতা করে সশস্ত্র দলের উত্থান শুধু মাত্র আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের একক সমস্যা নয়। এটা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। একারণে আমার প্রশ্ন হচ্ছে সেই জায়গায়। চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র দলের কার্যক্রম সক্রিয় থাকার পরেও যদি অনেক দেশ তাদের শান্তি চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে। সেখানে আমরা রাজনৈতিক মাঠ থেকে শুরু করে টকশো এবং ফেসবুকে পর্যন্ত এই একটা বিষয় নিয়ে পড়ে আছি। পাহাড়ে সশস্ত্র গ্রুপ আছে। তাই, চুক্তি বাস্তবায়ন করা যাবে না। এতে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। Small-N এবং Large-N গবেষণার জায়গা থেকে দেখলে এই দাবির তেমন কোন ভিত্তি নেই। যেটা আমি আলোচনা করে আসলাম।

বরং, চুক্তি বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হলে এসব সশস্ত্র কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেত। কিভাবে এটা হত? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে পারেন আরেকটি গবেষণায়। Madhav Joshi  এবং Jason Michael Quinn ২০১৬ সালে ৩১টি দেশের শান্তি চুক্তির উপর গবেষণা করেন। এই গবেষণাটি Research and Politics জার্নাল থেকে Watch and Learn: Spillover Effects of Peace Accord Implementation on Non-Signatory Armed Groups শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এই গবেষণারও মূল বক্তব্য হল, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে সরকারের প্রতি কারোর আস্থা এবং বিশ্বাস থাকবে না। অন্যদিকে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চুক্তি বাস্তবায়ন করলে সরকারের ভাবমূর্তি এবং সুনাম বাড়ে। এতে করে চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও সরকারকে বিশ্বাস করে শান্তি প্রক্রিয়ায় আসতে আগ্রহী হয়।

পরিশেষে বলব, শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আস্থা এবং বিশ্বাস (Trust-building) দরকার হয়। কারণ, Peace-building-এর একটা গুরুত্বপূর্ণ পিলার হল Trust-building। তাই, পার্বত্য অঞ্চলে সত্যিকার অর্থে শান্তি চাইলে সরকারকে সেদিকে নজর দিতে হবে। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীকেও ১৯৮০ এবং ১৯৯০ দশকের কাউন্টার-ইন্সারজেন্সি মেন্টালিটি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এজন্য বলব, নিরাপত্তা বাহিনীর নতুন নতুন ক্যাম্প স্থাপন করে নয়, দমন-পীড়ন করে নয়, বলপ্রয়োগের নীতি প্রয়োগ করে নয়, একে অপরের প্রতি বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা নিয়ে সবাইকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব অনেক ছোট হয়েছে। তাই যেসব দেশে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন সফল হয়েছে, আমরা সেসব দেশের কাছ থেকেও শিক্ষা নিতে পারি।

লেখক: গবেষক, সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পিএইচডি স্কলার, দি অস্ট্রালিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।